Advertisement
E-Paper

বিপন্নতা কমানোর দিশা নেই

পরিবেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার ঢেউ উঠছে পর্বতমালা প্রকল্পে পাহাড় জুড়ে রোপওয়ে ও নদী সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব দু’টিকে ঘিরে।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:২২
Share
Save

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের এ বারের বাজেট বক্তৃতা মনে পড়িয়ে দিল প্রায় ৪৫ বছর পুরনো সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের কথা। কংগ্রেস নেতা কমল নাথের বিরুদ্ধে হওয়া এক মামলার রায়ে আদালত ‘পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিন’ উল্লেখ করে বলেছিল— জল, জঙ্গল, সমুদ্রতট বা বাতাসের মতো পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হতে দেওয়ার অধিকার সরকারের নেই; সরকারের দায়িত্ব নেহাত অছি হিসাবে এদের সংরক্ষণ করা। এই সব পরিবেশ বিষয়ে কোনও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তাকে সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী জীবনযাপনের মৌলিক অধিকারের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ বলে ধরতে হবে। সাম্প্রতিক বাজেটে ব্যক্তিগত জঙ্গল তৈরি বা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নদী সংযুক্তিকরণ প্রস্তাবগুলির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের যে কোনও মিল নেই, বুঝতে আইনজ্ঞ হতে হয় না।

শুরুটা অবশ্য অর্থমন্ত্রী করেছিলেন আপাত ভাবে পরিবেশের পক্ষেই; এই প্রথম কোনও বাজেট বক্তৃতার গোড়ায় উঠে এসেছিল পরিবেশের কথা। পরিবেশ দফতরের সার্বিক বরাদ্দ বাড়ানো হল, স্বীকার করা হল জলবায়ু পরিবর্তনই সবচেয়ে বড় বিপদ, বলা হল সরকারের আগামী পরিকল্পনার চার স্তম্ভের অন্যতম হতে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে অ্যাকশন প্ল্যান। কিন্তু শেষে দেখা গেল, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অ্যাকশন প্ল্যানের সরাসরি রূপায়ণের জন্য অর্থমন্ত্রী আগের বছরের মতোই মাত্র ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন, মোট বাজেট বরাদ্দের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগেরও কম!

অর্থমন্ত্রীর কথায়, স্বাধীন ভারত যখন ১০০ বছরে পা দেবে, তখন আমাদের জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ ভাগ শহরে থাকবেন; ফলে তেমন পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই পরিকল্পনা করতে হবে পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে। জানানো হল গণপরিবহণের উপর গুরুত্ব বাড়বে, তৈরি হবে ‘স্পেশাল মোবিলিটি জ়োন’, যেখানে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য পুড়িয়ে গাড়ি চালানো যাবে না; জোর দেওয়া হবে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির উপর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গ্লাসগো অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮০ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ তৈরির জন্য ১৯,৫০০ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে, বড় ব্যবসায়িক বাড়ি বা অঞ্চলগুলিতে বিদ্যুতের অপচয় বন্ধ করার কথাও বাজেট বক্তৃতায় জায়গা পেয়েছে। দূষণ কমাতে গঙ্গার দু’পাশে পাঁচ কিমি অবধি রাসায়নিক সার বাদ দিয়ে চাষবাস করার কথা বলা হল, যদিও এমন প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত, প্রশ্ন উঠছে।

সৌরশক্তি বা ‘ইলেকট্রিক ভেহিকল’কে বহুলাংশে বাড়ানোর মতো প্রস্তাব আপাতদৃষ্টিতে হাততালি পেলেও, তাদের পিছনে বাজারের ছায়া স্পষ্ট। বাজার পরিবেশকেন্দ্রিক উন্নয়নের একটি বড় চালিকাশক্তি, সন্দেহ নেই; কিন্তু তা করতে গিয়ে বাজারটাই মুখ্য আর পরিবেশ গৌণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে! আশঙ্কার দোলাচল পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়াকে দ্রুততর ও সহজতর করার প্রস্তাব নিয়েও। ‘ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস’-এর নামে ইতিমধ্যেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলিকে নিধিরাম সর্দার করে দেওয়া হয়েছে। নয়া ফরমানে তাদের আরও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা! দেশের পরিবেশ আইনগুলিকে ক্রমেই নির্বিষ করে তোলা, পরিবেশ আদালতগুলিকে ভেঙে ফেলার উপক্রম করা, এ বারের বাজেটে বায়ুদূষণ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপের সঙ্গে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার প্রস্তাবের যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। মনে করাচ্ছেন, তিন বছর আগের বাজেটে বিপুল বরাদ্দ ঘোষণা করে ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম ঘোষিত হলেও দেশের অর্ধেকের বেশি দূষিত শহরেই প্রয়োজনীয় দূষণ তথ্য নেই; বাজেটে প্রস্তাবিত বিপুল পরিকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে যে দূষণ আরও বাড়বে, তা-ও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সন্দেহ বাড়ছে ব্যক্তিগত বনাঞ্চল করার নামে জঙ্গল দখল বাড়বে কি না, তা নিয়েও।

কিন্তু পরিবেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার ঢেউ উঠছে পর্বতমালা প্রকল্পে পাহাড় জুড়ে রোপওয়ে ও নদী সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব দু’টিকে ঘিরে। উত্তরাখণ্ডে চারধাম প্রকল্পে রোপওয়ে তৈরি করতে গিয়ে পাহাড় ও পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছিল, হিমালয় জুড়ে নতুন রোপওয়ে তৈরিতে সেই বিপদের সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। অন্য দিকে, কেন-বেতোয়া নদী সংযুক্তিকরণের জন্য ৪৪,৬০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও এখন এই প্রকল্পটি চূড়ান্ত অরণ্য সংক্রান্ত ছাড়পত্র পায়নি; বরং সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি ৬০০০ হেক্টরের উপর বিস্তৃত বাঘ অধ্যুষিত পেঞ্চ অরণ্যকে ধ্বংস করে এই প্রকল্প না করার পক্ষেই তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের কাছে।

আসলে পরিবেশের ক্ষেত্রে, তথাকথিত উন্নয়নকে গতিশীল করতে বাজেটে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়; বাকিটা যোগ-বিয়োগে হিসাব মেলানোর খেলা। এটা নতুন নয়। নতুন হল, এ বারের বাজেটে এই দিশাহীনতার সঙ্গে
যুক্ত হয়েছে বাজার অর্থনীতির পক্ষপাতিত্বের বিপদ ও নিয়ম ভেঙে প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ডেকে আনার বিপন্নতা।

Union Budget 2022

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}