অতিমারি শুরুর আড়াই বছর পরে মে মাসের গোড়ায় প্রকাশিত হাউ টু প্রিভেন্ট দ্য নেক্সট প্যানডেমিক নামের একটি বই সকলের নজর কাড়ে। বিল গেটস অবশ্য এ রকম বই প্রথম বার লিখছেন না; গত বছর লিখেছিলেন হাউ টু অ্যাভয়েড আ ক্লাইমেট ডিজ়াস্টার। নিন্দুকেরা বলবেন, জলবায়ু বা অতিমারি কোনওটার বিষয়েই লেখকের বিশেষ কিছু বলার নেই; বই দু’টিতে আলোচিত তত্ত্ব বা প্রণয়নযোগ্য নীতি সবই আগে বলা-শোনা-চেনা— ধনীরা তাঁদের খাবার টেবিলে বসে কিঞ্চিৎ মদিরাচ্ছন্ন অবস্থায় পৃথিবী জুড়ে গরিবদের দুর্দশা নিয়ে যা আলোচনা করেন, প্রায় সেই পর্যায়ের।
তবে, গেটস-কে কিছু কৃতিত্ব দেওয়াই চলে। কোভিড ব্যাপারটাই আড়াই বছরের এক কেসস্টাডি, তাতে তথ্যভিত্তিক কিছু অনুমান করা যায় বড় জোর, কোনও বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন। অতএব, এই রকম খানকতক প্ল্যান বুলেট পয়েন্ট হিসেবে সাজিয়ে দেখা যেতেই পারে।
প্রথমেই আসে টিকা। এই কোভিড ‘বাজারে’ হারাধনের একটি তত্ত্বই বেঁচে গেছে— টিকাতে কাজ দেয়, দিয়েছেও। সংক্রমিত বা হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যায় তা পুরোপুরি প্রমাণ না হলেও, টিকাকরণের ফলে মৃত্যুর হার যে একদম তলানিতে ঠেকেছে, সেটা আজ সর্বজনগ্রাহ্য। যেমন, ইংল্যান্ডে কয়েক মাস আগের তৃতীয় ঢেউয়ের সময় প্রতি দিন প্রায় দু’-লাখ সংক্রমিত হলেও দৈনিক মৃতের সংখ্যা ‘মাত্র’ আড়াইশো; তুলনায়, গত বছরের দ্বিতীয় ঢেউতে যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। তবু, কথা থেকে যায়। এক, আবিষ্কৃত এক ধরনের টিকাই আপাতত যথেষ্ট, এখনও অবধি কোভিডের সব রূপেরই মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। এই আপাত সাফল্যে উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই; আজকে হয়তো, সৌভাগ্যে ভর করেই, ওমিক্রনের বিএ-৪, বিএ-৫’এর বিরুদ্ধে সহজ জয় এল, কিন্তু আগামী দিনের মিউট্যান্টের জন্য অন্য দাওয়াই লাগতে পারে। নতুন টিকা তৈরি না হলে আবার ২০২০’র সেই সব দিন ফিরে আসবে। দুই, পুরনো টিকা চললেও, প্রতি বছর অন্তত এক বার সকলকে টিকা নিতে হবে। অতএব, দরকার টিকা উৎপাদন ও বিতরণ।
গেটসের আগামী দিনের প্ল্যান তাই— ‘উন্নত, সহজলভ্য’ টিকার ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে, দরিদ্র দেশগুলির জন্য। কী ভাবে? করবেই বা কে? তাই, টিকার পরে দু’নম্বরে আসে টাকা। গেটসের পরামর্শ, বিশ্ব জুড়ে একটা ‘গ্লোবাল প্যানডেমিক প্রিভেনশন টিম’ গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য এককালীন বিনিয়োগ হিসাবে এক বিলিয়ন পাউন্ড (ভারতীয় টাকায়, এক-এর পিঠে এগারোটা শূন্য) ঢালতে হবে।
এ বার প্রশ্ন, এই কাজে গৌরী সেন-কে পাব কোথায়? গেটসের সদুত্তর বেশ রাবীন্দ্রিক— “আমার ভাণ্ডার আছে ভরে তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে।” পরের প্রশ্ন, ধনী দেশগুলি কেন দেবে? এই কথাটা এক বছর ধরেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র কর্তারা বলছেন, আগে পৃথিবীর সবাইকে এক বার টিকা দেওয়া হোক, তার পর নাহয় ‘বুস্টার’-এর কথা ভাবা যাবে, ধনী দেশগুলোর ভাঁড়ারে জমা সব টিকা তুলে এনে গরিব দেশে বিলিয়ে দাও।
এ-হেন মাতুল-গৃহের আবদার বাজারি অর্থনীতিতে চলে না। আফ্রিকাবাসীরা এখনও টিকান্ধকারে, ইংরেজরা ত্রিটিকাকৃত। বরিস জনসনের সমালোচনা করা সহজ, কিন্তু মানতেই হবে, গত বছর আগুন লাগছে বুঝেই ঝড়ের গতিতে তিনি দেশবাসীকে টিকা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া, কোভিডের টিকা আবিষ্কারের গবেষণার জন্যই সাহস দেখিয়ে তখন বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছিল বিলেতের সরকার, সেই বিনিয়োগের সুফল তারা ঘরে তুলছে এখন। ওদের দোষ দেওয়া যায় না; ইংল্যান্ড অনৈতিক কিছু করেনি, উল্টে বিশ্ববাসীর তাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত, ভাগ্যিস তারা অক্সফোর্ডের গবেষণায় আগাম বিনিয়োগ করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল।
হু-র পরামর্শ মতো গরিব দেশকে এখন দান করলেও তো লজ্জা-মুক্ত হওয়া যায়। না, সেটাও হয় না। বাজারি মডেলের গোড়াতেই বৈষম্য; চাহিদা, জোগান মিলেই না তবে ধনতান্ত্রিক ইকুইলিব্রিয়াম! সাম্যবাদ, নৈতিকতা ইত্যাদি শুনতেই ভাল; কিন্তু, নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ কেন দান করবেন?
তবে, কোভিডের টিকার সাম্য আর ধনের সাম্য আলাদা। ‘সবাই খেতে পাক’ আর ‘সবাই টিকা পাক’ তো তুলনীয় নয়। কারণ, ভ্যাকসিনের গল্পে বড় যুক্তি হিসেবে একটা ঋণাত্মক বহিঃপ্রভাব, (নেগেটিভ এক্সটার্নালিটি) জড়িয়ে আছে। টিকা-অসাম্যের আঁচ নিজের গায়েও লাগে; গরিব দেশ টিকা না পেলে, ভাইরাসের বিষ ধনীর দেশেও ছড়াতে পারে।
এক্সটার্নালিটির ক্ষেত্রে বাজারি অর্থনীতি ব্যক্তিগত স্তরে মূল্য ধরে দেওয়ার কথা বলে, যার গালভরা নাম, ইনসেন্টিভ। আপনি আপনার মুখ ঢাকা দিলে, আপনার লাভ তো হবেই, তবে তাতে বেশি লাভ হবে অন্যদের। অতএব, মাস্ক পরার পরিবর্তে আপনাকে পয়সা দিতেও সমাজ বা সরকার রাজি হবে: এটাই আধুনিক অর্থনীতির তত্ত্ব। তাই, মলে ঢোকার আগে সুপার মার্কেটের বিক্রেতা আমার-আপনার মতো ক্রেতার হাতে বিনামূল্যে মাস্ক আর স্যানিটাইজ়ার বিতরণ করেছেন। গত বছর, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টিকা নিতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকার তাদের নাগরিকদের নানা সুযোগসুবিধা ঘোষণা করেছিল। এই ইনসেন্টিভের গল্পকে সহজেই দেশের স্তরে নিয়ে আসা যায়। গরিব দেশরা টিকা না পেলে আবার হয়তো লকডাউন হবে সর্বত্রই। তাতে ধনী দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবে।
এই বিশ্বব্যাপী প্রহসনে তবে ভরসা শুধু, ধনীদের ভাতে মারার ভয় দেখানো। সমস্যাটা সবার; বাজার দিয়ে হবে না— সেটাও এত দিনে বোঝা গিয়েছে।
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy