অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বেনারস হিন্দু কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হয় মূলত দেওয়ানি আইনের শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে। আইনের পাশাপাশি দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্রের চর্চাও হত। ওই প্রতিষ্ঠান দু’টি এখন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার তাদের পোষণ করে, যদিও মাদ্রাসা সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত। সম্প্রতি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি-তে স্নাতকোত্তর স্তরে একটি স্বতন্ত্র বিষয় পড়ানো হচ্ছে: হিন্দু ধর্ম। সাধারণ বিচারে এতে আপত্তির কিছু নেই। এই দেশে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের চর্চা বহু কাল ধরেই হয়— সম্রাট আকবরের সময় থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ পর্যন্ত সেই ধারা বহমান। বিভিন্ন ধর্মের দর্শনও পড়ানো হয় নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
ভারতীয় দর্শনের প্রধান বিন্দু হল পূর্বপক্ষ ও সিদ্ধান্তীর যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি। একটি শাখায় যিনি সিদ্ধান্তী, অন্য শাখায় তিনি পূর্বপক্ষ এবং সমালোচিত। এটিই ভারতের ঐতিহ্য। ‘হিন্দু ধর্ম’ নামে যে স্নাতকোত্তর কোর্সটি চালু হল, তাতে রয়েছে ১৬টি পেপার। হিন্দু ধর্মের আচার, রীতিনীতি, মন্ত্রের মাহাত্ম্য প্রভৃতি পড়ানো হবে সেখানে। হিন্দু ধর্মকে একরৈখিক ধারায় ফেলে তার বৈচিত্র নষ্ট করা হচ্ছে, এমন কথা উঠতেই পারে, যেখানে কপিল মুনির মতো নিরীশ্বরবাদীদের স্থান নেই। হিন্দু ধর্মের নানা শাখা, কেউ অদ্বৈতের পূজারি, কেউ বা দ্বৈতবাদী; অদ্বৈতেরও নানা রূপ, দ্বৈত ও বহুত্ববাদীরও নানা আকার। শৈব ও মধ্বরা পরস্পরকে নাস্তিক বলে গালি দিতেন, এই নাস্তিকতা নিয়েও আছে বহু মত। ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও কেউ আস্তিক হতে পারেন, আবার ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও কেউ নাস্তিকতার শিরোপা পেয়ে থাকেন। হিন্দু ধর্মের সেই বহুরৈখিক ধারা আলোচ্য কোর্সে নেই। চার সিমেস্টারে বিভক্ত এই কোর্সে ইতিমধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৪৫ জন। এক কর্মকর্তা জানান, ১০০ বছর ধরে এই ‘একরৈখিক’ পাঠদানের কথা ভেবে আজ তাঁরা সফল হয়েছেন। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে আরএসএস-এর পতাকা সরানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন প্রশাসনিক কর্তা বরখাস্ত হয়েছেন কিছু দিন আগে।
পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয় হল ব্রাহ্মণ্যবাদ, যাকে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ও ‘যৌক্তিক’ ভাবে তুলে ধরা হবে। হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতা, তার অর্থ ও বিবর্তন পাঠ্যসূচির অন্তর্গত। ‘হিন্দু’ কথাটিই যে ইতিহাসের বিচারে ভারতে নবাগত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কর্তৃপক্ষ ‘সনাতন’ শব্দটি ব্যবহার করলে অধিক যৌক্তিক হতে পারতেন। অনাদি ও অনন্তকে ‘সনাতন’ বলে, সে সব বিরোধিতা নিজের মধ্যে ঠাঁই দেয়। কোর্সটি পড়াবেন কারা? নানা বিভাগ— দর্শন ও ধর্ম, সংস্কৃত, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ভারতীয় দর্শন এবং প্রত্নতত্ত্ব। যে সব বিভাগের নাম করা হল, সেখানে তো সবই পড়ানো হয়, তবে নতুন কোর্সটির স্বাতন্ত্র্য কোথায়?
বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও সর্বোচ্চ আদালতে অযোধ্যা রায়ের পর মথুরা, আগ্রা প্রভৃতি জায়গার মসজিদ-সমাধি নিয়ে জিগির বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এপ্রিলে বারাণসীর এক আদালত জানায়, জ্ঞানবাপী মসজিদের অভ্যন্তরে মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখবে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ, এবং সেই খরচ দেবে উত্তরপ্রদেশ সরকার। সে রাজ্যে ভোটের কথা মাথায় রেখেই কি এমন কোর্স চালু করা, না কি নতুন এই কোর্সটির পিছনে জ্ঞানবাপী-সহ বিভিন্ন ধর্মস্থানের কথা বাবরি মসজিদের মতো ভাবা হয়েছে? এমন কথা নানা মহলে ভাসছে। কয়েকশো বছর ধরেই কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও জ্ঞানবাপী মসজিদ পাশাপাশি অবস্থান করছে, যেমন নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম প্রভৃতি ধর্মের দর্শন পড়ানো হয়। কিন্তু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তা আর চায় না। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতেও রয়েছে নানা বিভেদমূলক পাঠ্যসূচি।
আরএসএস জানিয়েছে, জাতীয় শিক্ষানীতিতে তাদের ৬০-৭০% চাহিদা পূরণ হয়েছে। তারই অংশ এই কোর্স। হিন্দু ধর্মের নামে বিজ্ঞান ও অন্যান্য শাস্ত্রের ‘অভাবনীয় অগ্রগতি’র যথাযথ মূল্যায়ন না করে ভ্রান্ত বিষয়কে বিজ্ঞান বলে প্রচারের চেষ্টা আছে নতুন শিক্ষানীতিতে। ভারত বিশ্ব থেকে কোনও জ্ঞান অর্জন করেনি, সবই তার ছিল— এমন ভাবনা থেকে এই ধরনের কোর্স চালু করার উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন। ইতিমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে ভূতবিদ্যা। প্রাচীন ভারতে হেড ট্রান্সপ্লান্ট থেকে যুদ্ধবিমান, উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান— সবই নাকি এই দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য। আধুনিক শিক্ষার বদলে সেই ঐতিহ্যই পড়বেন আগামীর শিক্ষার্থীরা।
নিচু ক্লাসের জন্যও ভাবা হয়েছে নতুন বিষয়: প্রাচীন ভারতীয় (পড়ুন, হিন্দু) জ্ঞান ও পরম্পরা। মাদ্রাসায় আবার পড়ানো হবে বেদ, গীতা ও রামায়ণ। সেখানে না থাকবে চার্বাক-লোকায়ত, তৈর্থিক বা ‘হেরেটিক’ প্রমুখ নাস্তিক মত, না থাকবে বৌদ্ধ-জৈনের মতো অন্য ভারতীয় ধর্মের জ্ঞান। মনে রাখব, ভারতীয় পরম্পরায় বাদ-এর পাশাপাশি থাকে প্রতিবাদ। শুধু মন্ত্রমাহাত্ম্য নয়, বেদ-পুরাণ-স্মৃতিশাস্ত্রের সবিচার পাঠ ভারতের প্রকৃত ঐতিহ্য।
দর্শন বিভাগ, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy