ভগবান বৃদ্ধ হলেই বা কী আসে যায়? রুশ লেখক আন্তন চেখভ এক বার তাঁর বিখ্যাত পূর্বসূরি সম্বন্ধে বলেছিলেন, গোগোল না থাকলে আমরা কেউ হতাম না। তাঁর ‘দি ওভারকোট’ গল্প থেকেই আমাদের সৃষ্টি। ঘটনাচক্রে দুই প্রজন্মের দুই দিকপালের কখনও দেখা হয়নি। গোগোলের মৃত্যুর আট বছর পর চেখভের জন্ম।
৯৮ বছরের দিলীপকুমারের জাদু-সম্মোহও সে রকম। পার্থিব জগতে তিনি থাকুন বা না-থাকুন, ভবিষ্যতের যে অভিনেতারা আজও জন্মাননি, তাঁরা স্বরক্ষেপণে এবং অভিনয়কৌশল্যে তাঁর থেকেই আজন্ম প্রেরণা পাবেন। সুভাষ ঘাইয়ের বিধাতা ছবিতে ছেলে, ছেলের বৌ খলনায়কের হাতে খুন, একরত্তি নাতিকে নিয়ে মালগাড়ির ইঞ্জিনে প্রৌঢ় দিলীপ কুমার আকাশের দিকে তাকিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন, “ইস বাচ্চোকা বিধাতা কৌন হ্যায়?” তিনিই যে বাস্তবে কয়েক প্রজন্ম ধরে বলিউডের বিধাতাপুরুষ, তা বোঝা গিয়েছিল কয়েক বছর আগে তাঁর আত্মজীবনী দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডোজ় বেরোনোর দিন। মঞ্চে ওঠার শারীরিক ক্ষমতা নেই, তবু তাঁকে ঘিরে ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ থেকে শাহরুখ, আমির সকলে। অমিতাভ বললেন, “তরুণ অভিনেতারা পর্দায় পূর্বতনদের দেখতে দেখতে সব সময় বিকল্প ভাবে, আমি হলে এই সিনটা কী ভাবে করতাম। কিন্তু দিলীপসাবের অভিনয় দেখার পর সেই সব বিকল্প-টিকল্প ভাবা যায় না।” জাভেদ আখতার বললেন, “এখনকার অনেকে খেয়াল রাখেন না, অভিনয়ের ব্যাকরণ ও ছন্দে তারা দিলীপ কুমারকেই অনুসরণ করছেন।” রাজ কপূরের ভবঘুরে ও ভাগ্যহত প্রেমিক চরিত্র নয়, দেব আনন্দের পশ্চিমি কেতা নয়, গঙ্গা যমুনা বা নয়া দৌড়-এর দিলীপ কুমারই রয়ে যাবেন ভারতীয় সিনেমায় অভিনয়ের শোণিতস্রোতে। দিলীপ কুমার আজীবন অভিনয়েই তন্নিষ্ঠ। পরিচালনা-প্রযোজনায় আকৃষ্ট হননি কখনও।
এই অভিনয় স্বদেশে স্বরাট। লরেন্স অব অ্যারাবিয়া ছবিতে পরিচালক ডেভিড লিনের প্রথম পছন্দ ছিলেন তিনি। কথাবার্তাও কিছু দূর এগিয়েছিল, কিন্তু দিলীপ রাজি হননি। পরে ওই চরিত্রে আসেন মিশরীয় ওমর শরিফ। দিলীপ কুমারের ছেড়ে-যাওয়া জুতোয় পা গলিয়ে ওমর দুনিয়াখ্যাত তারকা, কিন্তু এ নিয়ে তাঁর কোনও দুঃখবোধ ছিল না। ‘ওমর শরিফ ভালই করেছিলেন, অমনটা হয়তো আমিও পারতাম না’ গোছের একটি লাইনই তাঁর আত্মজীবনীতে খুঁজে পাওয়া যায়। মনোভাবটা যেন, ‘আমি আমার জায়গায় সেরা, হলিউডের শংসাপত্র কেন দরকার।’
এই আত্মবিশ্বাস পেশোয়ারের অভিজ্ঞান। ভারতীয় সিনেমায় পঞ্চাশের দশকে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ ও রাজ কপূর, তিন জনেই উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ার অঞ্চলের লোক। দেব ও রাজের পরিবারে তবু ফিল্মি সংযোগ ছিল। রাজের বাবা স্বয়ং পৃথ্বীরাজ কপূর, দেব আনন্দের দাদা চেতন আনন্দ নবকেতন ফিল্মস-এর স্রষ্টা। কিন্তু ফল-ব্যবসায়ী লালা গোলাম সারওয়ার খান ও আয়েষা বেগমের পরিবারে কস্মিন্কালেও কেউ সিনেমার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। অথচ, ১৯২২ সালে এই মা-বাবার কোলে জন্মানো মহম্মদ ইউসুফ খানের দৌলতে পেশোয়ারের ওই বাড়ি আজ পাকিস্তানে সংরক্ষিত ভবন। সিনেমায় নামার পর ইউসুফ খানই তো দিলীপ কুমার! কয়েক বছর আগে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ়’ দেওয়ার পর মুম্বইতে তাঁর বাংলোর সামনে শিবসেনার হুঙ্কার। কিন্তু স্থিতধী অভিনেতা বিন্দুমাত্র টলেননি।
ফিল্মোগ্রাফি বলবে, তাঁর জীবনে বাংলা ছবি হাতেগোনা, যার একটি তপন সিংহের সাগিনা মাহাতো। বম্বে টকিজ়ে তাঁকে প্রথম সই করান দেবিকারানি, মাসিক ১২৫০ টাকা মাইনেয়। প্রথম ছবি জোয়ার ভাটা-র পরিচালক অমিয় চক্রবর্তী। তার পর নীতিন বসুর সঙ্গে একে একে মিলন, দিদার বা গঙ্গা যমুনা। আবার বিমল রায়ের পরিচালনাতেই দিলীপকুমারকে নিয়ে দেবদাস, মধুমতী। দ্বিতীয় ছবিটার চিত্রনাট্য ঋত্বিক ঘটকের, সম্পাদনায় হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। হাল আমলে শাহরুখ খানের দেবদাস অক্সফোর্ডে গিয়েছে, কিন্তু দেবদাস দিলীপ মারা যাচ্ছেন, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ‘পার্বতী’ সুচিত্রা সেনের সিংহদুয়ার, ওই ট্র্যাজেডি আজও একক ও অনবদ্য।
লোকে তাঁকে ট্র্যাজেডি কিং আখ্যা দেয় ঠিকই, কিন্তু কী এসে যায় এ সব ক্লিশে তকমায়? দিলীপ নায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন, দাদাসাহেব ফালকে থেকে পদ্মবিভূষণ অবধি বহু সম্মানে সম্মানিত, তাতেই বা কী এল-গেল! আসল তাঁর অভিনয়-ঐতিহ্য। কে ভুলতে পারে বৈরাগ ছবিতে বাবা ও দুই যমজ ছেলের তিনটি চরিত্রে অভিনয়! বহু পরে অমিতাভ বচ্চন মহান ছবিতে তিনটি চরিত্রে অভিনয় করবেন, নয়া দিন নয়ী রাত-এ সঞ্জীবকুমার নয়টি চরিত্র করবেন, কিন্তু পথিকৃৎ দিলীপ কুমারই! ১৯৭৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য স্বেচ্ছাকৃত, অঘোষিত অবসর। দ্বিতীয় দফায় ফিরে একের পর এক উজ্জ্বল উদ্ধার। ওই সময়েই রমেশ সিপ্পির শক্তি ছবিতে তিনি নীতিনিষ্ঠ বাবা। নিজের হাতে গুলি করেছেন পলাতক স্মাগলার পুত্র অমিতাভকে। সে বারও সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার তাঁর হাতে। তারও আগে নয়া দৌড় ছবিতে মোটরগাড়িকে হারাতে টাঙাওয়ালা দিলীপ যে ভাবে নতুন রাস্তা তৈরি করেন, সেখানে কি নেই আজকের লগান ছবির পূর্বকৃতি?
সিনেমা সাদা-কালো থেকে রঙিন হবে, চারটে ক্যামেরার বদলে ১৪টা ক্যামেরা, নতুন প্রযুক্তি আসবে, সবই ঠিক। কিন্তু ওই যে নতুন রঙে সেজে ওঠা রঙিন মুঘল-এ-আজম ছবিতে মাথা নিচু করে চিন্তিত দিলীপ, ঝাড়বাতির নীচে মধুবালা আশ্বাস দিয়ে নেচে ওঠেন, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’! প্রতাপশালী বাবার সামনে মুখ না খোলার এই যন্ত্রণাই তো সব। সাদা-কালো থেকে টেকনিকালার, সব যুগে। সেখানেই অভিনেতা অম্লান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy