ইনফ্লেশন’ শব্দটার বঙ্গানুবাদে মাঝেমধ্যেই একটা ভুল হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখি, বাংলায় লেখা হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। সেটা কিন্তু অন্য ব্যাপার— তার মানে বাজারে নগদের জোগান বেড়ে যাওয়া। যে সমস্যা এই মুহূর্তে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, তার বাংলা হল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বা মূল্যবৃদ্ধি। বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়াকেই মূল্যবৃদ্ধি বলা হয়। কিছু কিছু অর্থশাস্ত্রী মনে করেন যে, তুলনায় কম পরিমাণ পণ্য ও পরিষেবা কেনার জন্য যখন অনেক টাকা খরচ করা হয়, তখনই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা ঘটে। বিষয়টি অত সহজ নয়— এবং, এই ধরনের ব্যাখ্যা আসলে বিভ্রান্তিকর। ধরা যাক, কোনও কারণে বাজারে মোট টাকার জোগান হঠাৎ বেড়ে গেল। কিন্তু, এমন পরিস্থিতিতে টাকার হাতবদলের হার— অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়কালে গড়ে যত বার টাকার লেনদেন হয়— কমে গিয়ে মানুষের মোট ক্রয়ক্ষমতা অপরিবর্তিতও থাকতে পারে। অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভাবে যদি আয়ের পরিমাণ না বাড়ে, তা হলে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদাও সে ভাবে বাড়বে না যার ফলে ‘ডিমান্ড পুল’ বা চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে।
অর্থনীতিতে মানুষের আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা যদি বাড়েও, তা হলে মানুষ আগের তুলনায় আরও বেশি করে পণ্য ও পরিষেবা কিনতে চাইবে। তখন যদি বাজারে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগান না থাকে, সে ক্ষেত্রে চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে। যদিও মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে বাজারে টাকার জোগানও সমান তালে বাড়বেই, তা নয়। কেন তা না-ও বাড়তে পারে, আপাতত সেই তাত্ত্বিক আলোচনায় ঢোকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, মূল কথা হল, বাজারে টাকার জোগান বৃদ্ধি চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধির আবশ্যিক বা যথেষ্ট, কোনও শর্তই নয়— মানে, চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটার জন্য যেমন টাকার জোগান বাড়ার প্রয়োজন নেই, তেমনই চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে মানেই টাকার জোগান বেড়েছে, তা-ও নয়। অর্থব্যবস্থায় যদি কর্মহীন মানুষ থাকেন, অব্যবহৃত উৎপাদক সম্পদ থাকে, তা হলে চাহিদা বৃদ্ধি পেলে পণ্য ও পরিষেবার জোগানও বাড়তে পারে। তেমনটা ঘটলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে না, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে মানুষের আয় বাড়বে।
ঘটনা হল, বাজারের অধিকাংশ পণ্য ও পরিষেবার দাম নির্ধারিত হয় উৎপাদনের খরচ এবং সংস্থার মুনাফার হিসাবের ভিত্তিতে, চাহিদা-জোগানের সাপেক্ষে নয়। কাজেই, মূলত উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি বা লাভের অঙ্কের বাড়া-কমার হিসাবেও মূল্যবৃদ্ধি হয়ে থাকে। একে বলে ‘কস্ট পুশ ইনফ্লেশন’, বা উৎপাদনের ব্যয়বৃদ্ধিজনিত মূল্যবৃদ্ধি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে যদি অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ে, তা হলে অন্য সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলেও বহু শিল্পেরই কাঁচামাল বা অন্তর্বর্তী পণ্যের দাম বাড়বে, পরিবহণ ব্যয়ও বাড়বে। এর ফলে কোনও দেশে ব্যয়বৃদ্ধিজনিত মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে, যা সে দেশের অর্থনীতিতে টাকার জোগানের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। এ ছাড়াও আর এক ধরনের মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে। তাকে বলে ‘স্ট্রাকচারাল ইনফ্লেশন’ বা কাঠামোগত মূল্যবৃদ্ধি। কোনও দেশে যদি কাঠামোগত বড় কোনও পরিবর্তন ঘটে— যেমন, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিষেবায় যদি বড় মাপের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা বেসরকারিকরণ হয়, অথবা গণবণ্টন ব্যবস্থায় যদি কোনও বড়সড় অদলবদল হয়— তা হলে এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি হতে দেখা যায়। এর সঙ্গেও অর্থব্যবস্থায় প্রয়োজনের বেশি টাকার জোগান থাকার কোনও সম্পর্ক নেই।
টাকার জোগানের সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির সম্পর্ক নিয়ে এতগুলো কথা বলার কারণ হল, শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই মূল্যবৃদ্ধির হারে লাগাম পরানোর প্রয়োজন পড়লেই প্রথমে টাকার জোগান কমানোর কথা হয়। তা যে সব ক্ষেত্রে যথাযথ নীতি নয়, সে কথা মনে রাখা ভাল। প্রশ্ন হল, মূল্যবৃদ্ধি তবে রোধ করা সম্ভব কোন পথে?
মূল্যবৃদ্ধি ব্যাপারটা খারাপ, কারণ যদি পণ্য ও পরিষেবার মূল্য বেড়ে যায়, তা হলে টাকার অঙ্কে মানুষের আয় অপরিবর্তিত থাকলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে। কিন্তু দেশের অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে নিয়ন্ত্রিত মাপে মূল্যবৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। অবশ্য, উৎপাদক এবং জোগানদারদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের কাছে প্রণোদনার কাজ করতে পারে— দাম বাড়লে তাঁদের মনে বাড়তি মুনাফা অর্জনের আশা তৈরি হয়, ফলে ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এতে অর্থব্যবস্থার উন্নতি এবং নতুন কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির হার খুব বেশি হলে তা সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রবল সমস্যার কারণ হয়, যে হেতু বেশির ভাগ মানুষের আয়বৃদ্ধির হার মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা শূন্য নয়, চার শতাংশ ধার্য করে। কিন্তু, এই চার শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও তা সমাজের দরিদ্রতর মানুষের উপর প্রবল চাপ তৈরি করে— এই পরিবারগুলির আয়ের সিংহভাগ যে সব পণ্যের পিছনে খরচ হয়, সেই খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্যে চার শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিও তাঁদের পক্ষে সমস্যাজনক। অন্য দিকে, যদি মূল্যবৃদ্ধি মূলত বিলাসদ্রব্যের উপরে হয়, তা হলে মোটের উপর সামাজিক ভাবে তা সহনীয় সীমায় থাকে। ভারতে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে প্রধানত খাদ্য ও জ্বালানির ক্ষেত্রে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায়। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা জনগোষ্ঠীর কথা যদি বাদও দিই, ভারতের বেশির ভাগ মানুষই কার্যত দরিদ্র— মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয়বৃদ্ধির কোনও উপায় তাঁদের নেই। ফলে, অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই ভারতে মূল্যবৃদ্ধি খুবই কষ্টদায়ক।
মূল্যবৃদ্ধির হার উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছলেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রিত নির্দেশক সুদের হার— রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের রেপো রেট, অর্থাৎ যে সুদের হারে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে অতি স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেয়— বাড়ানোটা একটা নিয়মিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অথবা, বাজারে নগদের জোগানে রাশ টানতে কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়। এটা এই প্রত্যাশা নিয়ে করা হয় যে, এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে ঋণের উপর সুদের হারও বাড়বে, ফলে বিনিয়োগ কম হবে, অর্থব্যবস্থায় সার্বিক ভাবে চাহিদা কমবে। বিনিয়োগ কমবে, কারণ লগ্নিকারীদের একাংশের জন্য নতুন বিনিয়োগ আর লাভজনক থাকবে না— যে ঋণ নিয়ে লগ্নি করা হবে, বর্ধিত হারে তার উপর যত সুদ দিতে হবে, তার তুলনায় লগ্নির থেকে প্রত্যাশিত নিট মুনাফার পরিমাণ কম। লগ্নির পরিমাণ কমলে সার্বিক ভাবে কর্মসংস্থানও কমবে, তার ফলে সার্বিক ভাবে আয়ের পরিমাণ কমবে। তার ফলে পণ্য ও পরিষেবার মোট চাহিদাও কমবে। এই ভাবে চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি আটকানো সম্ভব হবে। কিন্তু, উৎপাদনের ব্যয়বৃদ্ধির ফলে যে মূল্যবৃদ্ধি হয়, অথবা কাঠামোগত মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কী হবে?
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যে নীতি গ্রহণ করে, চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া অন্য গোত্রের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তা কার্যকর নয়। ঘটনা হল, সুদের হার বাড়ালে ভবিষ্যতের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার কী প্রভাব পড়বে, গোটা দুনিয়াতেই তা অত্যন্ত অনিশ্চিত— ভারতীয় অর্থব্যবস্থাতেও এই নীতির সপক্ষে কোনও তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া, এই ভাবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বিনিয়োগ, দেশের আর্থিক বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের উপর। আরও মনে রাখা জরুরি যে, সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে তা সুদের হার অর্থাৎ ঋণের মূল্য বাড়িয়ে উৎপাদনের খরচ বাড়ায়, ফলে উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের কাজটি, অতএব, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের উপরে ছেড়ে দিলে চলবে না, কারণ চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনও গোত্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নেই। চড়া হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটি সরকারের অন্য অনেক বিভাগের উপরেও বর্তায়।
বিভিন্ন ভাবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন, পেট্রোপণ্যের উপরে শুল্ক কমিয়ে; ন্যায্য মূল্যের দোকানের মাধ্যমে জনসাধারণকে খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরকার নির্ধারিত দামে দিয়ে; বেসরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট পরিষেবার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে; বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে; দেশ জুড়ে সেচ এবং হিমঘরের সুযোগসুবিধা বাড়িয়ে; বিভিন্ন অত্যাবশ্যক পণ্য এবং ওষুধের উপরে ভর্তুকি দিয়ে; মজুতদারি ও একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে; এবং মাঝেমধ্যে বিদেশ থেকে কম দামে বিভিন্ন জিনিস আমদানির মতো নানান পদক্ষেপ করে। তালিকা দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই— মোট কথা হল, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পথ আছে। মূল্যবৃদ্ধি রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রচলিত নীতিগুলিকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে মুদ্রানীতি নির্ধারক রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের অতি নির্ভরতাকেও প্রশ্ন করা প্রয়োজন।
সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy