—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
রাতে ঘুম হচ্ছে, শিবুদা? চোখের নীচে কালি পড়েছে না কি?” তপেশের প্রশ্নে দেশলাই কাঠি দিয়ে কান খোঁচানোর চেষ্টা স্থগিত রাখলেন শিবুদা। একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললেন, “গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে আসল কথায় আয়— নতুন কোনও প্যাঁচ ভাঁজছিস?”
ধরা পড়ে গিয়ে মিচকি হাসে তপেশ। “রাতবিরেতে যে পরিমাণ দুমদাম বোমা ফাটছে— তা-ও নব্বই নয়, একশো পঁচিশ ডেসিবেল— তাতে কি আর আপনার ঘুম হচ্ছে? এই বয়সে রাতে ঘুম না হলে তো স্বাস্থ্য খারাপ হবেই।”
“আর তোর যে এই বয়সেও কাণ্ডজ্ঞান হল না, সে বেলা?” হাত থেকে কাঠিটা অ্যাশট্রেতে ফেললেন শিবুদা। “অ্যাদ্দিন ধরে যত বাজি ফেটেছে, সব নব্বই ডেসিবেলের? চকলেট বোম, দোদোমা, সব? শব্দসীমা বাড়িয়েছে— কাজটা আদৌ ভাল হয়নি— এখন আইন মেনে পিলে চমকাবে সবাই, আগের চেয়ে হয়তো বাড়াবাড়িও হবে। কিন্তু দূষণ কি শুধু শব্দেই হয়? আলোর বাজিতে কী পরিমাণ কেমিক্যাল থাকে, আর তাতে কী তেড়ে দূষণ হয়, ভুলে গেলে চলবে? জানতে চাইলি না তো, শ্বাস নিতে পারছি কি না? ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি কি না?”
“এর মধ্যে আবার ডিপ্রেশন এল কোত্থেকে?” প্রশ্ন করল সূর্য। শিবুদা জানতেন, প্রশ্নটা উঠবেই। বললেন, “এল কি না, তা নিয়ে বিস্তর রিসার্চ চলছে। তবে, বায়ুদূষণের প্রভাব যে মানুষের আচরণে পড়ে, তার একাধিক প্রমাণ মিলেছে ইতিমধ্যেই। শৈশব-কৈশোরে, যত দিন অবধি শরীরের গঠন সম্পূর্ণ হয় না, তখন তো দূষণের প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যে পড়েই, এখন বলছে, পূর্ণবয়স্ক মানুষের আচরণও পাল্টে যায় দূষণের কারণে। কী ভাবে হয়, সে বিজ্ঞান আমার জ্ঞানগম্যির বাইরে, অতএব সেই ব্যাখ্যায় যাব না— কিন্তু, রিসার্চ বলছে, টানা দূষণের মধ্যে থাকলে অবসাদ আসে, মানুষ হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, ভায়োলেন্ট ক্রাইম বাড়ে, সামাজিক বিশ্বাসের পরিমাণ কমে।”
“সে সব তো নাহয় সহজে বোঝা যায় না। কিন্তু, দূষণের চোটে রাস্তায় বেরোনো যাচ্ছে না; ন্যাশনাল মিডিয়ায় সারা দিন ধরে দেখাচ্ছে; দিল্লিতে সরকার এই দেওয়ালিতে বাজি ফাটানো নিষিদ্ধ করেছে; তবুও একটা সমীক্ষায় দেখলাম, দিল্লিতে নাকি প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন বাজি ফাটাবে— এটা কী করে হয়, বুঝি না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে সূর্য। ওর দিদিরা থাকে দিল্লিতে, তাদের সাত বছরের পুত্রটির হাঁপানির সমস্যা, এই সময়টা একেবারে নাজেহাল হয়ে যায়। চলে আসার উপায় নেই, দিদি-জামাইবাবু দু’জনেরই অফিস, ছেলের স্কুল।
“তার কারণ, সবাই ভাবে যে, একা আমি বাজি না ফাটালে কী হবে, অন্যরা তো ফাটাবেই,” শিবুদা বলার আগেই উত্তর দেয় তপেশ। মাথা নাড়েন শিবুদা, “এটা একটা কারণ বটে, কিন্তু একমাত্র নয়। অন্য কারণে আসছি, কিন্তু তার আগে বল দিকি, লোকে বাজি ফাটায় কেন? এর চেয়ে ফালতু বিনোদন আর একটা খুঁজে পাওয়া ভার— আগুনের বিপদ, দূষণের বিপদ, বিকট শব্দ, ভয়ঙ্কর দাম— তবু এত লোকে পাগলের মতো বাজি ফাটায় কেন? বাজিতে আগুন দিলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আলোর রোশনাই হবে, অথবা প্রবল শব্দ হবে, সেটা জানা থাকলেও ওই আগুন দেওয়ার মুহূর্ত থেকে বাজি ফাটার মুহূর্ত অবধি মানুষ দম চেপে থাকে উত্তেজনায়— সেই উত্তেজনাটাই উপভোগ্য অনেকের কাছে। সে দিন একটা প্রবন্ধে পড়লাম, ছোটবেলায় বাজি ফাটানোর সুখস্মৃতি— সুখ কথাটায় জোর দিচ্ছি এখানে— আছে যাদের, বড় হয়েও তারা বাজি ফাটাতে ভালবাসে। মোট কথা, বাজি ফাটানোর সিদ্ধান্ত আসলে হাতেগরম সুখ বা উত্তেজনার সঙ্গে খানিক অস্পষ্ট এবং অনিশ্চিত বিপদের দড়ি-টানাটানির ফল। কোন পক্ষ জিতবে, বুঝতেই পারছিস।”
শিবুদার কথার মধ্যেই শিশির ঢুকল গোপালের দোকানে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “বাজি ফাটালেই সোজা হাজত। এ ছাড়া আর উপায় নেই।” গোপাল চা দিয়ে গিয়েছে এক ফাঁকে। একটা চুমুক দিয়ে শিবুদা বললেন, “সে তো যেখানে বাজি ফাটানো নিষিদ্ধ, সেখানে। কলকাতায় কী হবে?” শিশির উত্তর হাতড়াচ্ছে দেখে শিবুদাই বললেন, “কী ভাবে বায়ুদূষণ বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে— সবাইকে ধরে হাজতে পুরে দেওয়ার পরামর্শ অবিশ্যি কেউই দেয়নি— কিন্তু, তার মধ্যে একটা কথা একেবারে অনস্বীকার্য: মানুষ না চাইলে প্রশাসনের পক্ষে কোনও রকম বায়ুদূষণই পুরোপুরি ঠেকানো কঠিন। বাজির ক্ষেত্রেও কথাটা সমান ভাবে খাটে। সে কথা বলছি, কিন্তু তার আগে সূর্য যে প্রশ্নটা করছিল, তার উত্তর দিই— বায়ুদূষণের বিপদের কথা জেনেও মানুষ বাজি ফাটায় কেন?
“২০০৩ থেকে ২০১৮-র মধ্যে হওয়া অন্তত পাঁচটা গবেষণার ফলাফলে দেখছি, বায়ুদূষণ ঠেকাতে কোনও কাজ করতে বা না-করতে বলা হলে সেই পরামর্শে সবচেয়ে বেশি কান দেয় তারা, যারা অথবা যাদের বাড়ির লোক ইতিমধ্যেই শ্বাসজনিত কোনও রোগব্যাধিতে ভুগছে। এতে অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু, উল্টো দিকের কথাটা ভাব— যাদের বাড়িতে এমন রোগ নেই, তাদের কোনও দায়িত্ববোধও নেই? অন্য কারও ভয়ঙ্কর সমস্যা হচ্ছে জেনেও তারা নিজেদের আচরণ বদলাবে না? এতই স্বার্থপর সবাই?
“ড্যানিয়েল কানেম্যান সম্ভবত অন্য উত্তর দেবেন। একটু আগে বলছিলাম না, বাজি ফাটানোর সিদ্ধান্ত আসলে হাতেগরম আনন্দ আর অনিশ্চিত বিপদের মধ্যে দড়ি-টানাটানি, সেটা তো আসলে একটা ট্রেড-অফ— যে দিকে পাল্লা ভারী, মানুষ সে দিকেই রায় দেবে। তা হলে, যার নিজের বা বাড়ির কারও শ্বাসকষ্ট নেই, তাকে প্রথমে বুঝতে হবে যে, যাদের শ্বাসকষ্ট আছে, তাদের কতখানি কষ্ট হচ্ছে। ভেবে দেখ, এটা বোঝার কোনও সহজ উপায় কারও হাতে নেই— যার শ্বাসকষ্ট নেই, তাকে আন্দাজ করতে হবে অন্যের কষ্টের পরিমাণ। কী ভাবে করবে? কানেম্যান আর তাঁর দীর্ঘ দিনের সহকর্মী অ্যামস টভস্কি জানিয়েছিলেন, এমন কোনও অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় মানুষ আসলে প্রথমে এমন কোনও প্রশ্ন খোঁজে, যার উত্তরটা তার জানা— আর সেই উত্তরটাকে চাপিয়ে দেয় অজানা প্রশ্নের ঘাড়ে। গোটা ব্যাপারটার নাম হল ‘হিউরিস্টিকস’।
এ ক্ষেত্রে জানা প্রশ্ন হল, বাজির দূষণে আমার কতখানি কষ্ট হয়? যার শ্বাসজনিত অসুস্থতা নেই, তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর হল, খুব বেশি কষ্ট হয় না। আমরা কিন্তু সেই উত্তরটাকেই সটান অসুস্থদের উত্তর হিসাবে চালিয়ে দিই না— তাদের অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে উত্তরটাকে অ্যাডজাস্ট করি। কিন্তু, আমাদের মাথায় যে-হেতু কম কষ্টের অ্যাঙ্কর তৈরি হয়ে আছে, ফলে উত্তরটাকে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যাডজাস্ট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অতএব, বাজি ফাটানোর বিপদের মোট পরিমাণ বাজি ফাটিয়ে পাওয়া আনন্দের সম্বন্ধে প্রত্যাশার পরিমাণকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। নিতান্তই কস্ট-বেনিফিটের অঙ্ক,” কথা শেষ করে থামলেন শিবুদা।
“বাপ রে, বাজি ফাটানোর সপক্ষে এমন সওয়াল রাম জেঠমলানীও করতে পারতেন না,” টিপ্পনী কেটেই আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে দেয় তপেশ। শিবুদা মাছি ওড়ানোর ভঙ্গি করে নিজের কথায় ফিরে এলেন, “এই হিউরিস্টিকস-এর জোরে দুনিয়ায় কত সিদ্ধান্ত যে নিচ্ছে মানুষ। মোদ্দা কথা হল, যা চোখের সামনে ঘটছে, অথবা যা নিজের অভিজ্ঞতায় আছে, তাতে মানুষ বিচলিত হয় ঢের বেশি। বাজির দূষণ বল বা গাড়ির দূষণ, তার সমস্যা যত ক্ষণ অবধি না নিজের জীবনে টের পাওয়া যাচ্ছে, তত ক্ষণ অবধি ব্যাপারটার পুরো গুরুত্ব টের না পাওয়া অস্বাভাবিক নয় আদৌ।”
“তা হলে চলতেই থাকবে এই অত্যাচার?” খানিক বিরক্তির সঙ্গেই প্রশ্ন করল সূর্য।
শিবুদা বললেন, “না, থামানো যায়। কিন্তু, তার জন্য মানুষের শুভবুদ্ধি উদয়ের ভরসায় থাকলে মুশকিল। কৌশিক বসু যখন বিশ্ব ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ, তখন এক বার আমায় বলেছিলেন, ‘মানুষের শুভবুদ্ধির ভরসায় নীতি নির্ধারণ করা চলে না’। মানুষ দায়িত্ববান হলে ভাল, কিন্তু পলিসি তৈরি করার সময় ধরে নিতে হবে যে, গড়পড়তা মানুষ স্বভাবতই দেশ ও দশের মঙ্গলের কথা ভেবে নিজের কর্তব্য স্থির করে না, এমনকি সব সময় যুক্তিসঙ্গত কাজও করে না— মানুষ চালিত হয় হরেক সাময়িক আবেগের তাড়নায়। ধরতে হবে সেই জায়গাটায়। কী করা চলবে না, সেই আইন বাঁধলে লোকে ফাঁক খুঁজবে আইনকে ফাঁকি দেওয়ার— বিশেষত ভারতের মতো দেশে, যেখানে আইনের শাসন মানা লোকের তেমন অভ্যাস নেই। তার বদলে, কোনও গ্রহণযোগ্য বিকল্পের সন্ধান দেওয়া ভাল। গাড়ির দূষণের ক্ষেত্রে যেমন— ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি না করে যদি গণপরিবহণের উন্নতি ঘটানো হয়, সাইকেল চালানোর মতো রাস্তা তৈরি করা হয়, লোকে কিন্তু গাড়ির ব্যবহার কমায়। ইউরোপের বেশ কিছু শহরে এটা প্রমাণিত হয়েছে। বাজির ক্ষেত্রে তেমন বিকল্প কী হতে পারে, ভাব। সবই কি আমি বলে দেব?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy