সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
বড় মসজিদের শিউলি গাছটায় ফুল ফোটা শুরু হলেই বুঝতাম, ‘তাঁর’ আসার আর বেশি দেরি নেই। ভান্ডারদহ এবং কাপাসডাঙা বিলে শালুক, পদ্ম ফুটতে শুরু করত হরিমতি বালিকা বিদ্যালয়ে পুজোর ছুটি পড়ার কিছু দিন আগে থেকেই। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত ছিল ইস্কুলটি। মুসলমান ছাত্রীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। যে সব মুসলমান মেয়ে দশম শ্রেণি ছুঁয়ে ফেলত, খুঁজলে তাদের বাড়িতে বিষাদ-সিন্ধু গ্রন্থটির পাশাপাশি শরৎচন্দ্র বা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসও পাওয়া যেত।
টুপি, দাড়ি, পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ, এগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নইলে মণ্ডপ বাঁধার বাঁশ মোল্লাদের বাঁশঝাড় থেকে যায়! বিল থেকে পুজোর জন্য পদ্ম তুলে আনত মুসলমান ছেলেপিলের দল। যারা মাছ ধরতে যেত, তারাও মনে করে হেলা (ডাঁটা) সমেত পদ্ম তুলে আনত। বেগুনবাড়ির মোড়লরা তাঁদের বিশাল চাতালে দুর্গাপুজো উপলক্ষে মেলার আয়োজন করতেন। মুসলমানপ্রধান এলাকা, মেলায় বেশির ভাগ দোকান বসাতেন মুসলমানরাই। দানাদার, জিলিপি, চিনির সাদা গজা, পাঁপড়, ছোলা-বাদাম ভাজা, এগুলোই বেশি বিক্রি হত। আর বিক্রি হত ঘুগনি। মুসলমান ঘুগনি বিক্রেতা পাকুড় পাতায় ঘুগনি পরিবেশন করতেন, সঙ্গে তালপাতার চামচ।
প্রকৃতির সঙ্গে ধর্মীয় উৎসবের এমন নিপুণ বোঝাপড়া আর কোথাও দেখিনি। ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেবে না, এমন কেউ ছিল না গ্রামে তখন। ইব্রাহিম, শওকত গাছের ঝুনো নারকেল জমিয়ে রাখত পুজোর জন্য। চট্টোপাধ্যায়রা কিনে নিয়ে যেতেন। মুসলমানের গাছের নারকেল সৌদামিনী পিসির হাতে যখন নাড়ু হয়ে উঠত, তখন সেই নাড়ু হয়ে যেত বিজয়ার মিষ্টি। সৌদামিনী পিসির প্রতিবেশী আর জ্ঞাতিগুষ্টিরাই কেবল নাড়ু খেত না, পেতলের টিফিনবক্সে সেই নাড়ু ভরে ইব্রাহিম, শওকতদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন পিসি। কোনও বার সে নিয়মের অন্যথা হত না।
ভাগীরথী নদীর দু’পাশ জুড়ে কাশবনের উল্লাস তখন। গ্রামের কবরস্থানগুলো কাশবনে ঢাকা পড়ত। শরতের মেঘ তত দিনে আকাশের গায়ে ছবি আঁকতে শুরু করে দিয়েছে। উঠোনে শিউলির আলপনা, আর খালে-বিলে ফুটতে থাকা শাপলা ও পদ্মদের দেখে বুঝে যেতাম পুজোর ছুটির দিন এগিয়ে আসছে।
যে সব গোঁড়া মুসলমান অভিভাবক ছেলেমেয়েদের বলতেন, ‘ঠাকুরের দিকে চাইবা না, পেসাদ খাবা না’, তাঁরাও কিন্তু পুজোর মেলায় যেতে বাধা দিতেন না। নাগরদোলা চড়ার জন্য অথবা মাকড়সা-কন্যাকে দেখার জন্য পয়সাও দিতেন। অবশ্য, ‘ঠাকুরের দিকে চাইবা না’-র বারণ মুসলমান মেয়েরা ছাই শুনত! মাথায় ওড়না দিয়ে চোখ বুজে দুর্গাঠাকুরের কাছে আম্মুর জ্বর সারিয়ে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করত। আব্বুর গরম মাথা যাতে একটু শান্ত হয়, সে বায়নাও দেবীর কাছে জমা পড়ত। বসিরচাচা দেখতে পেলে আব্বুর কাছে নালিশ করবে, এমন একটা আতঙ্ক খচখচ করত। কোন বাড়ির মেয়ে, সেটা বসিরচাচা ভাল করে ঠাহর করার আগেই মেয়ে দেবীদর্শন করে ফেলত।
গ্রামের পুজোয় আড়ম্বর না থাকলেও আন্তরিকতা ছিল পুরোমাত্রায়। ডাকের সাজে সজ্জিত দেবীমূর্তির মুখের স্নিগ্ধতা আচ্ছন্ন করে রাখত হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই। পুজোর ওই ক’টা দিন নিয়ম করে সকলেই দেবীদর্শনে যেতেন। পুজো প্যান্ডেলের আশেপাশে ধুনো-গুগগুলের গন্ধের উপরে আতরের প্রলেপ পড়ত। তাতে কোনও বিরোধ দেখা দিত না।
আর ছিল গান। বাংলা গান। গানে গানে এক জনের মনের সঙ্গে আর এক জনের মন অনায়াসেই জুড়ে যেত। “আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও/ আমি চিরদিন তোমারই তো থাকব,” এই গানটা যত ক্ষণ চলত, মুখোপাধ্যায় বাড়ির মেজো ছেলে তাকিয়ে থাকত লায়লার দিকে। লায়লার হয়ে উত্তর দিয়ে দিতেন কিশোর এবং লতা: “আজ হৃদয়ে ভালবেসে, লিখে দিলে নাম তুমি এসে।” ঢাকের বাদ্যি, আলোর রোশনাই, ধূপধুনোর গন্ধ সব মণ্ডপের কাছে জমা রেখে গ্রামের আলো-অন্ধকার রাস্তা ধরে লায়লা যখন বাড়ির পথে হাঁটত, ভেসে আসা মধুমঞ্জরি আর শিউলি ফুলের সুগন্ধে উৎসবের আর একটি দিক উন্মোচিত হত। ক্ষীণ সুর শোনা যেত: “তুমি ছাড়া আর কোনও কিছু ভাল লাগে না আমার... কী লিখি তোমায়!” লায়লা ভাবত, জীবন কি এতটাই সুন্দর, না কি এ সব শরতের ম্যাজিক! না কি দুর্গাপুজোর! অন্ধকার আর একটু ঘনিয়ে এলে মগরিবের আজান ভেসে আসত পুকুরের ও পারের মসজিদ থেকে। ওই সময়টুকুতে ঢাকের আওয়াজ থেমে যেত। বন্ধ হয়ে যেত বক্সের গান। আজান শেষ হলেই আবার বেজে উঠত গান, ঢাকের বাদ্যি।
লায়লা জানত, দশমীতে পদ্মপুকুরের বিসর্জনে উপস্থিত থাকবে ‘সে’। তার সঙ্গে দেখা হবে না জেনেও মনে মনে বলত, “আল্লা সব কিছু যেন ভালয় ভালয় মিটে যায়!” আল্লা সব দিকে নজর রাখতেন বলেই বোধ হয় দশমীর দিন তেমন কোনও অশান্তি বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত না।
তবে সে বার সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন মসজিদের ইমামসাহেব। দশমীর দু’দিন পরে ভাঙাচোরা শূন্য মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে একগাদা লোককে সাক্ষী রেখে বলেছিলেন, “বেটিটা চলে গেল! খুব ফাঁকা লাগছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy