সত্তর দশকে ‘তুকারাম বনাম মহারাষ্ট্র রাজ্য’, স্বাধীন ভারতের প্রথম আলোড়ন সৃষ্টিকারী ধর্ষণের মামলায় নিগৃহীতা জনজাতি মেয়ে মথুরার অভিযোগ বিশ্বাস করেনি দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ১৯৭৯ সালে ধর্ষণে অভিযুক্ত দুই পুলিশ কনস্টেবলকে আদালত মুক্তি দেয় এই যুক্তিতে, যে-হেতু মথুরা যৌন সংসর্গে ‘অভ্যস্ত’ ছিলেন, তিনিই সম্ভবত যৌন মিলনের সূচনা করেছিলেন বা পুলিশ কনস্টেবলদের প্ররোচিত করেছিলেন। এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ভারতে ধর্ষণের বিষয়ে প্রথম বার গণ-প্রতিবাদ হয়, যা ভারতের যৌন নিপীড়ন-সংক্রান্ত আইনের সংস্কারেও একটা বড় মাইলফলক। সাধারণ মানুষ অবগত হতে শুরু করে নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থানগত তারতম্যের ফলে ঘটে চলা লিঙ্গভিত্তিক হিংসা সম্পর্কে, যার মধ্যে বাচিক হিংসা, দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, সবই অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে ধর্ষণকে ব্যক্তিসত্তার উপর চরমতম আঘাতগুলির একটি বলে মনে করা হয়। অথচ, মথুরা ধর্ষণ মামলার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও ধর্ষণের ক্ষেত্রে মেয়েদের দোষারোপের প্রবণতা দূর হয়নি।
সম্প্রতি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের সেমিনার রুমে শিক্ষার্থী-চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত ধর্ষিত মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ার পরেও কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ প্রথমে ধর্ষিতার সেমিনার রুমে রাতে একা থাকাকে দায়ী করেছেন, এই অভিযোগে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সন্দীপবাবু যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে নিগৃহীতাকেই দায়ী করার প্রবণতা সমাজে বিরল নয়। এ ক্ষেত্রে নিগৃহীতা নিজের কর্মক্ষেত্রেই আক্রান্ত, কিন্তু স্থান-কাল-পাত্রভেদে ধর্ষিতার উপর দায় আরোপের প্রবণতাও বাড়ে। বহু ক্ষেত্রেই ধর্ষিতাকে দোষারোপ করা হয়— যদি তাঁরা ধর্ষণের সময়ে আক্রমণের শুরুতেই যথেষ্ট প্রতিরোধ না করে পরের দিকে করেন। অর্থাৎ, ভয় বা অসহায়তার জন্যও, শারীরিক প্রতিরোধের যথেষ্ট প্রমাণ দিতে না পারলে মেয়েটির উপরেই দায় বর্তায় আক্রমণকারীকে পরোক্ষ প্রশ্রয়দানের। আবার অনেক সময়, কোনও পুরুষের সঙ্গে স্বেচ্ছায় দেখা করতে গিয়ে ধর্ষিত হলেও (ডেট রেপ) এমন একটা গতানুগতিক ধারণা কাজ করে যে, ধর্ষিতা যৌন সংসর্গ চেয়েছেন বলেই ডেট-এ গিয়েছিলেন।
‘বিকাশ গর্গ বনাম হরিয়ানা রাজ্য’ (২০১৭) মামলায় আদালত নিগৃহীতার ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস, তাঁর হস্টেলের ঘরে কন্ডোমের প্যাকেট থাকার মতো তথ্যগুলিতে জোর দিয়েছিল। নিগৃহীতাকে ‘অশ্লীল মনোভাব’-এর জন্য দায়ী করে ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেলিংয়ে অভিযুক্তদের জামিন দেওয়া হয়। ২০২২-এ কেরলের দায়রা আদালত যৌন হয়রানির মামলায় অভিযুক্ত লেখক সিভিক চন্দ্রানকে জামিন দেওয়ার সময় বলে, অভিযোগকারিণীর পোশাক যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করার মতো হওয়ায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪ ধারা (যা এক জন নারীর শালীনতা ক্ষুণ্ণ করাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে) প্রয়োগ করা যাবে না। এই বক্তব্য হাই কোর্টে খারিজ হয়ে গেলেও, নারীর পোশাকের ‘শালীনতা’র ভিত্তিতে তাঁর সম্মতিকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট।
গত বছর পকসো আইনে এক মামলার রায় দেওয়ার পর কলকাতা হাই কোর্ট কিশোরী মেয়েদের উদ্দেশে এক নির্দেশিকায় বলেছিল, নিজের শরীরের মর্যাদা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা, নিজের ‘মূল্য’ রক্ষা করা, এবং ‘দু’মিনিটের সুখ’-এর আকর্ষণে তৈরি হওয়া যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা প্রত্যেক কিশোরীর কর্তব্য। তা না হলে সামাজিক দৃষ্টিতে তাকে পরাজিত মনে করা হবে। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এই নির্দেশিকা অপ্রাসঙ্গিক ও অনধিকার চর্চা বলে খারিজ করে দেয়।
ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থার ঘটনায় প্রায়ই অপরাধীর আগে পরীক্ষা দিতে হয় নিগৃহীতাকে: তাঁর আচরণ, বেশভূষা, জীবনযাপন নির্দিষ্ট সামাজিক মাপকাঠি মেনে চলেছে কি না। ২০২২-এ বেঙ্গালুরুতে বছর বাইশের এক তরুণীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে এক জন অ্যাপ-বাইক চালক ও তার বন্ধুকে গ্রেফতার করার ঘটনায় জনমত ছিল দ্বিধাবিভক্ত। যে-হেতু নিগৃহীতা তাঁর বন্ধুর বাড়িতে পার্টিতে গিয়েছিলেন, মদ্যপান করেছিলেন এবং অন্য এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে রাত ১২.৪৫ নাগাদ একটি অ্যাপ-বাইক বুক করেছিলেন, সমাজমাধ্যমের একাংশ মেয়েটির নৈতিক চরিত্র ও রাতে বাড়ির বাইরে থাকাকেই দোষারোপ করে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে ধর্ষকরাও মনে করে তাদের কাজের জন্য ধর্ষিতাই দায়ী, বা ‘বিশেষ ধরনের মেয়েদের শিক্ষা দিতে’ ধর্ষণ ভুল কিছু নয়।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-এ দেশ জুড়ে নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনা ৩১,৫১৬টি, অর্থাৎ প্রতি ১৬ মিনিটে একটি। প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি, কারণ সামাজিক ও ধর্মীয় কলঙ্কের ভয়ে, পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রত্যাখ্যানের উদ্বেগে অনেক ধর্ষিতাই অভিযোগ জানান না। আইনি ন্যায় পেতে গেলেও দীর্ঘমেয়াদি তদন্ত ও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। আদালতে পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকলে ন্যায়বিচার না-ও মিলতে পারে, কিন্তু সামাজিক ভাবে তাঁদের ‘নৈতিক চরিত্র’ ও মানসিকতার চুলচেরা বিচার হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। এমনকি আদালতের রায়ের পরেও অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে, ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর পরেও, নীতিপুলিশির শিকার হতে হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে নিজের দেহের উপর ও যৌন সম্মতি (বা অসম্মতি) জানানোর মৌলিক মানবাধিকারই প্রধান বিবেচ্য, তা চাপা পড়ে যায়।
এই পরিস্থিতির মূলে সর্বব্যাপী পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, যা নারীদের সমস্ত পরিস্থিতিতেই দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় বলে গণ্য করে, তাঁদের সুরক্ষার নামে আসলে এক ধরনের অধীনতার বেড়ি পরিয়ে রাখতে চায়। এর বাইরে বেরোনো নারী যৌনহিংসার শিকার হলে তার দায় বর্তায় তাঁর উপরেই। অনেক নারীকেও ভাবতে বাধ্য করা হয়, পুরুষপ্রধান সমাজ-পরিসরে তাঁরা সর্বদাই অনিরাপদ। তাই তাঁরই দায় ‘ঠিক’ পোশাক পরে, ‘ঠিক’ সময়ে বাড়ি ফিরে, পারিবারিক ও সামাজিক যৌন নিয়ন্ত্রণের অধীন থেকে নিজের ‘সতীত্ব’ প্রমাণ করে চলার, যাতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁকে ‘রক্ষা’র যোগ্য মনে করে। কঠোর আইন প্রণয়ন এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন তৃণমূল স্তর থেকে যৌনসম্মতি ও লিঙ্গবৈষম্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, নিরন্তর সামাজিক প্রচার, লিঙ্গ-সংবেদনশীলতার পাঠ।
এই অনুশীলন সমাজে একেবারে নেই তা নয়। মথুরা ধর্ষণ মামলা পুনরায় চালু করা এবং ধর্ষণ আইনে সংশোধনীর দাবিতে ১৯৮০-তে হয়েছিল দেশব্যাপী ধর্ষণবিরোধী গণপ্রতিবাদ। আর জি করের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলায় স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনের মতোই, ২০১২-র দিল্লিতে নির্ভয়া কাণ্ডও দেশব্যাপী বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যার ফলে যৌনহিংসা বিষয়ক আইন কঠোরতর করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত যৌনহিংসার ঘটনায় জনরোষ সব ক্ষেত্রে এক রকম নয়। মেয়েটির ‘নৈতিক চরিত্র’, জাতি, শ্রেণি, সম্প্রদায় অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের সৃষ্টি করে। বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও শিশুহত্যার কাণ্ডে আদালতে দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের সরকারি সুপারিশে স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি দেওয়া, কাশ্মীরে কাঠুয়া বালিকার গণধর্ষণ ও হত্যা, মণিপুরের দাঙ্গায় নারী নির্যাতন, উত্তরপ্রদেশের উন্নাও ও হাথরসে দলিত মহিলাদের উপর যৌনহিংসার ঘটনার পরেও প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ থেকেছে মুষ্টিমেয় অংশে। জাতীয় কুস্তি সংস্থার বিতর্কিত প্রধানের বিরুদ্ধে বহু যৌন হেনস্থার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগিরদের আন্দোলন শুনেছে কদর্য বক্রোক্তি, হুমকি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে মেয়েদের রাত দখল ছিল এক অনন্য পদক্ষেপ। রাতে বাইরে বেরোনো নিয়ে সামাজিক রক্ষণশীলতাকে প্রশ্ন করে হাজার হাজার মেয়ে রাতের জনপরিসরের উপর তাঁদের অধিকার জানিয়েছেন। তার এক সপ্তাহের মধ্যেই রাজ্য সরকার রাতে কর্মরত মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অ্যাপ ও একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণার পাশাপাশি নিদান দিল, সম্ভব হলে রাতের শিফটে মেয়েদের কাজ না দেওয়ার। রাত-দিন নির্বিশেষে সামাজিক পরিসরে নারীর সমান মর্যাদা, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, সামাজিক মনস্তত্ত্ব বদলানোয় কতটা পথ চলা এখনও বাকি, বোঝা যায় এ থেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy