Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
R G Kar Medical College And Hospital Incident

কেমন আছেন মেয়ে ডাক্তাররা

এনএইচএস-এর এই মহিলা-চিকিৎসকদের নিয়ে একটি সমীক্ষা ২০২২-এ শুরু হয়, ২০২৩-এ তার ফল প্রকাশিত হয়। যে তথ্যগুলি সামনে আসে তা একাধারে বিস্ময় ও বিমর্ষতা জাগায়।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৪ ০৪:২১
Share: Save:

হাসপাতালে, চিকিৎসার কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, ধর্ষণের আতঙ্ক শুধু একটি ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনীতি অ-রাজনীতি বা দলীয় তন্ত্রের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে, বৃহত্তর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিষয়। সেই প্রশ্নটিও শুধুমাত্র নিরাপত্তার কি? যদি তা-ই হয়, তবে আরও অসংখ্য প্রশ্ন উঠে আসে। আর যদি কোনও একটি জীবিকার নিরাপত্তার কথা ওঠে, তবে সেই জীবিকার নিরাপত্তার অভাবের কারণকে কোনও একটি ঘটনা, একটি দল, এক জন অপরাধীকে অতিক্রম করে দেখা প্রয়োজন।

২০২৩-এ ইংল্যান্ডে ‘উইমেন ইন সার্জারি’ নামে একটি সংস্থা চেষ্টা করে তাদের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সংস্থার (এনএইচএস) অধীনে মহিলা চিকিৎসকরা কেমন আছেন তা জানার। ভারতের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেকটাই ইংল্যান্ডের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ধরনে তৈরি— বড় ও মাঝারি হাসপাতাল এবং অসংখ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে তৈরি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ভাবে অনুন্নত জায়গায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে পরিষেবা দেওয়ার এই ব্যবস্থা।

একই ভাবে, সরকারি পরিষেবার অধীনে মহিলা ও পুরুষ-চিকিৎসকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য: ১,৯৬,০০০ পুরুষ-চিকিৎসক এবং ১,৮০,০০০ মহিলা-চিকিৎসক। এনএইচএস-এর এই মহিলা-চিকিৎসকদের নিয়ে একটি সমীক্ষা ২০২২-এ শুরু হয়, ২০২৩-এ তার ফল প্রকাশিত হয়। যে তথ্যগুলি সামনে আসে তা একাধারে বিস্ময় ও বিমর্ষতা জাগায়। দেখা যায়, ৭০% মহিলা-ডাক্তার কর্মক্ষেত্রে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হন। ৮৯.৫% মহিলা-ডাক্তার কর্মক্ষেত্রে যৌন ভাবে অনিরাপদ বোধ করেন; এবং সহকর্মী, রোগী বা অন্য পুরুষ কর্মচারীদের দ্বারা কোনও না কোনও যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন। ৩১% মহিলা-ডাক্তার, অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচার চলাকালীন যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন।

সার্জারি চলাকালীন যৌন হেনস্থার এই তথ্যের কারণে এর নাম হয়, উইমেন ইন সার্জারি। রিপোর্ট প্রকাশের পরে স্বাভাবিক ভাবেই অসংখ্য প্রশ্নের মুখে পড়ে এনএইচএস। তৎক্ষণাৎ হেল্পলাইনও খোলা হয়। এর আগেও অভিযোগ জানানোর একটি কেন্দ্র ছিল, সেখানে বছরে অভিযোগ জমা পড়ত গড়ে ৩৫,৬০০। কিন্তু কার্যত কোনও প্রতিকার হত না। ২০১৮ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ২৪৮টি ধর্ষণের অভিযোগ আনেন এনএইচএস-এর মহিলা-ডাক্তাররা, জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিলে। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

উইমেন ইন সার্জারি-র রিপোর্টটি প্রস্তুত করেন অ্যামি ওটকের। তিনি তুলে আনেন আমেরিকার তথ্যও, উল্লেখ করেন ১৯৯৮-এ করা প্রথম সমীক্ষার কথা। তাতে দেখা গিয়েছিল, ৫৮.৭% মহিলা-ডাক্তার যৌন অসম্মানের শিকার হন। ২০১৬-য় আমেরিকায় আবারও সমীক্ষা হয়। মিশিগান মেডিক্যাল স্কুলের রেশমা জাগসি দেখান, প্রায় দুই দশক পেরোনো সত্ত্বেও শতাংশের হিসাব উন্নত হয়নি। এই সমীক্ষাও দেখায়, ৭০% মহিলা-চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার শিকার, কখনও সহকর্মী বা উচ্চপদস্থ ডাক্তারদের দ্বারা, কখনও হাসপাতালের অন্য কর্মচারীদের, কখনও রোগীদের দ্বারা। ৩০% মহিলা-ডাক্তার যৌন অত্যাচারের শিকার হন কর্মক্ষেত্রে। ২০২৪-এ মিশিগান ইউনিভার্সিটির গবেষক এলেনা ফ্র্যাঙ্ক ৪,৫০০ ডাক্তারের ভিত্তিতে করা সমীক্ষায় দেখেন, ইন্টার্ন থাকাকালীন, চাকরির প্রথম বর্ষের মধ্যে গুরুতর যৌন হেনস্থার শিকার হন ৫৫% মহিলা-ডাক্তার।

আর, ভারতে? হাসপাতালে যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে অরুণা শানবাগের নাম। অরুণার ঘটনা ভারতে মহিলা-চিকিৎসকদের অ-নিরাপত্তার চালচিত্রের একটি অংশ মাত্র। ২০১৫-র ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর সমীক্ষা দেখায়, ৭৫% মহিলা-ডাক্তার হাসপাতালে কর্মরত থাকাকালীন যৌন হেনস্থার সম্মুখীন হন। ২০০৬-এ এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা দেখায়, কলকাতার হাসপাতালে ১৩৫ জনের মধ্যে ৭৭ জন মহিলা-ডাক্তার যৌন লাঞ্ছনার শিকার।

এই তথ্যগুলি সামনে আনার কারণ এই নয় যে, কলকাতার সাম্প্রতিক ঘটনাটির প্রেক্ষিত কম গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকতাকে গুরুত্ব দিলে কোনও বিশেষ ঘটনা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু শিকড়, সমস্যা, সমাধান যে একটি বিষয়ের সমাধানে, এক জন অপরাধীর শাস্তির মধ্যে নেই, এ কথা আরও বেশি মনে করা দরকার।

নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্রের বিভেদ ও আগ্রাসন কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার তথ্য ও গবেষণা অপ্রতুল নয়। প্রতি বছর ভারতে‌ ৪৪৫ জন মহিলা কর্মক্ষেত্রে ধর্ষিতা হন। ৮০০টির বেশি যৌন হেনস্থার অভিযোগ করা হয় প্রত্যেক বছর। কিন্তু যে চিকিৎসকদের উপর আমাদের নির্ভর করতেই হয়, তারও অভ্যন্তরে লুকিয়ে এমন রাক্ষুসে মনোবৃত্তি? যে চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীদের সামনে আমাদের অকপট হতেই হয়, তাঁদের একাংশের মানসিকতা এমন? তবে কি চিকিৎসকদের আমরা আর সেই চোখে দেখতে পারব না, যেমনটা দেখতে চাই?

এই সাধারণীকরণ হয়তো ঠিক নয়। আবার উপরের ওই হিসাবও তো মিথ্যা নয়। ৭৫% মহিলা-চিকিৎসক সহকর্মীদের যৌন হেনস্থা, এমনকি ধর্ষণেরও শিকার হন, সেবা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে অত্যাচারিত হন— এর প্রতিকার চেয়ে আমরা জমায়েত, মিছিল করব না?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy