যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্বপ্নদীপ কুন্ডু। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
দক্ষিণ কলকাতার এক উন্নাসিক বেসরকারি কলেজে ক্লাস নিচ্ছি। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। সকালবেলার ক্লাসেও তাদের চোখ লাল। একমুখ ক্লান্তি প্রায় সকলেরই। ওদের থেকেই জানতে পারি, সারা রাত সিনিয়ররা ‘ক্লাস’ নিচ্ছে। কখনও তারাই ‘প্রজেক্ট’ দিচ্ছে। প্রথম এক মাস ‘ডবল শিফট’। তবে নাকি ভবিষ্যৎ জীবনের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরাও মেনে নিচ্ছে। অভিযোগ জানাচ্ছে না। কেউ ভয় পাচ্ছে । কেউ ভাবছে, হয়তো ভালর জন্যেই...।
অথচ এ-ও তো র্যাগিং! খাতায়কলমে যে কলেজ নাকি র্যাগিং এর ক্ষেত্রে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতিতে বিশ্বাসী, সেখানে কেন এমন হবে? ওদের হয়ে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছিলাম, বিষয়টা কেউ র্যাগিং হিসেবে দেখছেনই না। কলেজ কর্তৃপক্ষ দেখছেন না। শিক্ষকেরা দেখছেন না। যাদের সঙ্গে ঘটছে, তারাও র্যাগিং হিসেবে দেখতে গিয়ে ভাবছে, এ আমাদেরই দেখার ভুল। এই কলেজে নাকি শুধুই মেধাচর্চা হয়। এ-ও হয়তো তারই নামান্তর। আহা, মারধর তো হয়নি। যৌন হেনস্থা তো হয়নি। পড়াই তো ধরেছে! তবে?
হ্যাঁ, তবে। হ্যাঁ, তবেও। মুশকিল হল, আমরা নিজেরাই অনেক সময় এমন অনেক আচরণকে উৎসাহ দিয়ে ফেলছি যা আদতে র্যাগিং। যারা করছে, তারাও ভাবছে এ এমন কিছু নয়। যাদের আটকানোর কথা, তারাও ভাবছে, কিছু হয়নি তো কী আটকাব!
স্বপ্নদীপের ঘটনার ভয়াবহতা সামনে আসার পর অনেকে সমাজমাধ্যমে লিখছেন, ‘‘আমাদের সময়েও একটু-আধটু হত। কিন্তু সেগুলো মজার। এত বাড়াবাড়ি ছিল না।’’ এই মানসিকতা বিপজ্জনক। র্যাগিংয়ের ধারাবাহিকতার মূলে আমাদের প্রচ্ছন্ন আশকারা থেকে যাচ্ছে।
র্যাগিং থামাতে হলে আগে বুঝতে হবে র্যাগিং কোনটা। র্যাগিং কোনটাও। এখানে কী করতে বলা হচ্ছে, সেটা বড় কথা নয়। শিক্ষাবর্ষে যারা বড়, তারা দল পাকিয়ে নবাগতদের ওপর জোর খাটাচ্ছে। এটুকুই র্যাগিং হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। র্যাগিং রসবোধ নয়, যে বলব অমুকটা সূক্ষ্ম। এইটা স্থূল। র্যাগিং অন্যায়। র্যাগিং অপরাধ।
কিন্তু কোনও র্যাগিং ব্যাধি নয়। ব্যাধির ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু র্যাগিং করব কি না, সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। কেউ সে তাগিদ আটকায়। কেউ আটকায় না। এটি ক্ষমতার নির্দয় ভাষা, যা আমরা স্বেচ্ছায় অন্যের উপর (আপাতদুর্বল, কম ক্ষমতাসম্পন্ন) কায়েম করে আনন্দ পাই। যে কোনও ভাবে প্রাপ্ত ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অন্যকে এমন কিছু করতে বাধ্য করি, যাতে তার মর্যাদাহানি হবে। লজ্জা করবে। অস্বস্তি হবে। অসম্মান হবে। যে বাংলায় ঝরঝরে নয়, তাকে পাঁচজনের সামনে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়তে বললেও সেটা র্যাগিং।
কখনও সে যা পারে না, তা-ই অন্যের সামনে করে দেখাতে বলা হচ্ছে। কখনও টসটসে যৌনতায় ভরপুর বিবরণী দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। কখনও এমন কোনও কসরত, কেরামতি করে দেখাতে বলা হচ্ছে, যা ঝুঁকিপূর্ণ। উত্তেজনার পারদ চড়ছে। কখন ঝুঁকির হাত ফস্কে যাচ্ছে, জীবন চলে যাচ্ছে, সেই হুঁশ থাকছে না। যখন সম্বিত ফিরছে, তখন আবার দোষ ঢাকার সমবেত প্রস্তুতি চলছে।
সে পুরুষ হয়েও যদি পেলব শান্ত হয়, তবে তাকে ‘যথেষ্ট পৌরুষ’ প্রমাণের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। যে নারীশরীর নিয়ে জন্মেও মনে মনে পুরুষ, তার প্রেমিকার সামনে তাকে পিরিয়ডের তারিখ জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। যে রূপান্তরকামী নারী, তার শরীর যথেষ্ট ‘সুডৌল’ কি না তা নিয়ে মশকরা চলছে।
যারা পরীক্ষা নিচ্ছে, তারাও কিন্তু সব পরীক্ষার ঊর্ধ্বে নেই। দলের মধ্যে থেকেও কারও যদি মনে হয় ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে, তবু সে প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। এদের দল পাকিয়ে থাকতে হয়। এরা দল-বহির্ভূত জীবনকে ভয় পায়। বাকি সহপাঠীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গলা শুকিয়ে আসে। ফলে হয় নীরব দর্শক হয়ে অত্যাচার দেখে। অথবা আমিও কেমন অভিনব পদ্ধতিতে র্যাগিং পারি, সেই প্রদর্শনীতে কলার তোলে। নিজেদের ভয়গুলো পেরোতে এরা অন্যের প্রতি সদলবলে ভয়ানক হয়ে ওঠে। অন্যের পাশে দাঁড়ানোর নামে অন্যকে কার্নিশে ঠেলতে থাকে। অন্যের প্রতি মায়া যদি দুর্বলতা বলে গণ্য হয়? তাতে সে-ও যদি গতে বাঁধা পৌরুষের পরীক্ষায় ফেল করে? পৌরুষের যে সংজ্ঞা মহিমান্বিত হচ্ছে, সেখানে কোমলতার স্থান নেই। কোমলতা থাকলে সে সমকামী পুরুষ কি না, সেই পরীক্ষা চলছে। যে সমকামী, সে বহিরাঙ্গে তুমুল পুরুষ হবে না এই বা কে বলেছে?
এক পুরুষ বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, স্কুলের হস্টেলেও কিছু দিন তার বিনিদ্র রাত কেটেছিল। তার চোখের পাতা দীর্ঘ বলে সিনিয়র দাদারা রাতবিরেতে তাকে জরিপ করতে আসত। যেন সৌন্দর্যের অধিকারও কেবল নারীর। সমলিঙ্গের মধ্যে যৌন হেনস্থার ঘটনা বিরল নয়। এখানে উল্লেখ্য, এটি সমকাম নয়। হেনস্থার কোনও সমকাম বা বিষমকাম হয় না। গোটাটাই অসম-কাম। ক্ষমতার অসাম্য থেকে এক জন অন্যের ওপর চড়াও হয়। আরও যন্ত্রণার কথা, বহু পুরুষ তাদের যৌন হেনস্থার কথা, বিপন্নতার কথা বলে উঠতে পারেন না। সমাজ বিপন্ন পুরুষকেও যদি ‘যথেষ্ট পুরুষ’ না ভাবে? এ সমাজে ভাল মানুষ হওয়ার থেকে ‘তেজি পুরুষ’ হওয়ার মূল্য অনেক বেশি। এমন তেজ যে মায়া, কারুণ্য, প্রেম সব বাপ বাপ করে সেলাম ঠুকবে! র্যাগিং যেন তেমন পুরুষ হয়ে ওঠার অনুশীলন।
এত মেধাবী অথচ এমন হিংস্র? অনেকেই বিস্মিত। অনেকেই তির্যক মন্তব্য করছেন, এই তবে স্বাধীন ভাবনার নমুনা! এই প্রশ্নগুলির মধ্যেও গোলমাল আছে। আমরা অমুক থাকলে তমুকটি থাকবে না ধরে নিচ্ছি কেন? যে মেধাবী সে নিষ্ঠুর হতে পারে না? মেধার প্রতিযোগিতা তো নিজের অবস্থান সুনিশ্চিত করতেই শেখায়। অন্যের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার পাঠ দেয় না তো। আমরা কি একটি শিশুকে আদৌ শেখাই— ‘যা তোমাকে কষ্ট দেয়, তা অন্যকে তুমি ইচ্ছাকৃত ভাবে দিও না?’ শেখাতে গেলে আমাদের ভয় হয়। যদি সে অন্যের হাতে নিগৃহীত হয়? আমরা চাই না আমাদের সন্তান অন্যের থেকে আঘাত পাক। কিন্তু সে-ও যে কাউকে আঘাত দিতে পারে, এ কথা বড় একটা ভাবি না।
যে কোনও ভাবনাই জন্মলগ্নে স্বাধীন। যখন জন্মাচ্ছে সেই মুহূর্তে শিকল পরে নেই। স্বাধীন ভাবনার জন্য কোনও বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয় না। স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠতে পারে একমাত্র প্রয়োগের সময়। ভাবনা স্বাধীন বা অভিনব মানেই সঠিক এমন তো বলা যায় না। যে ভাবনার প্রকাশ অন্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, আমরা তেমন অনেক ভাবনাকে মান্যতা দিয়ে ফেলছি। ‘র্যাগিং তোমাকে সবল বানাবে’— এ-ও এমনই একটি আকাট আত্মপ্রশ্রয়ী ভাবনা।
যারা কলেজে নতুন, তাদের একটি করে ‘দাদা’ লাগবে। দাদাকেই শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে হবে, এ-ও আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা। যারা আসছে তাদের যদি কারও থেকে সাহায্য লাগে, পরামর্শ নিতে হয়, তারা নিজেরা বুঝবে। নবাগত মানেই অসহায় কাণ্ডজ্ঞানহীন কেন ধরে নিচ্ছি? সিনিয়রদের কেন উদ্ধারপ্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে? হচ্ছে, কারণ, স্বঘোষিত অভিভাবক না হতে পারলে তাদের এই প্রতিষ্ঠানে অস্তিত্ব সঙ্কট হয়। গুরুত্ব কমে আসে। এরা কিন্তু সংখ্যায় অনেক। কেউ হস্টেলে থেকে যায়। কেউ ক্যাম্পাসে রোজ টহল দেয়। কেউ ক্যান্টিনে তার চেয়ারে অন্য কেউ বসলে হুজ্জুতি করে। মোটের ওপর এরা কেউ যায় না। যাচ্ছে না।
র্যাগিং আটকাতে গেলে নবাগতকে সুরক্ষিত করতে হবে। কিন্তু যারা পাশ করার পরেও ‘চিরায়ত’ হয়ে রয়ে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। তারা সবাই র্যাগিং করছে এমন নয়। কিন্তু র্যাগিং নিয়ে তাদের মনোভঙ্গি বোঝা প্রয়োজন। তাদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকছে কি না খতিয়ে দেখা দরকার। নিজেদের পুনর্বাসনের কথা না ভেবে অন্যকে শাসন এবং শাসানোর ভূমিকায় পারদর্শী হওয়া সহজ। সেই পথেই স্বনামধন্য হওয়া সহজ। এরা প্রতিষ্ঠানের বাইরে পা রাখতে ভয় পায়। এখানকার হম্বিতম্বি বাইরের পৃথিবীতে পাত্তা পাবেই বা কেন! নিদেনপক্ষে ক্যাম্পাসের মধ্যে তাদের সবাই চেনে। এই আনন্দে এরা তুষ্ট হয়। তুষ্ট থাকে।
ডিগ্রি অর্জনের পর যারা চেনা গণ্ডিতে ক্ষমতা ঝালাই করছে, তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হচ্ছে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy