শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, এ কথাটা হামেশা বলা হয় বটে, কিন্তু কাজের বেলা কি মনে রাখা হয়? পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে অস্থিরতা চলছে, তা দেখলে এ কথা মনে করা কঠিন। সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ আজ শিক্ষা-আলোচনার অনেকটা পরিসর জুড়ে বসেছে।
১৯৯৬-এ স্কুল সার্ভিস কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তার আগে স্কুল পরিচালন সমিতিই শিক্ষক নিয়োগ করত। কিন্তু স্বজনপোষণ, দুর্নীতির অভিযোগ ছিল প্রবল। এমনও হয়েছে যে, কর্মবিনিময় কেন্দ্র থেকে যে প্রার্থীর নাম স্কুলে পাঠানো হয়েছে, স্থানীয় লোকরা তাঁকে বঁটি-কাটারি নিয়ে তাড়া করে মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত হতেই দেয়নি। স্কুল পরিচালন সমিতি আগেই স্থির করে রেখেছিল প্রার্থী: মারমুখীরা সেই প্রার্থীরই লোকজন।
১৯৯৮ থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশন দ্বারা নিয়োগ শুরু। সেখানেও নানা অভিযোগ ছিল, কিন্তু বেশ কিছু দিন নিয়মিত নিয়োগ হয়েছে। কিন্তু গত বছর ছয়-সাত ধরে বার বার নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা নিয়ে প্রবল অসন্তোষ দেখা গিয়েছে। বিক্ষোভ, অবস্থান, এবং একের পর এক মামলা হয়েই চলেছে। বার বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্তন করছে সরকার। যেন চেয়ারম্যানকে সরালে অনিয়মের অভিযোগের থেকেও সরকার দূরত্ব তৈরি করতে পারবে। কমিশন যে বার বার আদালতে তিরস্কৃত হচ্ছে, এটাই তো রাজ্য সরকারের পক্ষে লজ্জাজনক। শেষ মামলায় কমিশনের চেয়ারম্যান শুভশঙ্কর সরকার ব্যক্তিগত ভাবে কুড়ি হাজার টাকা খেসারত দিয়েছেন। তাঁকে অপসারণ করেছে রাজ্য।
প্রশ্ন হল, চেয়ারম্যান বদল করলেই কি কমিশনের কাজের ধারা বদলাবে? এত দিনে স্পষ্ট লক্ষ লক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করতে গেলে যে স্বচ্ছতা দরকার, বিধি পালনে যে কঠোরতা প্রয়োজন, তাতে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আইন অনুযায়ী প্রত্যেকের প্রাপ্ত নম্বরকে নানা বিভাগ অনুযায়ী প্রকাশ করা চাই মেধা তালিকায়। স্কুল সার্ভিস কমিশন বার বার সেই নিয়ম না মেনে তালিকা প্রকাশ করছে। বঞ্চিতরা আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এমনই এক মামলায় কয়েক হাজার বিচারপ্রার্থীর অভিযোগ ছিল, উপযুক্তদের বাদ দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের নাম শিক্ষক পদের প্যানেলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য অস্বচ্ছতার অভিযোগকেই মান্যতা দিয়ে ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্যানেলটি বাতিল করে নতুন মেধাতালিকা তৈরি করতে বলেন। নানা অনিয়মের ফলে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলিতে শিক্ষকদের লক্ষাধিক পদ শূন্য ছিল গত বছর।
অস্বচ্ছতার প্রমাণ আদালতে পেশ করা হলে সংবিধানের রক্ষক হিসাবে আদালত নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। সম্প্রতি একটি মামলায় এক ব্যক্তির অভিযোগ ছিল, ২০১৬-র নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষক পদে প্রার্থী-তালিকায় তাঁর নাম থাকলেও তাঁকে কাউন্সেলিং-এ ডাকা হয়নি। অথচ তাঁর পিছনে থাকা প্রার্থীদের ডেকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন ওই প্রার্থীকে কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি? কমিশন জানিয়েছে, ওই ব্যক্তিকে মোবাইলে এসএমএস বার্তার মাধ্যমে জানানো হয়েছিল। বিচারপতি এসএমএস-এর মাধ্যমে খবর পাঠানো কোন আইনে আছে, জানতে চান। স্কুল সার্ভিস কমিশন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তখনই ক্ষুব্ধ বিচারপতি বলেন, চেয়ারম্যান শুভশঙ্কর সরকার ওই পদের যোগ্য কি না তা রাজ্যের শিক্ষা বিভাগকে খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে। প্রশ্ন হল, সত্যিই কি স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান এর জন্য পুরোপুরি দায়ী? শুভশঙ্কর সরকার ইতিপূর্বে বড় বড় দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কখনও ওঠেনি। কেন এক বছর চেয়ারম্যান পদে থেকে তাঁকে এ ভাবে তিরস্কৃত হতে হল? ১৯৯৭-২০১৭, এই দশ বছরে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান আট বার বদল করা হয়েছে— সমস্যার সমাধান হয়নি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটছে, এ আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এর সমাধানে কমিশনের প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো সবল করতে হবে, যাতে নিয়োগের প্রতি স্তর স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত রাখা যায়। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার খাতা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া জরুরি। মৌখিক সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিডিয়ো করা জরুরি। প্রার্থীর নাম-পরিচয়ও পরীক্ষকদের কাছে অজানা থাকাই শ্রেয়। কোড ব্যবহার করা দরকার লিখিত ও মৌখিক সব পরীক্ষায়। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ওয়েবসাইটে দেওয়া দরকার। নয়তো পিছনের খেলা কমবে না। ওয়েবসাইটে পরীক্ষার দিন রাতেই সঠিক উত্তর প্রকাশ দরকার। কমিশনের তরফে ভুল প্রশ্ন, ভুল উত্তর, দুটোই ঘটেছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও বহু কালের অভিযোগ, আগে প্রার্থী ঠিক হয়, তার পর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এমন আস্থাহীনতা কেবল সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের নয়, জাতির ক্ষতি করে। স্বচ্ছ, স্বজনপোষণহীন শিক্ষক-নিয়োগ প্রক্রিয়াই শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy