সম্প্রতি জানা গেল বৃহত্তর কলকাতার একাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার জাতীয় লিগ-তালিকায় বেশ কয়েক ধাপ এগিয়েছে। গর্বিত হওয়ার কারণ আছে বইকি। তবে অনেকের মতে, এ জাতীয় কোনও তালিকা থেকে শিক্ষাকেন্দ্রের উৎকর্ষ-বৃদ্ধির বিশেষ কোনও প্রমাণ মেলে না। এটা ঠিক যে, এই ধরনের তালিকা সম্পর্কে সংশয়ী হওয়ার নানা কারণ আছে। যেমন, প্রথমত, কী ভাবে তালিকা তৈরি হবে, কী কী বিষয় মাপা হবে, সেটাই যথেষ্ট বিতর্কিত। পরের প্রশ্ন হল, কোনও গুণ বিবেচনার জন্য সূচকটাই বা কী? যেমন, গবেষণার সূচক যদি শুধুই প্রকাশিত সন্দর্ভ বা গবেষণাপত্রের সংখ্যার সমানুপাতিক হয়, তবে তো মুড়ি-মুড়কি এক দর— তখন সংখ্যা বাড়ানোটাই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। আবার, তালিকার ভিন্ন ভিন্ন খাতে স্কোর বাড়াতে একই কুমিরছানাকে বারংবার তুলে ধরা যেতে পারে।
তবু, গোটা দুনিয়াতেই এমন তালিকা তৈরি হয়। বিশেষত, সরকারের টাকা যেখানে উচ্চশিক্ষায় ব্যয় হয় বেশি, সেখানেই সরকার চায় উন্নতির খতিয়ান। আর তাই আসে র্যাঙ্কিং। কর্মসূত্রে বিলেতের আয়োজনের সঙ্গে আমি বেশি পরিচিত; এখানেও কিছুটা একই গল্প— নানান তালিকা; কোনওটা সরকারের তৈরি, কোনওটা সংবাদমাধ্যমের। মোটের উপর সর্বজনগ্রাহ্য হলেও নাক সিঁটকানোর অনেক অবকাশই আছে। তবে, ইংল্যান্ডে শিক্ষাজগতের লোকের কোদালকে কোদাল বলার সাহস ও সুযোগ তুলনায় বেশি, ফলে সকলেই মেনে নেন আলোচনা-লব্ধ সূচকগুলো। এ কথাও ঠিক যে, খুব নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না।
তালিকার আগে স্থির হয় বিষয় ও সূচক; নানা আঙ্গিকে মেপে র্যাঙ্কিং তৈরি হয়। শুধু পড়াশোনার গুণমান নয়, এতে অন্তর্ভুক্ত হয় নানা বিষয়— যেমন, কোন বিভাগের কোন ডিগ্রির পরে কেমন চাকরি মেলে, তাতে মাইনেই বা কত; আবার, বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলোর সুযোগসুবিধা কেমন, এমনকি ক্যান্টিনে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতা কী রকম, এগুলোও বিচার করা হয়। ভারতের তালিকাতেও অবশ্য আজকাল ছাত্রছাত্রীদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিবেচিত হয়।
ইংল্যান্ডে আর একটা সূচক থাকে, যা নিয়ে একটু আলাদা ভাবে বলা দরকার। সেটা হল ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভে’ বা এনএসএস-এর স্কোর। নিরপেক্ষ একটি সংস্থা জাতীয় স্তরে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সমীক্ষা করে; নানা প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া নম্বরের ভিত্তিতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগকে এনএসএস স্কোর দেওয়া হয়। সমীক্ষার ফর্মেই ছাত্রছাত্রীরা, পরিচয় গোপন রেখে, তাদের মতামত খোলাখুলি লিখতে পারে— তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাঠানো হয়।
সমীক্ষাটা তো বাধ্যতামূলক নয়, সব ছাত্রছাত্রী তাই ফর্ম হাতে দিলেও পূরণ করে না; তাদের নিষ্ক্রিয়তাকে সাধারণত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বলেই ধরে নেওয়া হয়। আবার, এমন একটা ধারণাও আছে যে, খারাপ অভিজ্ঞতাই যে হেতু মানুষ বেশি মনে রাখে, তাই যে সব ছাত্রছাত্রী মনঃক্ষুণ্ণ, তারাই শুধু এই সমীক্ষায় নিজেদের গায়ের ঝাল মেটায়।
তবে এনএসএস-কে অগ্রাহ্য করার বিলাসিতা বিলেতে কেউই করে না। শুধু ভাল এনএসএস স্কোর পাওয়ার তাগিদেই নয়, ছাত্রছাত্রীদের কথা শোনার, মতামত জানার ও তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে সকলেরই; তার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপও করা হয় প্রতি বছর— তা সে যত বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন।
আর এখানেই বিদেশের সঙ্গে ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রদান পদ্ধতির বিস্তর ফারাক। ভারতে, বিশেষত আমাদের রাজ্যে, মহানগরী কলকাতার অবস্থান বিলেতের বিপরীত মেরুতে। ছাত্রদের মতামত সচরাচর নেওয়া হয় না; আমরা ওদের মত জানতেই চাই না, ওদের কথা শুনতে চাই না। আজকাল গালভরা ‘কোর্স ইভ্যালুইয়েশন’ বা পাঠ্যক্রম মূল্যায়ন চালু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু, এখনও কলকাতার কোনও অধ্যাপককে বলতে শুনিনি যে, তিনি ছাত্রদের মতামতকে আদৌ গুরুত্ব দেন।
এর অন্যতম কারণ, অহেতুক আত্মগরিমা। ভাবটা হল— আমি পঁচিশ বছর ধরে দেশ-বিদেশে গেম থিয়োরি পড়াচ্ছি, আজ আমি কী পড়াব সেটা একটা উনিশ বছরের মেয়ে, বা আমার অর্ধেক-বয়সি সহকর্মী আমাকে বলে দেবে? আমার মুখের উপর কে কথা বলবে, আর বললে শুনবই বা কেন?
তর্কসাপেক্ষে যদি ধরেও নিই যে, আমার পড়ানো অতুলনীয়, আমার কোর্সের সবই ভাল, কিছুই বদলানোর নেই— তবু অন্যের মতামত নেওয়া যে দরকার, সেটা আমাদের মাথায় ঢোকে না। আমাদের হয়তো কোনও খামতিই নেই, তবুও, সব ঠিকঠাক চললেও, দ্বিমুখী কথোপকথন প্রয়োজন। আমার থেকে শিখছে ওরা; ওদের থেকেও আমি শিখতে পারি। এটাই কাম্য।
তার বদলে, আমরা অপেক্ষা করি দুর্দিনের; যে দিন বুঝতে পারব যে, ছাত্ররা কিছুই শেখেনি। সে দিন নিশ্চিত ভাবেই দোষটা তাদের ঘাড়েই চাপাব, তেমন বেয়াড়া হলে বাবা-মা’দের ডেকে পাঠাব কলেজে, তবু ওদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব না।
আমরা ভুলে যাই আমাদের কলেজ-পড়ুয়ারা প্রাপ্তবয়স্ক; এরা আমাদের ‘কাস্টমার’ও বটে। অতএব, তাদের ‘কেয়ার’ নেওয়াটা আমাদেরই কাজ; বাবা, মা’র নয়, সরকারেরও নয়— যদিও পরোক্ষে বাবা-মা’র করের টাকায় সরকার আমাদের কলেজ চালাচ্ছে।
আমাদের কাছে ওরা পড়তে আসবে যদি ওদের ভাল লাগে তা হলেই, নচেৎ নয়। আমাদের সময় এসেছে, ধনতন্ত্রের এই প্রথম পাঠটা নেওয়ার। এই চিন্তা থেকেই আমেরিকাতে লিবারাল আর্টস কলেজের পাঠ্যক্রম গড়ে ওঠে। সেই ব্যবস্থায়, নিজেদের কোর্স আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মতো শিক্ষকদের ‘বিক্রি’ করতে হয়; তাই, ছাত্রছাত্রীদের মতামত নিতেই হয়।
ভারতের শিক্ষাজীবীরা ছাত্র-রাজনীতি, ঘেরাও, সব কিছু মেনে নিয়েই বেঁচে থাকি, বাধ্য হয়েই। চলছে চলুক, তবু আমরা ওদের মুখোমুখি বসব না, ওদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব না, ওদের কথা শুনব না, এমন গোঁ নিয়েই আমাদের অধ্যাপনার জগৎ।
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy