তখনও তাড়াতাড়ি পাতা ছাড়ার তাড়া ছিল না। তার উপর যুবরানি ডায়ানার শেষকৃত্যের আগের রাত। ফলে ডামি নিয়ে পাতা সাজাতে যখন দোতলায় নামা হল, রাত সাড়ে এগারোটা হবে। আর্টিস্টদের ঘরে কপির পুল-আউট নিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই বাজল ঘরে রাখা টেলিফোন। “সবাই উপরে চলো। পাতা এখন হবে না। মাদার টেরিজা মারা গিয়েছেন।” অতঃপর সব পাতা ভেঙে, নতুন করে সাজানো। নতুন কপি, ছবি।
পাকিস্তানে নির্বাচনের প্রচার চলছে, তুমুল উত্তেজনা। খবর-ঘরে চলছে টিভি। ফ্ল্যাশ: ‘বেনজির ভুট্টো ইনজিয়োর্ড ইন আ র্যালি’। ‘বেনজির ভুট্টো সিভিয়ারলি ইনজিয়োর্ড ইন আ র্যালি’। কপি কী কী হবে সেই আলোচনা সবে শুরু হয়েছে, পর্দায় ভেসে উঠল ‘বেনজির ভুট্টো ডেড’। খবরটি কে লিখবেন, কী কী খবর হবে, কী কী গ্রাফিক— হইহই, উত্তেজনার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে চটজলদি।
করোনা-আবহে অনেকেই বাড়ি থেকে কাজ করছেন। জেলা সংস্করণের পাতা ছাড়া শুরু হয়েছে ছাপানোর জন্য। গ্রুপে একটি ছোট্ট টুইট শেয়ার হল, ‘মারাদোনা ডেড’। এক দিকে জেলা সংস্করণ ছাড়ার তাড়া, অন্য দিকে মারাদোনার মৃত্যুসংবাদ যথাযথ ভাবে দেওয়ার তাগিদ। কে কপি লিখবে, কে ছবি বাছবে, কোন খবরটা ভিতরের পাতায় ঢুকিয়ে মারাদোনার মৃত্যুসংবাদের খবর ও ছবি ভাল করে বসাতে হবে— খবর-ঘরের এই যাবতীয় সমন্বয় করোনা-আবহে চলল মোবাইলে-মোবাইলেই।
২৪ ঘণ্টার সংবাদ-চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়ার বহু আগে, কিছু ক্ষেত্রে সংবাদ-ঘরের নির্ভরতা ছিল শুধুই সংবাদ সংস্থার টেলিপ্রিন্টার। উগরে দিত ক্রিডের পর ক্রিড, আর ব্রেকিং নিউজ় হলে টিংটিং বেজেই যেত। যেমন বেজেছিল রাজীব গান্ধীর হত্যার পরে। সেই রাত-শিফটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বলেছিলেন, “পরের দিনের পাতা কী হবে, ডামি রেডি। বিকেলের শিফটের সহকর্মীরা বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন, তখনই টেলিপ্রিন্টারের শব্দ। ‘রাজীব গান্ধী কিলড’, ‘রাজীব গান্ধী কিলড’, ‘রাজীব গান্ধী কিলড’। নিমেষে বদলে গেল নিউজ় রুম। সংবাদ সংস্থাকে ভরসা করে কপি, ছবি। দু’জনকে পাঠানো হল লাইব্রেরিতে, এলটিটিই সম্পর্কে তথ্য ঘেঁটে লেখার জন্য। সম্পাদক চলে এলেন, আমাকে বললেন, ‘প্রথম টেলিগ্রামটা করে ফেলুন, দ্বিতীয়টা আমি লিখব।’ টেলিগ্রাম অর্থাৎ বিশেষ সংস্করণ, যা ছাপা হবে তৎক্ষণাৎ। ছবি, কপি দিয়ে বেরোল প্রথম টেলিগ্রাম।” প্রায় সারা রাত কাজ করে সকালে যখন তাঁরা অফিস ছাড়লেন, রাস্তায় বিক্ষোভের টায়ার জ্বলছে। বাড়ি পৌঁছতে না পৌঁছতেই আবার অফিসের গাড়ি। যেতে হবে, পরের দিনের কাজ।
“ভেঙে ফেলো, সব নতুন করে করতে হবে।” পাতা ছাড়ার সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর এই অবধারিত বার্তা খবর-ঘর শুনেছে শতবর্ষ ধরে। শুনতে শুনতে কাজ শিখেছে, ভুল করেছে, হতাশায় আছড়েছে, তৃপ্তির শ্বাস ফেলেছে। রাত-শেষে বুঝেছে, এটাই আবেগ। সকালে রাজপথ গলিপথ পেরিয়ে যেতে যেতে ভেবেছে, পর দিন কাগজে কী কী খবর থাকবে, ছবি কী হবে। ছবি তুলে অগ্রজকে পাঠিয়েছে, পাঠিয়েছে ‘স্টোরি’র ভাবনা। ক্লান্ত আঙুল মোবাইলে চালিয়ে তখনই লিখে পাঠিয়েছে খবর। বুঝেছে, এটাই, এই আবেগটাই ছটফট করাবে আজীবন খবরের জীবনকে।
ঘটনা-দুর্ঘটনা অহরহ ঘটবে। আর ডেডলাইন মাথায় রেখে, বিপদ পাড়ি দিয়ে খবর, ছবি তুলে আনবেন রিপোর্টার ও চিত্রসাংবাদিক। কে, কত জন কোথায় যাবেন, কী ধরনের খবরে গুরুত্ব দেবেন, সবই পরিকল্পনা করতে হবে ক্ষুদ্রতম সময়ে। কেউ কপি দেবেন ফোনে, কেউ মোবাইলে, দিন শেষে আবার পরিকল্পনা: কী কী খবর হবে, কোথায় যাবে। স্টিফেন হাউসের মতো অগ্নিকাণ্ডে চোখের সামনে কেউ ঝাঁপ দেবেন বাঁচার জন্য, যে কোনও সময় ছুটতে হবে আগুন-রক্তের ঘটনাস্থলে, শবদেহের সারির পাশ দিয়ে যেতে হবে আর কুরুক্ষেত্রে সঞ্জয়ের মতো ধারাভাষ্য দিয়ে যেতে হবে পাঠককে।
তবে খবর-ঘরে আরও এক দল থাকেন, ক্লান্তিহীন ভাবে সংবাদ সংস্থার পাঠানো ক্রিড থেকে বাছাই করে যাঁরা লেখেন দেশ-বিদেশের খবর, ছবি বাছেন, রিপোর্টারের পাঠানো খবর সম্পাদনা করেন, পাতা সাজান, ঠিক করেন কোন খবর ও ছবি কোথায় যাবে। যাঁদের সূচনা-পদ সাব এডিটর।
এক কালের দাপুটে ক্রীড়া সম্পাদক এক শিক্ষানবিশকে বলেছিলেন, “দেখেশুনে নিউজ় ডেস্কে এলি। জেনে রাখ, সারা জীবন কথা শুনবি, ভাল কাজ হলে কেউ প্রশংসা করবে না, কিন্তু একটা শব্দ ভুল হোক, সব আঙুল এই টেবিলের দিকে উঠবে।” মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের শাপমোচন-এ গন্ধর্ব সৌরসেন এবং প্রেমিকা মধুশ্রীকে ইন্দ্রের শাপ-কথা শুনছি: “যাও মর্ত্যে,/ সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে।/ সেই দুঃখে ছন্দঃপাতন অপরাধের ক্ষয়।” শব্দকে ভালবাসলে দুঃখ পেতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ একেই কি বলেছিলেন ‘বিরহের বীণাপাণি’! আর খবরের কাগজকে ভালবাসলে? “তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব।”
জরুরি অবস্থা যে রাতে জারি হল, বর্তমানে এক প্রবীণ, তখন নবীনতম— ছিলেন রাত-ডিউটিতে। বলছিলেন, “দিল্লিতে শুধু একটি সংবাদপত্র জরুরি অবস্থা ঘোষণার কথা ছাপতে পেরেছিল। বাকিদের অফিস দিল্লির বিশেষ এলাকায়, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত করে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। সংবাদ সংস্থাও খবর দিয়েছিল গভীরতম রাতে। রাতে অফিসেই থাকতাম। সকালে দেখি টেলিপ্রিন্টারে কাগজের স্তূপ, ‘জরুরি অবস্থা জারি’! সবাইকে খবর দিলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেরোল টেলিগ্রাম।” তাঁর মনে পড়ছে, রাজ্যের তথ্যমন্ত্রীও অফিসে হাজির হয়েছিলেন, সেন্সরশিপের নিয়ম বোঝাতে। “প্রতিটি সংবাদপত্রকে রোজ দেখেশুনে ছাড়পত্র দেওয়া হত, তবে সন্তোষবাবুর (সন্তোষকুমার ঘোষ) লেখা ওরা বুঝতেই পারত না। শব্দের মারপ্যাঁচ এমন থাকত যে পাঠক পর দিন বুঝতেন, যা বলার সন্তোষবাবু বলে দিয়েছেন।”
১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর খবর-ঘরের দৃশ্য শোনাচ্ছিলেন তৎকালীন এক নবীন। অশান্তি যে হতে পারে, আঁচ আগেই ছিল। হঠাৎ টেলিভিশনে ফ্ল্যাশ: বাবরি মসজিদ ‘ভায়োলেটেড’। প্রাক্তন সহকর্মীটি বলছিলেন, “বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হল। আমাদের রিপোর্টাররা কপি পাঠাচ্ছেন। ম্যাপ, ছবি। বার্তা সম্পাদক এবং সম্পাদক স্বয়ং প্রতিটি কপি পড়ছেন। যাতে সামান্য স্ফুলিঙ্গ কোথাও না ছিটকে যায়।” আর তার পরেই শুরু হল প্রাণঘাতী গোষ্ঠী সংঘর্ষ। প্রাক্তন সহকর্মী বলে চলেন, “আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল দেশ জুড়ে হানাহানির, মৃত্যুর খবর লেখার। দেশের সামগ্রিক অবস্থার কপি লিখতাম। এক সিনিয়র আমার নাম দিয়েছিলেন চিত্রগুপ্ত, মৃত্যুর খতিয়ান রাখছি যে! আমরা তুলে ধরেছিলাম সাধারণ মানুষের অসহায় অবস্থার কথা, মৃত্যুর কথা। কোন ধর্মের কত জন মারা গিয়েছেন, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে, উত্তেজক শিরোনাম লিখে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার কাজ যে আনন্দবাজার করে না, করবেও না, সে শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয়েছিল প্রতি দিন।”
যেমন ৯/১১-র সময় খবর-ঘরে বলা হয়েছিল, “আমরা ইতিহাসের সাক্ষী, যেন সেই উচ্চতায় উঠতে পারি।” সেই উচ্চতায় ওঠার জন্য সংবাদপত্রের খবর-ঘরকে ছোট্ট খোকার মতো মনে হয়। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’ গল্পের শেষে সকলে যখন অপরাধীকে পাকড়ানো খোকাদের পিঠ চাপড়াচ্ছে, দিদিমা বললেন, তাঁর কাছে ‘হিরো’ ঘরে বসে থাকা ছোট্ট ছেলেটি, যে বাইরে গিয়ে দৌড়ঝাঁপ-অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ পায়নি, কিন্তু বাড়ি বসেই সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। বাঙালি পাঠককে একাত্ম করার জন্য যাকে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে খুঁজতে হবে বাংলার মাটি, ‘আপনি দেশ ছেড়েছেন, দেশ আপনাকে ছাড়েনি’ এ-হেন ট্যাগলাইনে চোখ ভরে জল আসা প্রবাসী আর প্রত্যন্ত গ্রামের পাঠকের মগজে হৃদয়ে টোকা দিতে হবে একই ভাবে, দিনের পর দিন। রাত শেষে যার মনে হবে: কোনও স্টোরি মিস হয়নি তো? এই পয়েন্টটা লিখেছি তো? হেডিংটা অন্য রকম করলে হত না?
কিছু ভুল রহিয়া গেল!
ছবি: সুব্রত চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy