অনেকেরই ধারণা, পাকিস্তানের ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে বিয়ে করেছেন, তাই ইদানীং সানিয়া মির্জ়া শিয়ালকোটে থাকেন। ভুল তথ্য। সানিয়া স্বামীর সঙ্গে পাকিস্তানে থাকেন না। তার প্রধান কারণ, তিনি ভারতীয় দলের হয়ে টেনিস খেলেন। এবং, তিনি দলটির বহুমূল্য সম্পদ। এযাবৎ ভারতের সফলতম মহিলা টেনিস খেলোয়াড়। মার্টিনা হিঙ্গিস, ভিক্টোরিয়া আজ়ারেঙ্কার মতো কিংবদন্তিকে হারানোর কৃতিত্ব তাঁর ঝুলিতে। সিঙ্গলস ক্রমপর্যায়ে ২৭ নম্বরে উঠে এসেছিলেন ২০০৭-এ। প্রসঙ্গত, ভারতীয় টেনিসের প্রবাদপুরুষ লিয়েন্ডারের সেরা সিঙ্গলস র্যাঙ্কিং ৭৩। ডাবলস, মিক্সড ডাবলস মিলিয়ে ছ’টা গ্র্যান্ড স্লামের অধিকারী সানিয়া। উইমেন’স টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউটিএ) ক্রমসারণিতে দশ বছর ধরে দেশের এক নম্বর তিনিই। একটা খেলাপাগল দেশে এই গুরুত্বের খেলোয়াড়ের যে পরিমাণ শ্রদ্ধা, সমর্থন পাওয়ার কথা, সানিয়ার ভাগ্যে তার চাইতে ঢের বেশি জুটল হুমকি-ফতোয়া, সন্দেহের টিপ্পনী আর নিন্দেমন্দর কাঁটা।
২০০৫ সাল। সানিয়া তখন মাত্র ১৮, আর সিঙ্গলস র্যাঙ্কিং ৩৪! ট্রফি আনছেন প্রায়ই, অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে তৃতীয় রাউন্ড পর্যন্ত উঠেছেন। স্বয়ং সেরেনা উইলিয়ামস উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছেন তাঁর মধ্যে। এমন ফর্ম নিয়ে কলকাতায় সানফিস্ট ওপেন খেলতে আসার কথা তাঁর। ধর্মগুরুরা ফতোয়া দিলেন, মুসলিম মেয়ের স্কার্ট-টি শার্ট পরে খেলা তো চলবে না! টিউনিক, হেডস্কার্ফ পরে কোর্টে নামুন। নচেৎ, খেলতে দেওয়া হবে না। সানিয়া সে হুমকির তোয়াক্কা করেননি।
তার পরের সতেরো বছর ধরে সানিয়া প্রতিপক্ষের জোরালো সার্ভ, বিষাক্ত ভলির পাশাপাশি লড়াই করে চলেছেন দেশের উগ্র মৌলবাদ, নারীবিদ্বেষের রোগ আর সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধের বিরুদ্ধেও। মনঃসংযোগে চিড় ধরানো কাণ্ড তাঁর কেরিয়ারে সহস্র। তাঁর উত্থানে আগ্রহই দেখায়নি অল ইন্ডিয়া টেনিস অ্যাসোসিয়েশন। সানিয়ার বাবার উদ্যম, কর্পোরেট স্পনসর আর মহেশ ভূপতির পরামর্শটুকু বাদে সাফল্যের পুরোটাই নিজের অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তি।
মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি কোন অবস্থান নেবেন, সেও বোঝা গিয়েছিল তাঁকে শর্টস পরে খেলতে দেখে। উইম্বলডনের কোর্টে তাঁর টি-শার্টে লেখা ছিল— “সুশীল, সংযত মেয়েদের ইতিহাস গড়তে দেখা যায় না।” সেটাই তাঁর জীবনের স্লোগান। অন্যের মতে নয়, নিজের শর্তে বাঁচো। আর তার জন্য বেড়া ভাঙো।
পরের রাউন্ডে তাঁর প্রতিপক্ষ অন্ধ দেশভক্তি। ২১ বছরের সানিয়া নাকি জাতীয় পতাকার দিকে পা করে বসেছেন, অমনই দেশের সর্ব প্রান্ত যেন ফুঁসে উঠল। সানিয়া বলেছেন, ঘটনাচক্রে হয়ে গিয়েছে, কেউ শুনতেই রাজি নয়। সে সময় নিজেই খেলা ছেড়ে দেবেন ভেবেছিলেন।
ভাগ্যিস, তাঁর মনোবল ভাঙেনি। তাই চোটআঘাতের সমস্যায় সিঙ্গলস থেকে সরতে বাধ্য হলেও সোনা ফলিয়ে গিয়েছেন ডাবলস আর মিক্সড ডাবলস বিভাগে। শীর্ষ বাছাই হিসাবে গ্র্যান্ড স্লাম খেলার নজির গড়েছেন, জিতেছেন উইম্বলডন। মার্টিনা হিঙ্গিস ও মহেশ ভূপতির সঙ্গে জুটি বেঁধে ডাবলস ও মিক্সড ডাবলসে সেই সব শৃঙ্গজয়ের হিসাব রাখার বদলে সংবাদমাধ্যমের অনেক বেশি প্রিয় ছিল শোয়েব মালিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ের গল্পগাছা। আর দেশবাসী বলেছে, সানিয়া দেশদ্রোহী, এখনই পাকিস্তানে চলে যান। নিজের র্যাঙ্কিংয়ের কারণে এশিয়ান গেমস থেকে নাম তুলে নিলে ‘পাকিস্তানের পুত্রবধূ’ আক্রমণ শাণিত হয়েছে। মনে রাখা ভাল, একই কাজ করেছিলেন লিয়েন্ডার পেজ়ও। তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা ভাবাও যায়নি।
এ সবের মধ্য দিয়ে সানিয়া পেশাদার সার্কিটে প্রায় একা হাতে দেশের মেয়েদের টেনিসকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। ডাবলসে ৯১ সপ্তাহ বিশ্বের এক নম্বর থেকেছেন। পাশাপাশি, ভারতে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে সরব হয়েছেন। বলেছেন, এ দেশের লক্ষ লক্ষ মেয়েকে নানা ভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হয়। ছেলে হলে কি আমাকে নিয়ে এত বিতর্ক হত?
এ ভাবেই টেনিসের রানি নারীর শ্রেষ্ঠাধিকারের পতাকাটাও শক্ত হাতে তুলে ধরেছেন। তাঁর সমসাময়িক বাকি দুই ‘খেলরত্ন’ সাইনা নেহওয়াল ও মেরি কমেরও এমনই বেদনার ইতিহাস আছে। জাঠল্যান্ডে মেয়েদের খেলাধুলোয় সমস্যা, তাই অন্য শহরে থাকতে বাধ্য হন সাইনা। মেরি কমের নারীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠত। আর সানিয়াকে সমাজ ও ধর্মগুরুদের নিদান, ‘তহজ়িব শিখো’।
সাধারণত, ক্রীড়াতারকারা নিজেদের সেরা সময়টুকুতে অন্তত, কোনও পক্ষ নিয়ে এত মুখ খোলেন না। সানিয়া সেখানেই ব্যতিক্রম। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, নিজের পছন্দে অটল থাকেন। সে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গী নির্বাচন হোক, বা ডাবলসে সঙ্গী হিসাবে লিয়েন্ডারের বদলে মহেশ ভূপতিই ভাল— স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক। তাঁর সাজানো-গোছানো সুখী জীবন ও পরিপূর্ণ কেরিয়ার বারে বারে মেয়েদের সাধ জাগায়— স্বপ্ন দেখবে, সেই স্বপ্ন যাপন করবে নির্ভয়ে।
এই টেনিসসুন্দরীর গ্ল্যামারের আড়ালে থেকে যায় অনেকখানি লড়াই আর পরিশ্রমের ঘামরক্ত। সন্তানের জন্মের পর ওজন ঝরিয়ে সার্কিটে ফিরে বার্তা দিয়েছেন, মাতৃত্বকে উপভোগ করো, তাকে জীবনের শেষ স্টেশন ভাবার প্রবণতাটাকে স্ট্রেট সেটে উড়িয়ে দাও।
এই মরসুমেই টেনিস কোর্টকে বিদায় জানাবেন সানিয়া। তাঁর অনুপ্রেরণার কাহিনিটি কিন্তু থামবে না। শুধু, কে জানে, নতুন টেনিস-রাজ্ঞী পেতে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে এ দেশকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy