Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Jatindramohan Bagchi

নিসর্গ আর মানুষের কবি

যতীন্দ্রমোহন বাগচী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রানুসারী হিসাবে চিহ্নিত, যদিও এই প্রশ্ন বিদগ্ধজন অনেক সময়ই নস্যাৎ করেছেন।

ঈশিতা ভাদুড়ী
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৪৯
Share: Save:

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী !/ আস্তে একটু চল্‌ না ঠাকুর-ঝি/ ওমা, এ যে ঝরা-বকুল। নয়?” গৌরী ঘোষের কণ্ঠে এই কবিতাপাঠ যতীন্দ্রমোহন বাগচীকে চেনার আগ্রহ তৈরি করেছিল। নিঃসঙ্গ অন্ধ গ্রাম্য বধূর বেদনা কোনও কবি এ ভাবে ব্যক্ত করতে পারেন, ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। ‘অন্ধ-বধূ’ কবিতার উল্লেখ করে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “দৃষ্টিহীনা নারীর বেদনা এমনভাবে আমাদের স্পর্শ করে যে, তার পরে যতীন্দ্রমোহনের ক্ষমতার সম্পর্কে কোনো সংশয় থাকে না, কবিতা তো আসলে একটা মাধ্যম, যে মাধ্যমের সাহায্যে কবি পৌঁছাতে চাইছেন তাঁর পাঠকের কাছে, কিন্তু এই ধরনের কবিতা যিনি লেখেন তিনি তো শুধু তাঁর পাঠকের কাছে পৌঁছান না, পাঠকের অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেন।”

যতীন্দ্রমোহন বাগচী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রানুসারী হিসাবে চিহ্নিত, যদিও এই প্রশ্ন বিদগ্ধজন অনেক সময়ই নস্যাৎ করেছেন। মোহিতলাল মজুমদারের মত, “রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা যাঁহারা করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে যতীন্দ্রমোহন অগ্রগণ্য।” অলোক রায় লিখেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের অভিঘাত নিশ্চয়ই তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায়, কিন্তু যতীন্দ্রমোহনের স্বকীয়তাও প্রথমাবধি স্পষ্ট... তাঁর হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে।” কবিতা কবির চিত্তের সারমর্ম, যতীন্দ্রমোহনের কবিতা স্বতোৎসারিত। প্রকৃতির বৈচিত্রের পাশাপাশি জীবনের আনন্দ-বেদনার উপলব্ধিই তাঁর কলমে কবিতার সৃষ্টি করেছে।

যতীন্দ্রমোহনকে কেউ কেউ পল্লিকবি আখ্যাও দেন, তবে তাঁর পল্লি-কবিতা শুধু পল্লিবর্ণনায় পরিণত হয়নি, সেখানে একই সঙ্গে মানুষ ও প্রকৃতি মিশে আছে, হৃদয় ও জীবনের সম্মিলিত উদ্ভাসও। মাটির সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান ছিল অবিচ্ছেদ্য, প্রকৃতিপ্রীতির কারণেই তাঁর কলমে ফুটে ওঠে যথাযথ নিসর্গবর্ণনা। আবার জীবনের অধিকাংশ সময় শহরে থাকার জন্য তাঁর ভাষা পরিশীলিত ও মার্জিত। পল্লিপ্রকৃতির প্রগল্‌ভ ভাবুকতাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। প্রকৃতির বিভিন্ন চিত্রাবলির চমৎকার সংমিশ্রণে জীবনের সুখ-দুঃখের খুঁটিনাটি অনুভূতির প্রকাশে যতীন্দ্রমোহনের কলম নিতান্ত নিজস্ব। এখানেই তিনি রবীন্দ্রযুগের অন্য কবিদের থেকে স্বতন্ত্র, সে জন্যই তাঁর এই ধরনের কবিতা সার্থক।

“ওই যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা ‘আইরি’ খেতের আড়ে/ প্রান্তটি যার আঁধার করা সবুজ কেয়াঝাড়ে,/ পুবের দিকে আম-কাঁঠালের বাগান দিয়ে ঘেরা,/ জট্‌লা করে যাহার তলে রাখাল বালকেরা—/ ওইটি আমার গ্রাম, আমার স্বর্গপুরী,/ ওইখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি...” গ্রামনিসর্গের বর্ণনায় তাঁর ‘জন্মভূমি’ নামের এই কবিতা আজও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সুদক্ষ চিত্রকরের আঁচড়ে শৈশবে ফেলে-আসা গ্রামের অন্তরঙ্গ চিত্রকল্প তিনি নির্মাণ করেছেন এই কবিতায়। আবার ‘আইবুড়ো কালো মেয়ে’ কবিতায় লিখেছেন, “পল্লীর গৃহ, শান্ত রজনী, সাঙ্গ যা-কিছু কাজ,/ ডাকিল জননী— উঠে আয় ননী, চুল বাঁধবি নে আজ?/ চোরের মতন মেয়ে উঠে এসে বাসিল মায়ের ডাকে;/ কথা যাহা কিছু— চিরুনি ও কেশে, দোঁহে চুপ করে থাকে!/ বেড়ে উঠে রাত, দ্বিতীয় প্রহর; চৌকিদারের সাড়া;/ গরিবের বাড়ি, বিধবার ঘর— দিয়ে যায় কড়া-নাড়া;/ শেয়ালের ডাক মিলাইয়া আসে ঝাউ-ভাঙা বালুচরে/ দুইটি শয্যা পড়ে পাশাপাশি নিশীত-নীরব ঘরে।” আইবুড়ো কালো মেয়ের মর্মবেদনা, গরিব বিধবা মায়ের নিদারুণ ব্যথা কবি অদ্ভুত সংবেদনশীল ভাষায় তুলে ধরেছেন।

বাংলা কাব্যে একক নাটকীয় সংলাপ প্রয়োগেও সার্থক এই কবি মূলত কলাবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ করতেন, চিত্রকল্প সৃষ্টি ও চরিত্রের যথার্থ উপস্থাপনায় এই ছন্দ উপযুক্ত। এই ছন্দের মাধ্যমেই কাজ্‌লাদিদি বা অন্ধ বধূর মতো চরিত্র রসোত্তীর্ণ হয়েছে, আবার কর্ণ বা দুর্যোধনের মতো চরিত্রও। ‘কর্ণ’, ‘দুর্যোধন’, ‘ভীম’, ‘অশোক’-এর মতো কবিতায় পৌরাণিক যুগের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তেমনই ‘রাধা’, ‘মথুরার রাজা’ ইত্যাদি কবিতায় বৈষ্ণব যুগের বর্ণনা ও চরিত্রও বিশ্লেষিত হয়েছে।

“উমরাটিপুরে সুবেদার গৃহে সেদিন বাজিছে বাঁশি,/ তানাজী পুত্র রায়বার বিয়ে; প্রমত্ত পুরবাসী;/ নানা আয়োজন, ভারি ধূমধাম;/ নৃত্য ও গীত চলে অবিরাম;/ দাঁড়াইল বর— বাজিল শঙ্খ, জ্বলিল আলোকরাশি—/ এ হেন সময় শিবাজীর দূত সভায় দাঁড়াল আসি...” ‘পাশার বাজী’র মতো কবিতাগুলি পড়ে বোঝা যায়, কাহিনি-কেন্দ্রিক ও ইতিহাসনির্ভর কবিতা লেখায় যতীন্দ্রমোহনের কৃতিত্ব কিছু কম ছিল না। অন্য বহু কবিতাতেই পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে তাঁর কাব্যিক উপস্থাপনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করার মতো।

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর অজস্র কবিতা সঙ্কলিত হয়নি, তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনাও হয়নি সে ভাবে। অথচ তাঁর কবিতার ভাষা আজও আমাদের সমগ্র চেতনাকে মন্থন করে। আজও কবির নাম না জেনেই আমরা গান গেয়ে উঠি— ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই।’ কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বা তরুণ সান্যাল বৃদ্ধ বয়সেও গড়গড় করে মুখস্থ বলতেন “সিংহগড়ের সিংহ গিয়াছে— পড়ে আছে শুধু গড়— / তাই লও মাতা, হারায়ে পুত্র— তানাজী মালেশ্বর…”

প্রচারে না থাকুন, যতীন্দ্রমোহন বাগচী আজও বাঙালির মননে রয়েছেন। ১৮৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর তাঁর জন্ম, আগামী কাল তাঁর জন্মদিন। জন্মের প্রায় দেড়শো বছর পরেও যে কবির কবিতা বা গান আমাদের মুখে মুখে ফেরে, বিস্মৃতি বা অনালোচনার আঁধার তাঁর প্রাপ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যে বাক্য তোমাকে খর্ব করতে চায়, তোমার বাণীর পরমায়ু তার চেয়ে বেশী।” অনেক দিনের পড়ে যাওয়া ধুলোটুকু সরিয়ে অপরিচয়ের ব্যবধানটুকু দূর করার প্রচেষ্টা দরকার আজ।

অন্য বিষয়গুলি:

Jatindramohan Bagchi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy