হেরোইন গেট হিসেবে গুজরাত এবং মাদকের স্বর্গরাজ্য নামে পরিচিত পঞ্জাবের কাহিনি গোটা ভারতবর্ষে সুবিদিত। কিন্তু কত জন জানি যে, গত এক দশক ধরে, বিশেষ করে শেষ চার-পাঁচ বছরে মাদকের অবৈধ পাচার, মাদকের স্থানীয় ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবহারের কারণে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস-ভূগোল পাল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মায়ানমার, অসম ও ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশের বর্ডার পেরিয়ে যে মাদক নেটওয়ার্ক গত চার দশকের বেশি সময় ধরে রমরমিয়ে চলছে, তাতে ত্রিপুরার আধিপত্য ছিল অবিসংবাদিত। কিন্তু আশঙ্কার কথা হল, আগে যেখানে ত্রিপুরা ড্রাগ পাচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হত, এখন সেখানে রাজ্যের তরুণ-তরুণীরাই প্রধান মাদক সেবনকারী হয়ে উঠেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যে কোনও স্থানীয় খবরের কাগজ এক সপ্তাহ খুঁটিয়ে পড়লে ত্রিপুরায় ড্রাগের প্রকোপ সম্পর্কিত খবর নজরে আসতে বাধ্য। শুধু তা-ই নয়, এডস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ত্রিপুরায়। সরকারি তথ্য বলছে, কলেজ-পড়ুয়া’সহ যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ড্রাগের নেশা। একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক নেওয়ার ফলে প্রতি দিন গড়ে অন্তত ২-৩ জন তরুণ-তরুণী এইচআইভি সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিজেপি ক্ষমতায় এসে ‘নেশামুক্ত ত্রিপুরা’ গড়ার ডাক দেয়। ১৪ মাসে প্রায় ৭০,০০০ কেজি ভাং, প্রচুর হেরোইন, ব্রাউন শুগার এবং ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করা হয়। দক্ষিণ ত্রিপুরার শ্রীনগর এবং সিপাহিজলা জেলার শ্রীনগরে যে দুটো বর্ডার হাট ছিল, তার উপরে বিশেষ নজর রাখা শুরু হয়। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ২০১৯ সাল থেকে ত্রিপুরা মাদকদ্রব্য পাচার বিষয়ে কঠিন অবস্থান নিলে সীমান্ত বাণিজ্য ও সীমান্ত অপরাধ প্রবণতা নিয়ে, বাংলাদেশের মৌলভীবাজার, খাগড়াচেরি ও রাঙামাটি অঞ্চলের আধিকারিকদের সঙ্গে ত্রিপুরার ঊনকোটি, ধলাই ও আগরতলার আধিকারিকদের আলোচনা হয়। তখন মায়ানমার থেকে আসতে শুরু করে ব্রাউন শুগার, হেরোইন এবং ইয়াবা ট্যাবলেট। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ফেন্সিডিল বা কাফ-সিরাপ, ফেভিকল (যা সিগারেটের উপর প্রলেপ করে লাগিয়ে ব্যবহার হয়) এবং গাঁজা বাংলাদেশে পাচার শুরু হয়।
মজার ব্যাপার, ক্ষমতায় আসার পর এক দিকে যখন বিজেপি সরকার রাজ্যে মাদক বিরোধী প্রচারে নামে, সে সময়ে আবার তারা গাঁজাকে অর্থকরী গাছ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। ২০২০ সালের মার্চে সে রাজ্যে বিজেপির মুখপাত্র ও গণজাগরণ মঞ্চ নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাঁজা চাষকে চিকিৎসা বা অন্য শিল্পের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে কি না, সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে। বিপ্লব দেব-এর নেতৃত্বে বিজেপি-আইপিএফটি পরিচালিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০২১-এ িবধানসভায় গাঁজা চাষকে আইনানুগ করার প্রস্তাবও ওঠে। এই চাষে বৈধতা দিলে, ত্রিপুরায় তা রাজস্ব আয়ের পথ সুগম করতে পারে কি না, সে বিষয়ে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলদেশে অবৈধ মাদকপাচারের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামি ছাত্র সংগঠনগুলির নাম জড়িেয় পড়ে। বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের মধ্যে যে পথ ধরে অবৈধ ড্রাগ ব্যবসা রমরমিয়ে চলত, বাংলাদেশের সুরক্ষা বাহিনী তাকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হওয়ায় ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অসম দিয়ে নতুন ড্রাগের নেটওয়ার্ক চালু হয়। সেই সময়ে দু’টি ড্রাগ রুটের কথা প্রকাশ করে একটি সংবাদ সংস্থা। প্রথম রুট ছিল, মায়ানমার থেকে মণিপুর, সেখান থেকে শিলচর পেরিয়ে ত্রিপুরা, এবং শেষ গন্তব্য বাংলাদেশ। দ্বিতীয় পথটি— মায়ানমার থেকে মিজোরাম, তার পর ত্রিপুরার ধর্মনগর, সোনামুড়া ও সীমান্ত শহর কৈলাসহর পেরিয়ে বাংলাদেশ। উত্তর ত্রিপুরার পানিসাগর, খোয়াই, তেলিয়ামুড়া, হাওয়াইবাড়ি এবং বক্সনগর থেকে যে আলু, পেঁয়াজ, চা-পাতা বা বিভিন্ন মেশিনের অংশ নিয়ে যে সব গাড়ি বাংলাদেশে যায়, তাতে ভরে দেওয়া হত ফেন্সিডিল বা কাফ-সিরাপ। ২০১৩ সালে ফেন্সিডিলকে নিষিদ্ধ ড্রাগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, ১৯৮৫-র এনডিপিএস অ্যাক্টের মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশে ১০০ গ্রামের কাফ-সিরাপ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ত্রিপুরার লঙ্কামুড়া, দুর্গাপুর, হরিহরদোলা বা কাঁঠালিয়া থেকে মাদক পাঠানো হয় বাংলাদেশে।
কোভিড সময়কালে যাতায়াতের পথ পাল্টালেও ড্রাগের পাচার বন্ধ করা যায়নি। বরং জীবন ও জীবিকার ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে নতুন নতুন ড্রাগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। বিএসএফ ত্রিপুরা ২০২০ সালে আটক করে ৪,৬৭,৪৫৩ ইয়াবা ট্যাবলেট, ৫,৩০৩ কেজি গাঁজা, ৬৫,৮৮৫ বোতল ফেন্সিডিল কাফ-সিরাপ এবং ৪৬,৯৯,৬৯০ সংখ্যক গাঁজা গাছের চারাকে নষ্ট করে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি অবধি আটক করা হয় ৫,৯০৭ কেজি গাঁজা, ৩৪,৬৭৪ ইয়াবা ট্যাবলেট, ২৩,১০৫ বোতল ফেন্সিডিল, প্রায় ৪০ লাখ টাকার অন্যান্য ওষুধ এবং ধ্বংস করা হয় ৮,৬৫,৮৩৯টি গাঁজা গাছ। ত্রিপুরায় বিজেপি শাসনের চার বছর পূর্তির সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছিলেন, বিজেপি ‘নেশামুক্ত ত্রিপুরা’ তৈরিতে সফল হয়েছে। কিন্তু এই সাফল্যের গল্প শোনানোর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্র্যাফিক পুলিশের হাতে অ্যারেস্ট হয়েছেন কুড়ি লাখ টাকার ১৩৫ কেজি শুকনো গাঁজা পাচারকারী এক ট্রাকের চালক। তাঁর ট্রাকে গাঁজার প্যাকেট চাকার ভিতরে লোডিং করা হয়েছিল! কিন্তু এ সব কোনও নতুন ঘটনা নয়। স্থানীয় খবরের কাগজে প্রতি দিনই নেশা কারবারিদের আটকের খবর পাওয়া যায়।
কিন্তু ত্রিপুরা হঠাৎ মাদক কারবারিদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল কী ভাবে? ১৯৮০ বা ১৯৯০-এর দশকে ত্রিপুরায় গাঁজার চাষ শুরু হয়। বাম আমলে প্রায় তিন দশকের উপরে পুলিশ-প্রশাসনের নজর ছিল উগ্রপন্থী উচ্ছেদে। গাঁজা চাষ হত পাহাড়ি আদিবাসী এলাকায়। প্রশাসন বিশেষ মাথা ঘামাত না। ত্রিপুরার গাঁজার মান খুব ভাল ছিল। সরবরাহ করা হত ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং বাংলাদেশে। সেই সময় শাসক দলের সঙ্গে ফেন্সিডিল ডিলারদের সখ্য ছিল। আসলে যে সরকার যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের কর্মীদের সঙ্গে এই ড্রাগডিলারদের যোগ ছিল। ২০১২ সালে বিহারে মদ নিষিদ্ধ হলে ত্রিপুরায় গাঁজার এক বিরাট বাজার তৈরি হয়, চাহিদা বৃদ্ধি হয়। এখন বাংলাদেশে গাঁজার বাজার গৌণ হয়ে গেছে। বিহার, বেঙ্গালুরু, হিমাচল প্রদেশ, হায়দরাবাদ, হরিয়ানা, পঞ্জাব-সহ সারা ভারতে ত্রিপুরা থেকে গাঁজা সরবরাহ করা হয়। যত দূর যাবে, দাম বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা কিলো হিসাবে যে গাঁজা বিক্রি হয় ত্রিপুরাতে, দূর রাজ্যে ডেলিভারির সময় তার দাম বেড়ে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। লভ্যাংশের পরিমাণ এত বেশি যে, অনেক ধরপাকড়, সরকার তথা পুলিশের অনেক চেষ্টাতেও গাঁজা চাষ বন্ধ করা যাচ্ছে না। গ্রামীণ অর্থনীতির অংশ হয়ে উঠেছে গাঁজা চাষ, বাইরে থেকেও অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। পাহাড়ের রিজ়ার্ভ ফরেস্ট এলাকায় চাষ হচ্ছে, যেগুলি সরকারি জমি। সেই জমিতে চাষের মালিকানা কার, তাও পুলিশ-প্রশাসন উদ্ধার করতে পারে না। মাদকবাহী গাড়ির ড্রাইভাররা জানতে পারেন না, গাড়িতে কী আছে। অনেকে এ ভাবে ধরা পড়ে জেলও খাটছেন।
বিজেপি সরকারে এসে আইনি ভাবে গাঁজা চাষের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু ট্রাইবাল অঞ্চলে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মুখ্যমন্ত্রী পুলিশবাহিনী নিয়ে ট্রাইবাল অঞ্চলে গেলে তাঁর কনভয় গাঁজা খেতের পাশ দিয়েই যায়, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। ত্রিপুরার সিপাহিজলা জেলা বাঙালি অধ্যুষিত, যেখানে সবচেয়ে বেশি গাঁজা চাষ হয়। বেশি গাঁজা উৎপন্ন হয় পশ্চিম ত্রিপুরায় সিমনা-বরকাঁঠাল অঞ্চল এবং খোয়াই-এর আদিবাসী এলাকাতেও। অর্থকরী গাছ হিসেবে গাঁজা চাষের সুবিধে, এই গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে। প্রসঙ্গত, আগে ত্রিপুরার অন্যতম অর্থকরী ফসল রাবারের দাম এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নগামী।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-এর অক্টোবর পর্যন্ত ত্রিপুরায় এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ২,৪৫৯ জন, মোট মৃত্যু সংখ্যা ৬৪০। গত চার বছরে সংক্রমিতের সংখ্যা বেড়েছে ১০ গুণের মতো। ত্রিপুরায় কোনও কালেই শিল্প ছিল না। এক সময় সরকারি চাকরি সাধারণ মানুষের সামাজিক ও আর্থিক ভিত্তি ছিল। শিক্ষক, পুলিশ বা অন্য চাকরি পাওয়ার সংখ্যা কমে গেছে। বেকারত্ব, দারিদ্রের সঙ্গে নেতিবাচক মনোভাব থেকে অনেকে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। জনজাতি ও আদিবাসীরা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। এই নেশা কিন্তু হালকা বা মাঝারি মাদকে থেমে নেই, হার্ড ড্রাগ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। অর্থাৎ আগে যে রাজ্য শুধু মাদকের সরবরাহকারী রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হত, এখন তা হয়ে উঠেছে মাদক-ব্যবহারকারীদের স্বর্গরাজ্য।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবারমহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy