Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
ইতিহাসের উপেক্ষিতা

মেয়েদের উপর যৌন হিংসায় দেশকালে কোনও তফাত আছে কি

মেয়েদের যন্ত্রণার কথা নারীবাদী গবেষকদের কলমে উঠে এলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে ইতিহাসের পঠনপাঠনে বিশেষ ঠাঁই পায় না।

শিকার: বেজিংয়ের মিউজ়িয়ামে জাপানি সেনার হিংসার বলি চিনা নাগরিক-মুখ। এর মধ্যেও মেয়েদের কথা থেকে যায় উপেক্ষিত।

শিকার: বেজিংয়ের মিউজ়িয়ামে জাপানি সেনার হিংসার বলি চিনা নাগরিক-মুখ। এর মধ্যেও মেয়েদের কথা থেকে যায় উপেক্ষিত। গেটি ইমেজেস

অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২২ ০৫:২৭
Share: Save:

ইতিহাস অতীতের কথা বলে, কিন্তু অতীতের সব কথা বলে না। মেয়েদের কথা ইতিহাসে উপেক্ষিত। আরও বেশি উপেক্ষিত মেয়েদের উপর সংঘটিত পুরুষদের যৌন অপরাধ ও হিংসা। তা যেন এতই জলভাত যে, আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না। অথবা হয়তো কাজ করে গোপন এক অপরাধবোধ। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা বিশ্বের ইতিহাসকে নাড়া দেওয়া কোনও বড় ঘটনা— যেমন প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ— নারীর প্রতি যৌন হিংসা প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। অথচ ইতিহাস-বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না সে কথা। অথবা দু’লাইন লিখেই দায় সেরে ফেলা হয়।

ছোটবেলা থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কথা আমরা ইতিহাস-বইয়ে পড়ে এসেছি। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে জেনেছি, এই আন্দোলনের ফলে তমলুকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মহিষাদল থানার অন্তর্ভুক্ত ৩টি গ্রামের চুয়াত্তর জন মহিলা তাঁদের পরিবারের চোখের সামনে গণধর্ষিত হয়েছিলেন। গণধর্ষণের নেতৃত্ব দিয়েছিল নলিনী রাহা নামের এক বাঙালি পুলিশ অফিসার। উদ্দেশ্য: আন্দোলনকে দমন করা, আর মহিলাদের যৌন অত্যাচার— আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার সবচেয়ে মোক্ষম পন্থা। তবে এই মহিলারা দমেননি, লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বসে থাকেননি। তাঁরা তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের দরবারে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও যে মেদিনীপুরের মেয়েরা যৌন অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, তা সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। বীণা দাসের স্মৃতিকথা শৃঙ্খল ঝংকার-এ জেলের ভিতরে যৌন নির্যাতনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তেভাগা আন্দোলনের সময় কৃষক মেয়েরা অত্যাচারিত হয়েছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশ তাঁকে কী নির্মম অত্যাচার করেছিল, তা তিনি জানিয়েছেন তাঁর জবানবন্দিতে। নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি মুখ খোলেননি। লিখেছেন, “কোনো অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি এবং প্রমাণ স্বরূপ কোনো কিছু দাখিল করি নাই।”

তথাকথিত প্রগতিশীল পশ্চিমি দেশগুলির দিকে চোখ ফেরানো যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা রাশিয়ার মাটিতে সে দেশের মেয়েদের বেলাগাম যৌন নির্যাতন করেছিল। আবার রাশিয়ার রেড আর্মিও জার্মান মেয়েদের ছেড়ে কথা বলেনি। হাজার হাজার জার্মান মহিলা গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, ভোগ করেছিলেন অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের যন্ত্রণা। সেনারা ছিল রাষ্ট্রের মদতে পুষ্ট। রাষ্ট্র সাম্যবাদী হোক বা ফ্যাসিবাদী, মেয়েদের উপর অত্যাচারে কেউ কারও থেকে কম যায়নি।

১৯৩৭ সালে চিনের নানকিং শহরে জাপান নারকীয় হত্যালীলা চালায়, প্রায় আশি হাজার চিনা মহিলাকে ধর্ষণ করে। ঘটনাটি ইতিহাসে ‘রেপ অব নানকিং’ নামে চিহ্নিত। এই ঘটনার পর জাপানি সম্রাট সিদ্ধান্ত নেন, জাপানি সৈনিকদের যৌন চাহিদা চরিতার্থ করার জন্য পতিতালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। তবে অর্থের বিনিময়ে যৌন পরিষেবা গ্রহণ করার পরিবর্তে কোরিয়ার অল্পবয়সি মেয়েদের ধরপাকড় করে বা চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ফুসলিয়ে নিয়ে এসে যৌন সেবাদানে বাধ্য করা হয়। শুধু কোরিয়া নয়, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, বর্মা এমনকি জাপানের মহিলাদেরও সেনা ছাউনিতে যৌনদাসী রূপে আনা শুরু হয়, এঁদের ‘কমফর্ট উইমেন’ আখ্যা দেওয়া হয়।

কোরিয়াতে দীর্ঘ দিন যাবৎ এঁদের উপর নির্যাতন নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। রাষ্ট্র, সমাজ যৌনদাসীদের সহানুভূতি দেখায়নি। তাই যে সব যৌনদাসী যুদ্ধের পরেও বেঁচে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ নিজের ও পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। বাকিরা নীরব থেকেছেন, অন্তরালে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেদের। ১৯৮০-র দশক থেকে মূলত খ্রিস্টান মহিলা এবং নারীবাদীদের মাধ্যমে প্রথম এই বিষয়ে লেখালিখি ও আলোচনা শুরু হয়।

১৯৮৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় উদারবাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, যে ‘কমফর্ট উইমেন’রা তখনও জীবিত ছিলেন তাঁরা জনসমক্ষে সেই নির্যাতনের কথা বলতে শুরু করেন। নব্বইয়ের দশক থেকে সেই পুঞ্জিত ক্ষোভ ও ক্রোধ বেরিয়ে আসে লাভাস্রোতের মতো। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘কমফর্ট উইমেন’-দের উপর অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য জাপানকে তীব্র ভর্ৎসনা করে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনে পাঠানো রিপোর্টে মহিলাদের উপর হিংসা বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ তদন্তকারী অফিসার রাধিকা কুমারস্বামী জানান, যে জাপানি সৈনিকেরা ওই মহিলাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল, জাপানের উচিত তাদের চিহ্নিত করা ও চরম শাস্তি দেওয়া। শুধু তা-ই নয়, নির্যাতিতাদের কাছে জাপানের লিখিত ভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত, এবং এই অন্ধকারময় অধ্যায়কে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা উচিত। জাপান প্রাথমিক ভাবে অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে অপরাধ স্বীকার করে নেয়। ২০১৫ সালে জাপানি সরকার এই নারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। দক্ষিণ কোরিয়া দাবি জানায়, জাপান আরও জোরালো ভাবে তার অপরাধ স্বীকার করুক। কিন্তু কোরিয়ার সরকারও এঁদের যন্ত্রণাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। কোরিয়ার অপরাধ কম ছিল না, নিজের দেশের মেয়েদের সুরক্ষিত রাখতে অপারগ হয়েছিল কোরিয়া। হয়তো কোনও সৎ চেষ্টাও ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাংলায় ভয়াবহ মন্বন্তর দেখা দেয়। অনাহারক্লিষ্ট পরিবারের বহু মেয়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অশনি সংকেত উপন্যাসে মেয়েদের চালের লোভ দেখিয়ে গৃহত্যাগী হতে প্ররোচিত করার উল্লেখ পাওয়া যায়। নিজের ও পরিবারের খিদে মেটানোর জন্য যে বহু মেয়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন, তার এক মর্মান্তিক চিত্র পাই প্রবোধ সান্যালের ‘অঙ্গার’ ছোটগল্পে। এই গল্প অবলম্বন করে মৃণাল সেন তাঁর কলকাতা একাত্তর চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়টি নির্মাণ করেন। বিশেষত সেনাবাহিনীর ভারতীয় ও বিদেশি সৈনিকদের যৌন ক্ষুধা নিবৃত্তির মাধ্যমে বহু দরিদ্র কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ে জীবনধারণের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সেদিনের কথা-য় মণিকুন্তলা সেন লিখেছেন, “ক্ষুধার অন্যতম বলি হল ওই কৃষক মেয়েদের ইজ্জত। বিদেশী সৈন্যদের জন্য দালালদের মারফতে একখানা শাড়ি বা একদিনের খাবারের বিনিময়ে এইসব ‘সস্তা’ মেয়েদের বাজার জমে উঠল।… তাছাড়া কৃষক মেয়ে-বউদের ইজ্জত বোধ হয় আগে কখনো এমনভাবে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েনি।” এ কি পূর্ব এশিয়ার ‘কমফর্ট উইমেন’দের বঙ্গজ সংস্করণ?

দেশভাগের সময় দুই সম্প্রদায়ের পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ পায় ‘শত্রু’ সম্প্রদায়ের মেয়েদের উপর যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে। তাঁদের ‘সম্মান’ হরণ করে, ‘সতীত্ব’ নাশ করে প্রতিশোধ নিতে চায় তারা, দুর্বল করে দিতে চায় প্রতিপক্ষকে। একটি সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্বের বীজ যেন লুকিয়ে আছে তাদের মেয়েদের দেহের শুচিতার মধ্যে, আর তা নষ্ট করতে পারলেই প্রতিপক্ষকে কাবু করে ফেলা যায়। তাই দেশভাগের আগে ও পরে দলে দলে মেয়েরা ধর্ষিত, নিগৃহীত হন। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় নির্যাতিতা নারীর হাহাকার। যে কোনও রাজনৈতিক সংঘাত বা আন্দোলনের পরিস্থিতিতে নারীদেহের উপর নির্বিচারে আক্রমণ চলে। হিংসার শিকার হন মেয়েরা। অবশ্য তা মেয়েদের দমাতে পারে না সব সময়। আজও মেয়েদের দিনযাপনের অঙ্গ এই হিংসা। মেয়েদের যন্ত্রণার কথা নারীবাদী গবেষকদের কলমে উঠে এলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে ইতিহাসের পঠনপাঠনে বিশেষ ঠাঁই পায় না। ইতিহাসের পুরুষকেন্দ্রিক, পিতৃতান্ত্রিক চরিত্র অব্যাহত থাকে।

ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy