টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে উনিশটা পদক পেয়ে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন অন্য রকম সক্ষম ক্রীড়াবিদরা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি পদকজয়ীদের পুরস্কার, সম্মাননা দিয়েছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী দেখা করেছেন তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু প্রদীপের তলায় থাকা অন্ধকার আড়ালেই থেকে গিয়েছে, এমনটাই মনে হয়। বিরাট সংখ্যক শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত এবং মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কি একটু পাল্টাবে এতে? সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম, তাঁরা জানেন যে এঁদের অত্যাচার ও অবজ্ঞা করলে কোনও শাস্তি হয় না, কারণ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সময় নষ্ট করার মতো সময় সরকারের নেই। অথচ এঁদের জন্য আইন আছে, এঁরাও সমানাধিকারের দাবিদার।
প্রায়ই খবর আসে, গণপ্রহারে কেউ মরণাপন্ন বা মৃত। পরে জানা যায়, মানুষটি শারীরিক বা মানসিক ভাবে অসুস্থ, অক্ষম। কম বোধযুক্ত, ক্ষীণদৃষ্টি, শ্রবণে বা কথনে অসুবিধাসম্পন্ন এঁরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারেন না। অপরাধের জ্ঞান নেই, কিন্তু শাস্তি পেতে হয় চূড়ান্ত। এঁদের উপর নানা আইনবিরুদ্ধ সামাজিক অপরাধ করা হয়ে থাকে। মেয়েরা হন যৌন নিগ্রহের শিকার, ব্যঙ্গ ও মনোরঞ্জনের বস্তু। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ কেস নথিভুক্ত করে না। রাষ্ট্রপুঞ্জ একদা ঘোষণা করেছিল, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিরা সমাজে সবচেয়ে নিরাপদ কিন্তু বড় বেশি বিপন্ন। দেশে দেশে সমানাধিকারের আইন হয়েছে, কিন্তু কতটা চেতনা জাগ্রত হয়েছে সাধারণ মানুষের?
বিপন্ন কি শুধু এই মানুষেরাই? এই সন্তানদের যাঁরা জন্ম দেন, প্রতিপালন করেন, তাঁদেরও কম হেনস্থা হয় না। প্রতি পদে মনে করিয়ে দেওয়া হয় তোমাদের সন্তান, তোমরাও করুণার পাত্র। অভিভাবকদেরও মানসিক লাঞ্ছনা, নিগ্রহ চলে প্রতিনিয়ত। আঘাত আসে শুধু আত্মীয়স্বজনদের থেকেই নয়, সমাজের থেকেও। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের জন্যে করুণা বেশি, সহযোগিতা কম। রাজ্য সরকারের এক সহকারী শিক্ষক চিকিৎসকের আত্মহননের খবর পাওয়া গেল, কলকাতা থেকে মেদিনীপুরে কাজে যাতায়াত করতেন। স্বামীও একই পেশায়, বহরমপুরে থাকেন। একটি আট বছরের মেয়ে, অটিজ়মে আক্রান্ত। বাড়িতে আয়ার কাছে মেয়েকে রেখে কলকাতা থেকে মেদিনীপুর রোজ যাতায়াত কষ্টের। কলকাতায় বদলির আবেদন করেছিলেন, গ্রাহ্য হয়নি, বদলি হল ডায়মন্ড হারবারে। এ কি শাস্তির সমান নয়? মেয়ে প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও চাকরি করা, আবার কলকাতায় বদলি চাওয়া! ক্রমে মানসিক অবসাদ, শেষে আত্মহত্যা।
বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্যে ভেবেছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। ১৯৭৭-এ আইন করে সরকারি চাকরিতে তিন শতাংশ সংরক্ষণ, সন্তানদের দেখাশোনার জন্য অভিভাবকদের পাশে থাকার কথাও বলেন। ১৯৯১-এ দুটো আইন হয়, স্বামী ও স্ত্রী যথাসম্ভব এক জায়গায় চাকরিতে পোস্টিং এবং মানসিক অপরিণত সন্তানদের মাতৃভাষায় শিক্ষা, পরিচর্যা ও পরিষেবা পাওয়ার জন্যে অভিভাবকদের নিজের পছন্দমতো জায়গায় চাকরির সুযোগ। সেই আইন বর্ধিত আকারে আরও কিছু শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত সন্তানের অভিভাবকদের জন্যে প্রযোজ্য হয় ১৯৯৩-এ। ১৯৯৫-এ সমানাধিকার আইন চালু হয় বিশেষ সক্ষম ব্যক্তিদের জন্যে, সেই আইন পরে নতুন করে চালু হয় অটিজ়ম-সহ আরও অনেক প্রতিবন্ধ-ক্ষেত্রকে নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৩-এ এই আইন কার্যকর করে। ২০১৮ সালে ভারত সরকার আবার বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত সন্তানের অভিভাবকদের বদলির ব্যাপারে কঠোর নির্দেশিকা জারি করে, যাতে তাঁরা সন্তানের সঙ্গে, এক সঙ্গে থাকতে পারেন। তাঁদের ক্ষেত্রে বদলির পুনরাবৃত্তিও প্রযোজ্য নয়। এই সব আইনই রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, সে জন্য রাজ্য আইনসভায় বিল পাশ করিয়ে নিতে হয়। কর্মক্ষেত্রের উদাসীনতায় ভুক্তভোগী অনেকে আইনের সাহায্য চাইলে আদালত বেশ ক’টি ক্ষেত্রে এই দুই আইনের অনুকূলেই রায় দিয়েছে। তবু রেহাই মেলে না এই অভিভাবকদের। বাবা-মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয় শিশুরা।
উপরের ঘটনায় বাবা-মা দু’জনের একই জায়গায় পোস্টিং এবং সন্তানের সঙ্গে থাকার সুযোগ, কোনওটাই মেলেনি। কলকাতায় বদলির আবেদন অগ্রাহ্য হয়, সুদূর এক প্রান্তে বদলি করে সরকারি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আইনবিরুদ্ধ কাজ করেছে সরকারই। সন্তান কত শতাংশ ক্লিনিক্যাল প্রতিবন্ধকতাযুক্ত তা নিশ্চয়ই কর্মক্ষেত্রের রেকর্ডে আছে, কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করতে পারে না। আইনকে মান্যতা দিয়ে কর্মস্থলেরই বাবা-মাকে এক জায়গায় পোস্টিং, সন্তানের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। কেন এই অভিভাবকদের সন্তানের জন্য দয়াভিক্ষা চাইতে হবে?
আসল কথা, আইন থাকে আইনের বইয়ে, মানুষ চলে অমানবিকতার পথে। যাদের হাতে আইনের ভূলুণ্ঠন হল, মানসিক অবসাদে এক মা আত্মহত্যা করলেন, একটি শিশু মাতৃহীন হল, তাদের বিচার কে করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy