আবু জ়াফর মল্লিক, বয়স ৪৫, দেগঙ্গার কালিয়ানি গ্রামের বাসিন্দা। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। কারণ? সিলিকোসিস। পাথর গুঁড়ো করার কাজে, ‘স্টোন ক্রাশার’ যন্ত্রে বা তার কাছাকাছি যাঁরা কাজ করেন, নিশ্বাসের সঙ্গে সিলিকার গুঁড়ো ঢুকে তাঁদের ফুসফুসকে ধ্বংস করে দেয়। এ রোগের চিকিৎসা নেই, তিলে তিলে মৃত্যুই ভবিতব্য। আবু জ়াফরের অক্সিজেন কেনারও সামর্থ্য নেই, চিকিৎসা তো দূরের কথা।
পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত, বৈধ স্টোন ক্রাশারের বাইরে অবৈধ ভাবে কাজ করছে বহু যন্ত্র। আনুমানিক পাঁচশো থেকে হাজার স্টোন ক্রাশার আছে, অন্তত সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষ সিলিকোসিসের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। এ রাজ্যে পাথর শিল্পের শুরু সেই ষাটের দশকে। কিন্তু কর্মরত অসংগঠিত শ্রমিকদের সমীক্ষা কখনও হয়নি। সিলিকোসিসের প্রকোপ কিছুটা আন্দাজ করা যায় সংবাদ থেকে। শুধু উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেই সাতশোর উপর সম্ভাব্য সিলিকোসিস আক্রান্তের খবর মিলেছে, পঞ্চাশের বেশি মৃত্যুর খবর জানা গিয়েছে। একটি প্রধান সমস্যা রোগের নির্ণয়। আন্দোলনের চাপে পড়ে রাজ্য সরকার বিনামূল্যে বুকের এক্স রে তোলানোর ব্যবস্থা করলেও সেই প্লেটের বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা করিয়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য সময় লেগে যাচ্ছে এক-দু’বছর। যার মধ্যে এই মানুষগুলোর বিপন্নতা বাড়ছে, কেউ কেউ মারাই যাচ্ছেন সরকারের সাহায্য বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই।
আশার খবর যে, বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য সিলিকোসিস রোগ নির্ণয়ের একটি নতুন পরীক্ষাপদ্ধতি বা ‘কিট’ আবিষ্কার করেছেন। এর নেপথ্যে রয়েছেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী, শ্যামসুন্দর নন্দী। পুরুলিয়ার হুড়ার বড়গ্রামের ছেলে শ্যামসুন্দর এখন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি-র মুম্বই ইউনিটের সহ-অধিকর্তা। এই কিট রক্তের প্লাজ়মার মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন (সিসি১৬) মাপতে পারে, ও তার উপর নির্ভর করে রোগীর ফুসফুস কতটা আক্রান্ত হয়েছে তার প্রাথমিক ধারণা দিতে পারে। তাতে ইঙ্গিত মিলবে যে, রোগী সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন কি না। চূড়ান্ত নির্ণয়ের জন্য অবশ্য বুকের এক্স রে করাতেই হবে।
সরকার চাইলে এই কিটটি সস্তায় কেনার ও সহজে প্রয়োগের ব্যবস্থা হতে পারে। তবে তেমন উদ্যোগ সরকার করবে কি? এই রোগের প্রতি সরকারি অবহেলার ইতিহাস দীর্ঘ। ‘সিলিকোসিস-আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি’ আন্দোলন করছে চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে। অনেকগুলি ট্রেড ইউনিয়ন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ-সহ কয়েকটি গণ সংগঠন জোট বেঁধেছে। কলকাতা হাই কোর্ট ও মানবাধিকার কমিশনে একাধিক মামলাও হয়েছে। মিনাখাঁ এলাকায় ৪৬ জন জীবিত ও মৃতের পরিবার ক্ষতিপূরণও পেয়েছে। কিন্তু হরিয়ানা বা রাজস্থান সিলিকোসিস আক্রান্তদের পুনর্বাসন-ক্ষতিপূরণের জন্য নির্দিষ্ট নীতি তৈরি করেছে, যা পশ্চিমবঙ্গ এখনও করেনি। যদিও নীতি তৈরির নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট ও মানবাধিকার কমিশন।
আপাতত বাংলার শ্রমিকের যেটুকু আছে, তা হল সরকারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত সিলিকোসিস বোর্ড, এবং রাজ্য বাজেটে সিলিকোসিস প্রতিরোধের জন্য কিছু বরাদ্দ। চলতি আর্থিক বছরে সাত কোটি টাকা মিলেছে। প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকু? অন্তত পাথর খাদান এলাকাগুলিতে ব্লক স্তরের সরকারি হাসপাতালে যথেষ্ট শক্তিসম্পন্ন (৩০০ মিলি অ্যাম্পিয়ার বা তার বেশি) এক্স রে মেশিন বসানো দরকার, কারণ আক্রান্তদের কিছু দিন অন্তর এক্স রে করাতে হয়। বিনামূল্যে অক্সিজেন, ইনহেলার ও অন্যান্য ওষুধের জোগানও দরকার। এই কাজগুলোও হচ্ছে না। আক্রান্তদের পরিবারের খোঁজ নেওয়াও তাই এখন এক বিষম বিড়ম্বনা। প্রশাসনের আধিকারিকরা অনেকেই চেষ্টা করেন, কিন্তু নীতির অভাবে তাঁদেরও হাত-পা বাঁধা।
অন্য দিকে, বেআইনি কারখানাগুলোকে শ্রম সুরক্ষা বিধি মানতে বাধ্য করবে কে? অবৈধ স্টোন ক্রাশারের মালিকরা বেগতিক বুঝলেই দ্রুত নামধাম বদলে নতুন আর একটা বেআইনি দোকান সাজিয়ে বসেন। সরকার ও জেলা প্রশাসনের কড়া হস্তক্ষেপ ছাড়া এই অন্যায় আটকানো অসম্ভব।
বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনের সুফল যদি রাজ্যের শ্রমিকদের পেতে হয়, তা হলে সিলিকোসিস পরীক্ষার কিট প্রয়োগ করে নিয়মিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে বাধ্য করতে হবে পাথর শিল্প মালিকদের। এই কিটের সুফল পেলে আবু জ়াফরের রোগ হয়তো মারণ রূপ নিতে পারত না।
সেই সঙ্গে রাজ্য দূষণ পর্ষদকেও খাদান এলাকার দূষণ নিয়মিত মাপার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু কর্মরত শ্রমিক নন, এলাকার সাধারণ বাসিন্দাও যেন সিলিকোসিসের শিকার না হন, তা দেখা দরকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিলিকোসিস প্রতিরোধ, এবং তার চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করবে, এটাই এখন কয়েক লক্ষ শ্রমিকের আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy