এত মানুষ, যানবাহন, নিরলস নির্মাণযজ্ঞ, এত নির্বিচার অপরিচ্ছন্নতা, অনিয়ম কেন? যেখানে কলুষিত ক্যানভাসের অপর পারেই স্বর্গ? যেখানে অকাতর দানে উজ্জ্বল প্রকৃতি— সুবর্ণ মেঘপুঞ্জ, পাইনগাছ বেয়ে নেমে আসা কুয়াশার পর্দা! কত দিন শহরটি নিতে পারবে কুৎসিত আর সুন্দরের এই সংঘাত?
দার্জিলিঙের কথা ভাবতে হচ্ছে দার্জিলিঙে বসে। বাঙালির অন্তরে এই শৈলশহর হাজারো স্মৃতি ও আকর্ষণ নিয়ে সতত জমজমাট। সেখানে মেঘের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার খেলা, উৎকৃষ্ট চা-পান, পুরনো স্টুডিয়োর সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া, গ্লেনারি’জ়-কেভেন্টার’স-এর প্রেমে পড়া ফের। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যগুলিকে আবার খুঁজে পাওয়া।
এর বাইরেও আছে আর একটা দার্জিলিং, সেটাই প্রকট হচ্ছে প্রতি বারের দর্শনে। শিউরে উঠতে হয় জনস্রোত দেখে। স্থানীয় বাসিন্দা, ভ্রমণপিপাসু বহিরাগত, নানা কর্মসন্ধানী মানুষ— সবাই মিলে, সব দিক থেকে যেন শহরটির বুক চেপে শেষ শ্বাসটুকু বার করে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দার্জিলিঙে হোটেল হোম-স্টে লজ ইত্যাদি তেরোশোরও বেশি। প্রাক্-কোভিড আমলে বছরে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ পর্যটক আসতেন। এখন সংখ্যাটি ফের এর কাছাকাছি পৌঁছেছে, হয়তো বেশিও হতে পারে।
এর যা ভয়াবহ প্রভাব হতে পারে, তা-ই হচ্ছে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে চকবাজারের রাস্তায় বা রিং রোডে পা ফেলাই যাচ্ছে না। অগুনতি দোকানপাট, হোটেল-রেস্তরাঁ, গাড়ি— সকলেই যেন সূচ্যগ্র মেদিনী না দেওয়ার পণ করেছে। এই কি ‘কুইন অব দ্য হিলস’? অরণ্যের স্বর্গীয় সবুজ এখন অতীত। দার্জিলিং বহু দিন ধরেই ভিড়ের চাপে ক্ষীয়মাণ এক শহর, বাছবিচারহীন নির্মাণের কারখানা। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুঁজতে গেলে দুঃখই পেতে হবে।
চকবাজার ছাড়িয়ে কনভেন্ট রোডের বিচিত্র, শীর্ণকায় গলিতে গেলে বেদনাময় অভিজ্ঞতা হতে বাধ্য। কোনও এক সময়ে এই অঞ্চলটি প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন, গাছে-ঢাকা ছিল। এখন অবাক লাগে, নিত্যযাত্রী কী ভাবে এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেন? দু’দিকের দেওয়াল প্রায় পরস্পরকে ছুঁয়ে আছে, অপরিচ্ছন্নতার কথা নাহয় থাক। বর্জ্যপদার্থ আয়ত্তে আনতে দার্জিলিং পুরসভার নাজেহাল অবস্থা। প্রতি দিন গড়ে ৯০ টনের কাছাকাছি কঠিন বর্জ্যের ভার সামলাতে হয় পুরকর্তাদের।
কী করে প্রকৃতি খুঁজে নেবে তার পুরনো শিকড়? এখনও সুদৃশ্য হিল কার্ট রোড দিয়ে দার্জিলিং পৌঁছে কী দেখা যায়? জীর্ণ, জরাগ্রস্ত একটি শহর। আশির দশক থেকেই শুরু হয়েছে আশপাশের অঞ্চল থেকে দার্জিলিঙে প্রবল জনসমাগম। তারই সঙ্গে চলেছে নিরন্তর ঘরবসত, হোটেল তৈরি। অরণ্য ধ্বংস করে, ভঙ্গুর ভূমির চরিত্র রসাতলে পাঠিয়ে, সব নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বাড়তেই থাকে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে অশোভন ও ক্ষতিকারক ‘বহুতল’ অট্টালিকা নির্মাণ।
পুর নিয়ম অনুসারে এখানে দোতলা, সাড়ে এগারো মিটার উচ্চতার বাড়ি বানানোর কথা, সরকারি ভবন হতে পারে তেরো মিটার। এই সব নিয়ম শুধু খাতায় কলমেই। একটি সমীক্ষামতে, গত বছরেই দার্জিলিং পুরসভা ১৩২টির কাছাকাছি বেআইনি ভবন চিহ্নিত করে যাদের উচ্চতা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে। এখানে পাহাড়ি মাটির চরিত্র আলগা, তাই কাঠের বাড়িই নির্মিত হত অতীতে। ভূমিকম্প, ধস, তুমুল বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা প্রবল, অথচ প্রশস্ত জমির অভাবে এখন নিত্য চলছে আরও উঁচু ঘরবাড়ি, হোটেল, শপিং মল নির্মাণ। দার্জিলিঙের অনন্য স্থাপত্য-ঐতিহ্য তো হারিয়ে যাচ্ছেই, উপরন্তু শহর হয়ে উঠছে অতি-বিপজ্জনক কংক্রিটের জঙ্গল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দার্জিলিং সফরে এসে লিখেছিলেন, “ঊষার আলো শীতকাতর পাখির মতো প্রহরের পর প্রহর চুপ করে সামনের পাহাড়ে বসে আছে, বরফের একটা চূড়া আকাশে ঠেস দিয়ে স্থির হয়ে হারানো সূর্যের ধ্যান করেছে— একটা ঝরনার পাথর তরায়ের জঙ্গলে ছোট একটি নদীর দিকে ঝুকে রয়েছে, আর একটা পাতা-ঝরা শীতের গাছ দেখছে, চুপটি করে— রঙিন প্রজাপতির মতো একদল বাগানের কুলি চা-ক্ষেতে উড়ে বসেছে।” সেই চোখের আরাম, প্রাণের আনন্দ ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে কুদর্শন কাঠামোর শাসনে।
জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, দার্জিলিং-কালিম্পং-কার্শিয়াং এলাকার অন্তত ১৭ শতাংশ স্থানেই ভারী ধসের প্রবণতা। এদের মধ্যে রয়েছে তিনধারিয়া, পাগলা ঝোরা ইত্যাদি। স্থানীয় মানুষেরা উদ্বিগ্ন: জোশীমঠের মতো ভূমিক্ষয়-জনিত সঙ্কটের অপেক্ষায় কি তবে রয়েছে দার্জিলিং? তাঁরা ভুগছেন চূড়ান্ত জলকষ্টেও। গবেষকদের বক্তব্য, এখানে জলের দৈনিক চাহিদা ৭৫ লক্ষ লিটার, অথচ রোজকার সরবরাহ ২৪ লক্ষ লিটার। এপ্রিল থেকে জুন প্রতিদিন প্রায় ১০৫টি ট্রাক তিন-চার বার জল নিয়ে যাতায়াত করে।
ব্যান্ড স্ট্যান্ড, চৌরাস্তা, জলাপাহাড় রোড বা অবজ়ারভেটরি হিলের চৌহদ্দির বাইরে ক্বচিৎ চোখে পড়ে ব্রিটিশ বা তিব্বতি স্থাপত্য, বাগান, লাইব্রেরি, জানলায় রামধনু রঙের কাচ। পরমুহূর্তেই দৃষ্টি আঘাত পায় সিমেন্ট-বালির স্তূপে। অনন্ত গাড়ি চলাচল দেখে মনে হয়, ভঙ্গুর পথগুলি এই বিষম চাপ কত দিন নিতে পারবে? দশ মিনিটের যাত্রাপথ পেরোতে এখন লাগে অন্তত চল্লিশ মিনিট। ঘুম থেকে দার্জিলিঙের দূরত্ব মাত্র সাত কিলোমিটার, পেরোতে কখনও লেগে যায় তিন ঘণ্টা!
কোথায় পালাবে দার্জিলিং? পুরনো বাসিন্দারা বলেন, ব্রিটিশরা শহরটিকে বড় জোর ৫০,০০০ অধিবাসীর জন্য পরিকল্পনা করেছিল, সেই বুঝেই পরিষেবা। সেখানে এখন প্রায় পাঁচ গুণ মানুষ। চারিদিকে রুষ্ট, শ্বাসরুদ্ধ পাহাড়— ‘বজ্রপাতের দেশ’ দেখে অশ্রুপাত করতে ইচ্ছে হয়।
মল রোডের শেষে, সন্ধেয় এক মহিলা তাঁর ভুট্টার পসরা সাজান। খুব জোরে জোরে উনুনে হাওয়া দিচ্ছেন। একটি বালিকা— কন্যাই হবে হয়তো— ভুট্টা ছাড়ায়। হাওয়ায় সুগন্ধ ভেসে আসে। এই মানুষগুলির জন্য, এই গোলাপি গালের, রুক্ষ চুলের বালিকাটির জন্য, এই সুগন্ধি সন্ধ্যার জন্য দার্জিলিংকে বাঁচাতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy