প্রাণিত: মল্লিকার্জুন খড়্গের বাড়িতে বিরোধী নেতৃবৃন্দের বৈঠক, দিল্লি, ৫ জুন। ছবি: পিটিআই।
আগে কখনও ‘হার’ ও ‘জিত’-এর এমন বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেখেছি কি? এক দল মানুষ জিতেও জয়টাকে ঠিকমতো উদ্যাপন করতে পারছে না, কেমন বাধো-বাধো ঠেকছে, যেন জিতেও হেরে গেছে! আর এক দল জিততে পারেনি ঠিকই, কিন্তু সেটা বোঝা যাচ্ছে না, সহাস্য মুখে একে অন্যকে আলিঙ্গন করছে, হাত মেলাচ্ছে, হাসি-মশকরাও চলছে ইতিউতি, যেন ‘হেরে’ও আসলে জিতে গেছে!
৪ জুন বিকেলে যখন বোঝা গেল, এই বার শাসক জোট ‘৪০০ পার’ তো দূরে থাক, ৩০০-ও পার হতে পারছে না, যদিও দেশের সরকার গড়ার জাদু সংখ্যা (২৭২) তারা পার হতে পেরেছে, অথচ শাসক জোটের প্রধান দলটি (বিজেপি) সেই জাদু সংখ্যার চেয়ে বত্রিশটি আসন নীচে! ফলত, এত দিন দূরবিন দিয়েও দেখতে না পাওয়া মাঝারি-ছোট-অণু জোট সঙ্গীদের কাঁধে ভর করেই এ বার ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ যত দূর যাওয়া যায় যেতে হবে— এই শীতল, কিছুটা ভয়াল অনুভূতিই কেন্দ্রের শাসক শিবিরে ছেয়ে ছিল।
পুরনো শাসক জোটসঙ্গীদের প্রাণেও উল্লাস নেই, তারা কেমন হকচকিয়ে গেছে! কারণ, নবলব্ধ গুরুত্ব, মসনদে রাজার সঙ্গে সম-পঙ্ক্তিতে বসার গৌরব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার বনেদি অভ্যাস তাদের নেই। সেটা যাঁদের আছে, সেই ঘোড়েল দুই মহাপুরুষ নেতা— যাঁরা জীবনে এমন অনেক জোটের সার্কাসে ট্র্যাপিজ় খেলে নাম কামিয়েছেন— বিহার আর অন্ধ্রপ্রদেশের সেই নেতাদ্বয় নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবুকে পর দিন (৫ জুন) দেখা গেল, কঠিন মুখে, চেষ্টিত হাসি নিয়ে চন্দ্রাকার টেবিলে নরেন্দ্র মোদীর পাশে বসে আছেন, আর এই দৃশ্যের পাশে টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে তাঁদের একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দাবি! কঠিন দরাদরিতে সিদ্ধহস্ত চন্দ্রবাবু। নীতীশও কম যান না, সামান্য সংখ্যক বিধায়ক/সাংসদ নিয়ে কী করে ক্ষমতার সঙ্গে ভিড়ে থাকতে হয়, ইনি সেই খেলার মহাগুরু, যাঁকে তাঁর রাজ্যের বিচ্ছুরা ‘পাল্টুরাম’ অভিধা দিয়েছে। চন্দ্রবাবুর চেয়ে সংখ্যায় সামান্য খাটো, তিনিও হেঁকে বসেছিলেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট পদ। অন্য জোটসঙ্গীদের পকেট থেকেও তালিকা বেরিয়েছিল, দেখা গেল অঙ্গুলিমেয় ‘সিটওয়ালা’রা তো বটেই, এমনকি এক সাংসদ-বিশিষ্ট দলগুলিও ‘ক্যাবিনেট’ চাইছে!
ক্ষমতায় টিকে থাকার এই ‘ফান্দে পড়িয়া’ শ্রীমোদী, যিনি তাঁর শাসক জীবনে শুরু থেকেই মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিপুল দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, ছোটখাটো রাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা থাক, ক্যাবিনেট সতীর্থদেরও পাত্তা না দিয়ে, নিজেকে ‘একক’ শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে দল বা জোটের নামে নয়, সরকার পরিচিত হয় তাঁরই নামে (মোদী সরকার) বা সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রচারিত হয় ‘মোদী কি গ্যারান্টি’ বলে, সেই মানুষ কি পারবেন, তাঁর পূর্বসূরি অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো সর্বংসহা হয়ে ‘আয় তবে’ বলে ‘হাতে হাতে’ ধরে শরিকদের সঙ্গে (তাদের নানা বায়নাক্কা নিয়ত সামলে) ঘুরে ঘুরে ‘নাচতে’?
সেই মানসিকতা বা প্রশিক্ষণ কোনওটাই তাঁর নেই। ফলে, যে ভাবে উচ্ছ্বাসহীন কূটনৈতিক চুক্তি সম্পাদনের মতোই একে অন্যকে ‘মাপতে মাপতে’ শরিককুল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা-জ্ঞাপন করলেন, তাতে মোদীজি পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পের নিতাইবাবুর মতোই ভাবতে পারেন, ‘চিত্তে সুখ নেই দাদা’। অথবা, বাঙালির প্রাণের কবি-র একটা গানও মনে মনে গুনগুন করতে পারেন— ‘জয় ক’রে তবু ভয় কেন তোর
যায় না’!
একই দিনে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে-র বাড়িতে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মিটিংয়ের ছবিটা অন্য মেজাজের, যেন অনেক দিন পর স্কুল-কলেজের বন্ধুদের কোনও পুনর্মিলন উৎসব! নানা দলের নানা প্রতিনিধি, লন-এর বারান্দায় ‘আমরা সবাই রাজা’-র স্টাইলে এক সারিতে দাঁড়িয়ে যে ভাবে সংবাদমাধ্যমের জন্য ‘ফটো-মুহূর্ত’ তৈরি করলেন, তাতে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, ভয় নয়। এটাই কি তা হলে ভয় ও ঘৃণার পাল্টা রাহুল গান্ধী-কথিত ‘ভালবাসার দোকান’? চিরদিন হয়তো এই দৃশ্য দেখা যাবে না, তবুও ‘হারতে হারতে জেতা’ এই ‘বাজিগর’-এর দল এই দিন, বহু দিন পরে ভারতে এক ভয়মুক্ত, স্বতঃস্ফূর্ত রাজনীতির উন্মোচন করলেন, যা ছড়িয়ে পড়ল ভারতের সর্বত্র, রাজনীতির বাইরের সাধারণ মানুষজনের মনেও। যেমনটা সাতচল্লিশ বছর আগের (১৯৭৭) এক মার্চ মাসে ঘটেছিল, ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী পরাজয় ও উনিশ মাসের অমারাত্রি-সম ‘জরুরি অবস্থা’র অবসানে।
সরকারি ভাবে ঘোষিত না হলেও, গত কয়েক বছর ধীরে ধীরে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের দ্বৈত দাপটে যে শাসন ভারতকে প্রশ্নহীন একমাত্রিকতার আনুগত্যে বাঁধতে চেয়েছিল, তাকে অনেকেই অঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’ মনে করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় মানুষ সংবিধান প্রদত্ত (ধারা ১৯) সব ধরনের স্বাধীনতার অধিকার হারিয়েছিল, বিরোধী দলগুলির প্রায় সব বড় নেতা, স্বাধীন মতাবলম্বী সাংবাদিক বা প্রতিবাদী জনগণকে জেলে পোরা হয়েছিল। কিন্তু একটা জিনিস সে দিনও হয়নি। যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বাস করা, বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মসম্প্রদায়, বহু অঞ্চল, বহু সংস্কৃতি তথা বহু খাদ্যাভ্যাসে বিভক্ত ভারতবাসীর বহুত্ব ও বৈচিত্র বিনাশ করে তাকে এক ভাষা-এক সংস্কৃতি ও এক সর্বময় নেতৃত্বের খাঁচায় পোরার চেষ্টা হয়নি। সর্বোপরি, ধর্মীয় পরিচয়ের নিরিখে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলিমদের এমন ভাবে লড়িয়ে দেওয়া হয়নি।
এর জন্য এক দিকে তথ্যপ্রযুক্তির নানা কৃৎকৌশল অবলম্বন করে, মিশেল ফুকো বর্ণিত সর্বদ্রষ্টা নিরীক্ষকের মতো— প্রতিটি মানুষ-বিষয়ক সব তথ্য— পছন্দ ও অপছন্দ, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মতামত জেনে নিয়ে ‘পক্ষ’-‘বিপক্ষ’ নির্ণয় করে ‘সমাজমাধ্যম’-এ মতপ্রকাশের ‘অপরাধ’-এ, ‘শহুরে নকশাল’, ‘খলিস্তানি’ বা ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সংগঠিত ট্রোল বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়, যাতে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি গালাগালির স্রোতে অপমানিত হয়ে বা তাদের হুমকিতে ভয় পেয়ে ‘নীরব’ হয়ে যায়। অন্য দিকে, ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অর্ধসত্য, এমনকি সম্পূর্ণ ‘মিথ্যা’র মিশ্রণ ঘটিয়ে এক ‘উত্তর-সত্য বাস্তবতা’ নির্মাণ করে সমাজমাধ্যমে, বিশেষত হোয়াটসঅ্যাপ-এ নানা গোষ্ঠীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেও কাজে লাগানো হয়ে থাকে।
এই ভাবে পছন্দমতো উত্তর-সত্য ‘জ্ঞান’ এক ফোন থেকে অন্য ফোনে বণ্টিত হতে হতে একটি ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’ নির্মিত হয়েছে, যেখানে কোনও প্রশ্ন করা যায় না, খালি একতরফা শুনে যেতে বা পড়ে যেতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, এই ধরনের ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’-লব্ধ জ্ঞান কেন্দ্রের শাসক দলের মতাদর্শগত স্বার্থসাধন করে। এদের প্রভাব শরীরের চেয়েও ‘মন’-এর উপরেই পড়ে। এক সময় লেখাপড়া করে অর্জিত জ্ঞান সম্পর্কেও সংশয় জাগে। এদের সব সময় একটি ঘোষিত শত্রুপক্ষ থাকে— ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজবাদ এদের কাছে প্রায় গালাগালির সমান। ফলে, স্বাধীনতা আন্দোলনে (যেখানে এই মতাবলম্বী দলগুলির যোগদান প্রায় ছিল না) আত্মত্যাগ করা কোনও শ্রদ্ধেয় নেতা যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সমাজবাদ, বৈজ্ঞানিক মানসিকতার সমর্থক হন, তবে ‘বিকৃত ইতিহাস’-এর মাধ্যমে প্রায়শ তাঁদের বাপ-বাপান্ত করে তাঁদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে হাঁপিয়ে ওঠা জনতা যদি, সর্বময় কর্তাটির বর্তমান অস্বস্তিতে কিছু দিনের জন্যও একটু মানসিক শান্তি ফিরে পায়, তবে সেটাই ক্ষমতায় না এসেও বিরোধী রাজনীতির কৃতিত্ব বইকি!
এদের পাশাপাশি, এক শ্রেণির বৃহৎ সংবাদমাধ্যমও যে ভাবে শাসকপক্ষের জন্য ‘জনমত’ গড়ে তোলার দায়িত্ব (সরকারি বেতার-টিভির চেয়েও) কাঁধে তুলে নিয়েছে, তার থেকেও হয়তো সাময়িক মুক্তি মিলবে। আশা করা যায়, বেশ কিছু দিন ইডি, সিবিআইয়ের মতো সংস্থা পক্ষপাত ছেড়ে, ‘দুর্নীতি’র তল্লাশিতে শাসক-বিরোধী তফাত করবে না। আরও আশা, আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ে মানুষ ‘খোলামেলা’ কথাবার্তার/সংলাপের এক নতুন ‘গণ-পরিসর’ উন্মোচন করবে, যা থেকে সরকার তার নীতি নির্ধারণ করবে। অনেকে বলবেন, এ সবই আসলে ‘ছলনাময়ী’ আশা, কোনওদিন বাস্তবে ঘটবে না। তা হোক। আমাদের মতো ‘চাষা’রা তো চিরকাল আশায় ভর করেই বেঁচেছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy