অতুলের চোখের জল শুকোয়নি তখনও। বললাম, “গোর দিয়ে এলি?” বলল, “হ্যাঁ, ও লাশ তো পোড়াতে পারবনি, বাঘে খেয়েছে।” থমকে বললাম, “তোর ভাই না?” জানাল, ওরা খেলতে গিয়েছিল তিপলিঘেরি বাজার মাঠে। সেখান থেকে মধু কাটতে চোরাই পথে জঙ্গলে। সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে ফেরত আনা লাশ পোড়ালেই জানাজানি হবে। ফরেস্ট ধরবে। বলবে, নিশ্চয়ই বাঘকে জখম করে লাশ ফেরানো হয়েছে, অতএব জেল। আইন এড়াতে জঙ্গল-চোরের লাশ চরের মাটিতে গোর দেওয়া হয়। কি হিন্দু, কি মুসলিম।
ভাবছিলাম, এই সংঘাত ঠিক কিসের? যখন একই স্থান বা সংস্থানের অধিকার নিয়ে দুই সমকক্ষের মতপার্থক্য হয়, তখনই সংঘাত বাধে। মানব-বন্যপ্রাণ সংঘাতে তা নেই। এই বহু ব্যবহৃত শব্দবন্ধের একটা অব্যবহৃত দিক আছে, যা একান্তই পলিটিক্যাল ইকোলজি বা রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্রের বিষয়। তা আমরা আদপেই বুঝি না। সুন্দরবন দিয়েই শুরু করি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জঙ্গল হাসিল কবে থেকেই চলছে। ভারত বা বাংলাদেশ— উন্নয়নের কলরবে জঙ্গল প্রতি দিন ছোট হয়ে আসছে। মানুষে-মানুষে সংঘাতে বাঁচতে গেলে জঙ্গলে পা রাখতেই হবে। তা হলে কি মানুষই বাঘের ঘরে ঢুকে পড়ছে, আর বলছে: বাঘে কামড়ে দিল কেন? না, তা-ও ঠিক নয়। সদ্যোজাত শাবককে মুখে করে বাঘিনি ঢুকে পড়ে ধানখেতে, অন্য বাঘের মুখ থেকে তাদের বাঁচাতে, বিশেষ করে শাবক যদি পুরুষ হয়। সংঘাত সেখানেও। কিন্তু কে আগে বাঘের সঙ্গে সেলফি তুলবে, সেটাই মূল চিন্তা হলে আসল খবর উঠে আসে না। নগর ও গ্রামীণ জীবনের প্রকট প্রভেদ এবং সেই জনিত অজ্ঞতাও এই সংঘাতের বড় কারণ। বলা যায়, শহুরে পশুপ্রেমীর শ্যেনদৃষ্টি বনাম গরিব জেলের পেটের জ্বালা— দুইয়ের ভিতর আর্থ-সামাজিক সমন্বয় না থাকলে কী করে সংঘাত মিটবে? বিকল্প জীবিকা, সচেতনতা, তালিম, নীতিমালা কোথায়? ১৯৭২-এর বন্যপ্রাণ আইনের আওতায় থাকা ৯৯টি পার্ক, ৫১৫টি অভয়ারণ্য, ৪৩টি সংরক্ষিত অঞ্চলের বাইরেও আছে এক বিপুল সাম্রাজ্য, যেখানে বন্যপ্রাণ থাকলেও আইন নেই।
যেমন, অরুণাচলের পাক্কে ব্যাঘ্র প্রকল্পে হাতির চরম উপদ্রব। কিমাশ্চর্যম্! ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকার বাইরে যে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে, সেগুলো পড়েছে হাতির যাতায়াত-পথে। আর, গ্রামের চাষজমি পড়ে রয়েছে জঙ্গলেই। স্থানীয় মানুষ না পারেন নতুন জায়গায় ফসল ফলাতে, না পারেন আইনের চোখ টপকে জঙ্গলে ঢুকতে। যদি বলি সবটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? ব্যাঘ্র প্রকল্পে অর্থ, জিপগাড়ি, সাহায্য এসেছে, বদলে পাওয়া গিয়েছে সস্তার শ্রমিক। ঘরছাড়া, জমিহারা ও জনজাতির মানুষেরা ন্যূনতম পারিশ্রমিক, যা ‘অনুকম্পা’ নয়, সেই অধিকারের কথা জানেনও না। তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যে পরিকল্পনা করা হল, তাতেও কি বাঁচল বন্যপ্রাণ? কলকাতাতেই প্রতি বছর প্রায় কোটি টাকার বন্যপ্রাণ চোরাচালান হয়, পশুপ্রেমীরা হদিসও রাখেন না। শহুরে পশুপ্রেম সবটাই উপর উপর— ‘কসমেটিক’।
আবার, যাঁরা মানব-বন্যপ্রাণ সংঘাতের ন্যায্যমূল্যটি বোঝেন, বাঘ-হাতির দলিল-দস্তাবেজও তৈরি রাখেন, তাঁরা জানেন কী করে ফরেস্টের বাবুদের সঙ্গে আঁতাঁত করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হয়। জানেন কমিশনটুকুও। ফরেস্ট বেহাল— নেই লোকবল, হাতিয়ার, প্রশিক্ষিত রক্ষী; আছে আক্ষেপ। কেন্দ্র-রাজ্য খেয়োখেয়ি, আইনের ফাঁকফোকর, বড়কর্তাদের চোখরাঙানির মধ্যে কারও প্রাণ না যায়, এটুকু খেয়াল রাখাই তাই কর্তব্য। অগত্যা, পঞ্চায়েতের সাহায্যে ১০০ দিনের কাজে বড় খাল কাটা হয়, গ্রামে হাতি ঢোকা ঠেকাতে। কিন্তু সংঘাত বা সমস্যা কি তাতে মেটে? দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলে এমন খালের মাঝখানে এখনও বন্দি একটি হাতির দল। মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, বন্দিদশায় স্বভাব-আচরণও পাল্টে গিয়েছে। সুতরাং, আরও বেড়েছে সংঘাত।
ও দিকে, আমরা হাতি আর বাঘেই আটকে আছি; যাকে বলে ‘বিগ ফাইভ’— বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডার, বাইসন। এরাই সংঘাতের মুখ্য চরিত্র না কি? ওড়িশার ভিতরকণিকার ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ভোর রাতে শৌচকর্ম করতে গিয়ে কত মেয়ের যে বুনো শুয়োরের গুঁতোয় উদর ও জরায়ু ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, তা হিসেব করা কঠিন। আসলে, ১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইন আজও চলছে, এ দিকে বন্যপ্রাণের সংজ্ঞাও ঠিক করে তৈরি হয়নি। যেমন, সাপ বন্যপ্রাণী নয়, কারণ তার কামড়ে ক্ষতিপূরণ নেই। শিকার উৎসবে বুনো শুয়োর এক-আধটা মারা চলে, কিন্তু তারা গুঁতিয়ে দিলে ক্ষতিপূরণ নেই। ক্ষতিপূরণ দিতে সরকার ইচ্ছুকও নয়, আস্ত জঙ্গলের বন্যপ্রাণের হিসেব ওলটপালট হলেও পরোয়া নেই।
আসলে, সবই দেখা হয় রাষ্ট্রের সুবিধা-অসুবিধার প্রেক্ষিতে। তাই আইন হয়। তাতে পরিবেশ, ভোট, বাজেট বা মনুষ্যস্বভাব গুরুত্বও পায়। কিন্তু সমস্যা হল, এ ভাবে ফি বছর গড়ে ১,২৩,০০০ মানব-বন্যপ্রাণ সংঘাত অনুপুঙ্খ ভাবে নথিভুক্ত করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না আমাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy