Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
এবার পাঠ্যক্রমের রাজনীতি
delhi university

নিপীড়নের সাহিত্য ছাত্রদের ‘আহত’ করে, এটাই সিদ্ধান্ত?

মুশকিল হল, তত্ত্বাবধায়ক কমিটির প্রস্তাবে গণতান্ত্রিক আলোচনা ছাড়াই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল এই বদলকে চালু করে।

ঈপ্সিতা হালদার
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:৪৭
Share: Save:

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি স্নাতকের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দলিত সাহিত্যিক বামা ও সুকীর্থারানি, মহাশ্বেতা দেবীর ছোট গল্প দ্রৌপদী। তাতে ‘হাল্লা বোল’ কেন? দিন ও দিক বদলের সঙ্গে পাঠ্যক্রম বদলানোরই কথা। ইংরেজরা যাওয়ার পরেও স্বাধীন কেনিয়ায় রানির ইংরেজির মাহাত্ম্য অটুট দেখে, এবং আফ্রিকি ভাষা-সংস্কৃতি বা জীবনপ্রণালীর কিছুই পঠনযোগ্য গণ্য হচ্ছে না দেখে, ইংরেজি বিভাগটাই তুলে দেওয়ার বৈপ্লবিক উস্কানি দিয়েছিলেন গুগি ওয়া থিয়ং’ও। গুগির অন দি অ্যাবলিশন অব দি ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট (১৯৭২) ধরে হাজির হয় তাঁর যুগান্তকারী আলোচনা: ডিকলোনাইজ়িং দ্য মাইন্ড: দ্য পলিটিক্স অব ল্যাঙ্গোয়েজ ইন আফ্রিকান লিটারেচার (১৯৮৬)। আলোচনাটির সূত্রেই ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের বিভাগে দেখা হয়, ব্রিটিশদের কায়েমি ইংরেজি সাহিত্যের বাইরে ইংরেজি কী ভাবে মিলেছে উপনিবেশের অন্যান্য ইতিহাস ও না-লেখা স্মৃতির নির্যাসের সঙ্গে; লোককথা, আচার-অনুষ্ঠান, নিত্য দিনের কথা বলাবলির অভ্যাস নিয়ে কেমন বহুরূপী চেহারা নিয়েছে— সেই সব প্রশ্ন। যোগ হয়েছে ইংরেজিতে লেখা ভারতীয় সাহিত্যও। কিন্তু সে-ও তো ক্ষমতার ইংরেজি-নির্ভর সামাজিকতা। উচ্চকোটি থেকে দেখা জীবনেরই গল্প। আমাদের দেশে কারা ইংরেজিতে লেখাপড়া করে ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করতে পারবেন, সেই সুযোগও তো ঔপনিবেশিক আধুনিকতারই ফসল। তাই ইংরেজি অনুবাদে ভারতীয় নানা ভাষা-সাহিত্যকে ইংরেজি সাহিত্যের আওতায় আনলে, ইংরেজি সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তা বদলায়। ভাষা-সাহিত্যের উচ্চবর্গীয় ক্লাসিকের সঙ্গে যখন প্রান্তিক গোষ্ঠীর উপদ্রুত জীবন পাঠ্যক্রমের আওতায় আসে, তা ভারতীয়দের কাছে ইংরেজি সাহিত্য কী, ভারতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজির ভূমিকা, ভারতীয়ত্বের বহুস্তরীয় সমীকরণ ইত্যাদি বোঝার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা তৈরি করে।

মুশকিল হল, তত্ত্বাবধায়ক কমিটির প্রস্তাবে গণতান্ত্রিক আলোচনা ছাড়াই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল এই বদলকে চালু করে। কারণ হিসাবে বলা হয়, দ্রৌপদী-তে ভারতীয় সেনার ছবিটি মর্যাদাহানিকর। সাঁওতাল নকশাল কর্মী দোপ্দী মেঝেন ধরা পড়ার পর সেনাদের দ্বারা তাঁর গণধর্ষণের হাড়-হিম বর্ণনা সংবেদনশীলতাকে আঘাত করে। তাই দ্রৌপদী সিলেবাসে রাখা যাবে না। বলা হয়, বামা ও সুকীর্থারানির লেখায় দলিত নারীদের উপর নিজগোষ্ঠীর ও সবর্ণ পুরুষের যৌন অত্যাচারের ভয়াবহ বর্ণনা পড়িয়ে ছাত্রদের অস্বাচ্ছন্দ্যে না ফেলে দলিতের অধিকার প্রাপ্তির আখ্যান বাছলে দেশে জাতপাত নির্বিশেষে সামাজিক মুক্তি, সাম্য প্রাপ্তির ইতিহাসের পর্যায়কে ধরা যাবে।

বামা ফাউস্টিনা সুসাইরাজ তামিল সাহিত্যের দলিত নারীবাদী স্বর। তাঁর আত্মজৈবনিক আখ্যান কারুক্কু থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তাঁর উপন্যাস সংগতি পর্যন্ত তামিল দলিত খ্রিস্টান পারিয়া গোষ্ঠীর মহিলাদের উপর নির্যাতনের ছবি। বলেন, নারী হিসাবে দলিত নারী দ্বিগুণ নির্যাতিত। নির্যাতনকারী সবর্ণ পুরুষ; গোষ্ঠীর ও পরিবারের পুরুষও। বামার লিখনশৈলী পারিয়া মৌখিকতার উপর ভর করে থাকে। অলজ্জ ভাবে মহিলাদের তীব্র স্বর ও ‘অশ্রাব্য’ ভাষাকে লিপিবদ্ধ করেন, মধ্যবিত্ত পুংবাদী সামাজিকতাকে এবং তার লালিত নীতিবাদী শীলতাকে সজোরে প্রহার হেনে। দলিত নারীর সেই যৌনধর্মী অপভাষা, বামার মতে, পুরুষের অত্যাচার থেকে দলিত মেয়েদের নিজেকে টিকিয়ে রাখার কৌশল। তামিল ভাষাকে দলিত শরীর, শারীরিকতা, যৌনতা, অপরিমেয় ক্ষুধা, হাড়ভাঙা শ্রম দিয়ে ফিরে লেখেন বামা, বদলে দেন দলিত নারীবাদী ভাষ্যে। লেখেন, নারীর নির্যাতনের অকথিত বয়ান লেখার শক্তি জোগাড় করাটাই ক্ষমতায়ন। দলিত জীবনের যে অবর্ণনীয় ক্লেশের কাহিনি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি, অথচ আজও ঘটে চলছে পৈশাচিক উল্লাসে, তা বলা গেলে গোষ্ঠীর শুশ্রূষা বয়ে আনতে পারে।

অস্পৃশ্য থেকে দলিত। আত্মপরিচয়ের অধিকারের এই সাহিত্য শুরুই হয়েছে ক্ষুধা, শারীরিক পীড়ন, বর্ণ-জাতপাতভিত্তিক মানসিক নির্যাতনের প্রতিলিপি হিসাবে। দলিত পুরুষ লেখকদের আত্মজীবনীতে গদ্যে শ্রমের, ভয়াবহ নিপীড়নের ক্রোধ ও হতাশাময় আখ্যানে বেবি কাম্বলে, ঊর্মিলা পাভার, বামা-রা এনেছেন দলিত নারীর অভিজ্ঞতা। দলিত কবি সুকীর্থারানি তাঁর পাঠ্যসূচি থেকে বাদ আমার জীবন কবিতায় নিজের শরীরকে বলেছেন পাহাড়ের কানা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। যৌন নির্যাতনকারী পুরুষকে লেখেন কৌশলী শিকারি বাঘের প্রতীকে— “রক্তের ছোপ লাগা মুখ ডোবায় নদীতে আর যত সে শিখরের দিকে ওঠে, আগ্নেয়গিরি থেকে ছড়িয়ে পড়ে রক্তমাখা ছাই।”

দলিত, জনজাতির রমণীর উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের, সবর্ণের যৌন নিপীড়নের আখ্যান ছাত্রদের আহত করবে— এই বলে কর্তৃপক্ষ পাঠ্যসূচি শোধনে আটঘাট বেঁধে নেমেছেন। আসলে তা প্রান্তিক গোষ্ঠীর উপর বহু শতাব্দী ধরে নিপীড়নের ইতিহাসকে জনচেতনা থেকে মুছে ফেলার হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ। যা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচেতনায় খাপ খায় না, একমাত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে, তা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের ইতিহাস তৈরির প্রক্রিয়া বলে একে চিনতে যেন ভুল না করি। এটা রাষ্ট্র জুড়ে নেওয়া একটা বড় নকশার ছোট টুকরো। মনে পড়ে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বিচার ছাড়া এখনও বন্দি কবি, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী, অধ্যাপকেরা? সিলেবাসে এই সব পড়লে যদি প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্রের ভূমিকায়? ভীমা কোরেগাঁও তো ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের দলিত প্রতি-আখ্যান— ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বয়ান। মনে পড়ে, ২০১৯-এ সমাজতত্ত্ব বিভাগে নন্দিনী সুন্দরের দ্য বার্নিং ফরেস্ট: ইন্ডিয়াজ় ওয়র ইন বস্তার পাঠ্যসূচিতে থাকা নিয়ে দক্ষিণপন্থী সহকর্মীদের আপত্তি। ২০১১-য় ইতিহাস বিভাগ থেকে বাদ গিয়েছে এ কে রামানুজনের থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণাজ়। যেখানে বলা— রামায়ণের প্রামাণ্য মূল সূত্র নেই, সবই পুনর্কথন, বদলে-বদলে যাওয়া। এ বার পাঠসূচিতে উপনিবেশ-পূর্ব ভারতীয় কোর্সে বাদ চন্দ্রাবতী রামায়ণ, এসেছে তুলসীদাসের রামচরিতমানস। বামা ও সুকীর্থারানির বদলে এসেছেন পণ্ডিতা রমাবাই।

নতুন পাঠ তালিকায় এলে নৈতিক-রাজনৈতিক আপত্তির কথা নয়। জ্ঞানচর্চার মূলে প্রয়োজন চলিষ্ণুতা। তুলসীদাস না পড়লে মধ্যযুগে ভক্তি আন্দোলনের সূত্রে ইতিহাসের বিশেষ অধ্যায়কে জানা যায় না। সেই পাঠের মৌখিকতার মধ্যে দিয়ে কী ভাবে হিন্দিভাষী-বলয়ের সামাজিক মূল সূত্রগুলি তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে আজকের রামভক্তির কোন সম্পর্ক, বোঝা সম্ভব নয় তা-ও। অথবা, মরাঠি রমাবাই ব্রাহ্মণ ও সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন বলেই দলিত-কথ্য বনাম ব্রাহ্মণ-সংস্কৃত যুদ্ধ শুরু হোক, এ-ও কাম্য নয়। ভারতীয় নারীদের মধ্যে রমাবাইয়ের প্রথম পণ্ডিতা হয়ে ওঠা সংস্কৃতের পৌরুষকে শুধু আঘাতই করে না, টডের রাজস্থান বৃত্তান্ত, রাজপুত বীর্য ও সতীদাহের বর্ণনা যখন জাতীয়তাবাদীদের সম্মোহিত করে রেখেছিল, রাজস্থান ঘুরে দেখে রমাবাইয়ের লেখা সতীদাহ ও শিশুকন্যা হত্যাবিরোধী সন্দর্ভ জাতীয়তাবাদের সূত্রকে প্রশ্ন করেছিল।

চন্দ্রাবতী, রমাবাই, সাবিত্রীবাই ফুলে, বামা— সকলেই বিপুল ইতিহাসের অঙ্গ। জাতপাত-ধর্মের নিরিখে এঁদের সামাজিক অবস্থান ভিন্ন, ফলে লড়াইয়ের পটভূমিও আলাদা। রমাবাইয়ের সবর্ণ অবস্থান থেকে দলিত নারীর যৌন নিপীড়নের তীব্রতা ও বাস্তবতা বোঝা সম্ভব নয়। যাঁরা পাঠ্যতালিকা মার্জনে নেমেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য গ্রহণ-বর্জনের খেলায় ভারতীয়ত্ব বলতে একটা একমাত্রিক শোধনবাদী ইতিহাস তৈরি। নারীর অধিকার অর্জনের আন্দোলনকে শুধু সবর্ণ চেতনার গরাদে আটকানো। সবর্ণ নারীবাদকে যদি জনজাতির মহিলার অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে হয়, তবে প্রশ্ন করতে হবে রাষ্ট্রকে, স্বাভাবিক ভাবে চলতে থাকা দলিত ও জনজাতির উপর রাষ্ট্র ও সবর্ণ সমাজের দমন-পীড়নকে। মনে পড়তে পারে, মহারাষ্ট্রের পুলিশ থানায় জনজাতির কিশোরী মথুরার গণধর্ষণের (১৯৭২) প্রতিবাদে দেশে নারীবাদে নারীর উপর যৌন আগ্রাসন বিষয়ক আলোচনা কী ভাবে মোড় নিয়েছিল, মূল অ্যাজেন্ডায় উঠে এসেছিল প্রান্তিক নারীর শারীরিক অধিকারের কথা। নারীকে যৌন নির্যাতন করা হয় তাঁর দলিত বা জনজাতি পরিচয়ের জন্যেও! সাহিত্য এই ইতিহাসকে ধারণ করে। দোপ্দী মেঝেন শুধু মহাশ্বেতার লেখার মধ্যে নেই, তাঁরা আমাদের দেশে অসংখ্য, অগুনতি।

তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

delhi university Mahasweta Devi Dalits
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE