করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের অধিকাংশ স্থলবন্দর। সংক্রমণ যাতে না ছড়ায়, তার জন্য পেট্রাপোল, আগরতলার চেকপোস্ট আর চ্যাংরাবান্ধা-বুড়িমারির স্থলবন্দর-সহ অল্প কয়েকটি জায়গায় পারাপার চলছে। কারণ, যথাযথ নজরদারির মতো পরিকাঠামো এই সব জায়গাতেই কেবল রয়েছে। কোভিডের আবহে পরিকাঠামোর এই দুর্বলতা প্রকট হলেও, দীর্ঘ দিন ধরে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থলবন্দর এবং চেক পোস্টগুলিতে ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা দুই দেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৪০৯৬ কিলোমিটার, যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম স্থলসীমান্ত। মোট আটত্রিশটি জায়গা মানুষ ও মালপত্রের বৈধ পারাপারের জন্য চিহ্নিত রয়েছে, যদিও তার সব ক’টি অতিমারির আগেও সক্রিয় ছিল না। এগুলির কয়েকটিতে শুধু জিনিসপত্রের জন্য স্থলশুল্কের অধীনে পারাপার হয়, কয়েকটি মানুষ পারাপারের জন্য ইমিগ্রেশন চেক পোস্ট, এবং কয়েকটিতে দুই ব্যবস্থাই রয়েছে, অর্থাৎ নিবিড় (ইন্টিগ্রেটেড) চেক পোস্ট। আধুনিক ব্যবস্থা এবং উন্নত পরিকাঠামো রয়েছে কেবল নিবিড় চেক পোস্টগুলিতে। ভারতের প্রথম নিবিড় চেক পোস্ট অবশ্য তৈরি হয় পঞ্জাবের আটারিতে, পাকিস্তান সীমান্তে, ২০১২ সালে। বাংলাদেশ সীমান্তে আপাতত চারটি নিবিড় চেক পোস্ট চালু রয়েছে আগরতলা (২০১৩), পেট্রাপোল (২০১৬), শ্রীমন্তপুর আর সুতারকান্দিতে (২০২০)। আরও সাতটি চালু হওয়ার কথা ২০২৫ সালের মধ্যে, যার একটা রেলপথের উপর, ত্রিপুরার নিশ্চিন্তপুরে।
ভারত এবং বাংলাদেশের বহু মানুষের কাছে সীমান্ত-বাণিজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু দেশের সরকারের কাছে স্থলবন্দর বা নিবিড় চেক পোস্টগুলি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। ভারতের ক্ষেত্রে তার কারণ বোঝা কঠিন নয়— আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাত্র দুই শতাংশ হয় স্থলবন্দর দিয়ে, এবং রফতানি হয় প্রধানত খাদ্যশস্যের মতো স্বল্পমূল্যের পণ্য, সোনা বা হিরে-জহরতের মতো উচ্চমূল্যের পণ্য নয়। বর্তমানে এই নিবিড় চেক পোস্টগুলো তাদের ক্ষমতার চাইতে ১৫০-২০০ শতাংশ বেশি মালপত্র পারাপার করছে। যার ফলে সময় লাগছে বেশি, ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ছে, লাভ কমছে। টাকা নষ্ট হচ্ছে পরিবহণে, পার্কিং এবং স্টোরেজ-এর জন্য। ফলে জিনিসের দামও বাড়ছে। কেবল পরিকাঠামোর খামতির জন্য বাণিজ্যের সুবিধার অনেকটাই মাঠে মারা যাচ্ছে। যেমন, কলকাতা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে পেট্রাপোল যাওয়ার জন্য জাতীয় সড়ক (১৯,১১২) এবং রাজ্য সড়কে এতই গাড়ি, যে মালবাহী ট্রাকের গতি থাকে কম। তিনটি রাস্তারই দু’দিকে প্রচুর গাছ, অবৈধ বসবাসকারীরও অভাব নেই, ফলে রাস্তা বড় করার সুযোগও নেই।
আর একটা সমস্যা পার্কিং নিয়ে, যাকে ঘিরে একটা অবৈধ ব্যবসা গড়ে উঠেছে। ভারত থেকে রফতানির ট্রাকগুলো চেক পোস্টেই পার্কিং করার কথা, কিন্তু চেক পোস্টের কুড়ি কিলোমিটার মতো আগে, কালীতলায় একটা অবৈধ পার্কিং সিন্ডিকেট চলছে। সেখানে বহু দিন ধরে পার্ক করা থাকে গাড়ি, দৈনিক পার্কিং ফি দিতে হয়। এ সমস্যা নতুন নয়। বেনাপোলেও ট্রাকের লাইন লেগে থাকে।
গত বছর অতিমারি দেখা দেওয়ার পর এক একটা ট্রাক দশ দিনও দাঁড়িয়ে ছিল। বেনাপোল বছরে ৫০ হাজার টন মাল গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এক লক্ষ টনেরও বেশি মাল এসে যায়। বিপুল পার্কিং ফি খেসারত দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে
হয় ট্রাক।
গাড়ির চাপের জন্য পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তে ২৪ ঘণ্টা কাজ চালু রাখার কথা হয়েছিল। ২০১৭ সালে ভারত ও বাংলাদেশ এ বিষয়ে সহমত হয়। আজও রাতে কাজ হয় না, এবং শুক্রবার করে সব কাজ বন্ধ থাকে। এই সমস্যার অন্যতম কারণ শুল্ক বিভাগের যথেষ্ট কর্মীর অভাব। সেই সঙ্গে রয়েছে ডিজিটাইজ়েশনের অভাব— এখনও শুল্ক আধিকারিকরা হাতে সই করেন, গাড়ির পাস মানে তিন কপি কাগজ। সামুদ্রিক বন্দরগুলিতে এ সব এখন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হয়। অথচ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিরিখে বাংলাদেশ পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্যসঙ্গী, দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম। ভারত থেকে রফতানির ৭৫ শতাংশ, এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে আমদানির ৫০ শতাংশ হয় স্থলপথে, তার ৬৫ শতাংশ হয় কেবল পেট্রাপোল-বেনাপোল দিয়ে। অথচ, পরিকাঠামোর সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাণিজ্য।
পর্যটনের দৃষ্টিতেও স্থলপথের চেক পোস্টগুলিকে সক্রিয় করা প্রয়োজন। যে দেশ থেকে সবচাইতে বেশি আন্তর্জাতিক পর্যটক আসে ভারতে তা হল বাংলাদেশ, এবং এঁদের ৭০ শতাংশই আসেন স্থলপথে। প্রতি বছর অন্তত আড়াই লক্ষ লোক পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে আসেন, কারণ তা কলকাতার কাছাকাছি। বর্তমানে জ়িরো গেট নামে একটামাত্র প্রবেশ দ্বার দিয়ে যাতায়াত চলে। একটি টার্মিনাল বিল্ডিং-এর কাজ চলছে, সম্ভবত আগামী বছর তা সম্পূর্ণ হবে।
কূটনীতির দৃষ্টিতেও ভারত-বাংলাদেশ স্থল সংযোগের গুরুত্ব কম নয়। পূর্বের দেশগুলির প্রতি আরও সক্রিয় সহযোগিতার হাত বাড়ানো, প্রতিবেশী দেশগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যে নীতি ভারত নিয়েছে, তার সঙ্গে স্থলবন্দরের পরিকাঠামোর উন্নতির সাক্ষাৎ সম্পর্ক রয়েছে। ত্রিপুরার আগরতলা থেকে নিশ্চিন্তপুর হয়ে বাংলাদেশের আখাউরা অবধি যে রেলপথ তৈরি হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে মণিপুর-মায়ানমার সীমান্তের মোরে অবধি বিস্তৃত হতে পারে।
ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ এবং বাকি ভারতের সংযোগ উন্নত করা, এবং সেই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে মাল জোগানের ব্যবস্থার নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করতে পারে ভারত ও বাংলাদেশ, যদি স্থলবন্দরগুলিকে সক্ষম ও সক্রিয় করার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়ণ করতে পারে।
সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকনমিক প্রোগ্রেস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy