অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড সম্প্রতি বিবাহ সংক্রান্ত একটি ফতোয়া জারি করেছে। জানিয়েছে, এক জন মুসলিমের সঙ্গে অমুসলিমের বিয়ে সামাজিক ভাবে বৈধ হলেও শরিয়ত-বিরোধী। আপাতদৃষ্টিতে মুসলিম নারী ও পুরুষকে একই ভাবে সতর্কবার্তা দিয়েছে মনে হলেও প্রেস বিবৃতির মূল লক্ষ্য মুসলিম মেয়েরা। একটি মুসলিম মেয়ের অমুসলিমকে বিয়ে করা ‘পাপ’। এই পাপ থেকে মেয়েদের রক্ষা করার নিদান হল— দেরিতে বিয়ে না দেওয়া; কো-এডুকেশন স্কুলে পড়ানো থেকে বিরত থাকা; মোবাইলে নজরদারি; মেয়েদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে রাখা, এবং ইসলামি শিক্ষায় গড়ে তোলা। মুসলিম মেয়েরা অমুসলিম ছেলেদের বিয়ে করার পর ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, মনে করিয়ে দিয়েছে পার্সোনাল ল বোর্ড।
এই নিদান কোন দিক থেকে মেয়েদের উন্নতির সহায়? নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে করলে সেই দম্পতি বুঝি কোনও ভোগান্তির শিকার হয় না? এক দিকে লাভ জেহাদ নাম দিয়ে হিন্দু মৌলবাদ হিন্দু মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করছে, মুসলিম পুরুষদের উপর আক্রমণ হানছে। অপর দিকে মুসলিম মৌলবাদ মুসলিম মেয়েদের নিরাপত্তার নামে অগ্রগতি রুখে দিতে অগ্রসর হচ্ছে। অভিভাবকের পছন্দ-করা পাত্রকে বিয়ে করেও কত মেয়ে পুড়ে মরে, আত্মহত্যা করে অথবা মানসিক রোগী হয়ে বেঁচে থাকে। পণ-নির্যাতন তো সাধারণ চিত্র, হিন্দু-মুসলিম কোনও ফারাক নেই সেখানে। দেশে পণপ্রথা বিরোধী আইন আছে, ইসলাম পণকে হারাম (নিষিদ্ধ) বলেছে। তবু মুসলিম সম্প্রদায়েও পণের চাহিদা তীব্র। সেখানে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা কোথায়?
মুর্শিদাবাদের সাবিনা ইয়াসমিনের বাবা পণের টাকা দিতে পারেননি বলে সাবিনার উপর প্রথমে নির্যাতন হল, পরে তাঁকে তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হল। একই গ্রামের ছেলে সাবিনার স্বামী বিনা বাধায় আবার বিয়ে করলেন। সামাজিক আসরে একই ভাবে অংশ নিলেন, মসজিদে নমাজ পড়লেন। ইমাম মৌলবিদের তরফ থেকে বাধা আসেনি। তবে বাধা দেওয়া হয়েছে সাবিনাকে, এই তালাককে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিলেন বলে। মৌলবিরা জানিয়ে দিলেন, তালাক হয়ে গিয়েছে।
মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের রিজিয়ার দু’টি সন্তান। স্বামী কর্মসূত্রে আমদাবাদে গিয়ে ফের গোপনে বিয়ে করেন। জানাজানির পর রিজিয়া গ্রামের মোড়লদের কাছে বিচার চান। স্বামী মনে করলেন, তাঁর অধিকারে আঘাত দেওয়া হয়েছে। আড়ালে রাখা দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। রিজিয়া সতিনের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে চাইলেন না, আলাদা থাকার জন্য সন্তানদের খরচ দাবি করলেন। স্বামী প্রত্যাখ্যান করে এক বাড়িতেই তাঁকে থাকতে বাধ্য করলেন। এখন রিজিয়া মানসিক রোগী, সন্তানদের নিয়ে দাদাদের সংসারে আশ্রিত। একেই বলে ধর্ম?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মোমিনা। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়ির বাধা ঠেলে মোমিনা মাধ্যমিক পাশ করেছেন। এগারো ক্লাসে ভর্তি হবেন বলে বাবার বাড়িতে এসেছেন। সেই ভর্তি আটকাতে, মোমিনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, দল বেঁধে এসেছেন শ্বশুরবাড়ির লোকরা। বাবা-মাও চাইলেন মোমিনা ফিরে যাক, ওদের কথা মতো চলুক। নিরাপত্তাহীন মোমিনা সকলের সামনে জানিয়ে দিলেন, আমি তালাক দিচ্ছি। ফিরে যাব না। নিজের গ্রাম, শ্বশুরের গ্রাম এক সঙ্গে মোমিনার এই স্পর্ধায় ক্ষুব্ধ— মেয়ে হয়ে তালাক বলল! এই তালাক হবে না। তবে অপমানিত স্বামী ও তাঁর অভিভাবকরা জানালেন, এমন মেয়ে আর ঘরে নেবেন না।
পুরুলিয়ার নিলুফার ষোলো বছরে বিয়ে, সতেরো বছরে মা হওয়া, কুড়িতে বিধবা। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত। স্বামীর মৃত্যু হয়েছে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির মালিক হওয়ার আগেই। তাই মৃত স্বামীর বিধবা স্ত্রী ও সন্তানকে শ্বশুর-শাশুড়ি তাড়িয়ে দিতেই পারেন। নিলুফাও সেই নিয়মে সন্তান কোলে ভিটেহারা হয়েছেন। কোনও সহৃদয় শ্বশুর-শাশুড়ি ইচ্ছে হলে বিধবা পুত্রবধূকে সম্পত্তির ভাগ দেন, কিন্তু অধিকার নেই, শরিয়ত মতে।
পিতৃতান্ত্রিক বিধান মেয়েদের দুর্ভোগের পাকা ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেখান থেকে বেরোতে হবে সচেতন শিক্ষা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, অর্থ উপার্জন এবং উপার্জিত অর্থ নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখার মধ্যে দিয়ে। এই সবেরই বিরোধিতা রয়েছে পার্সোনাল ল বোর্ডের ফতোয়ায়। মেয়েরা যখন একটু একটু করে বাধা ভাঙতে ভাঙতে এগোচ্ছেন, তখন ‘ধর্মের বাণী’ শুনিয়ে তাঁদের বন্দি করার ফন্দি আঁটছে। কাকে ভালবাসবে, তা প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। সঙ্গী পছন্দের রূপরেখা মৌলবাদীরা তৈরি করে দিতে পারে না। উপার্জনের প্রয়োজনে দেশের বহু আইন মুসলিমরা মেনে নিচ্ছে, যা শরিয়ত-বিরোধী। কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার করে লিঙ্গসাম্য আনার দাবি জানালে মুসলিম পিতৃতন্ত্র নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সেটা সত্যিই কি ধর্মীয় বিধি ভঙ্গের ভয়? না কি এত দিনের ভোগ করা সুবিধা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা?
বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy