ভারতে ফিল্ম সেন্সরশিপের ইতিহাস ঘাঁটলে কার্ল মার্ক্সের কথাগুলো মনে পড়তে বাধ্য—ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে প্রথম বার তৈরি হয় বিষাদপালা বা ট্র্যাজেডি, তার পর প্রহসন বা ফার্স। ২০২২ সালের মার্চে আমরা পৌঁছে গেলাম স্বাধীন ভারতে চলচ্চিত্র আইন তৈরির সত্তর বছরে। এই ঐতিহাসিক তথ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিষাদগাথা। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি নতুন সংবিধানেরই ১৯(১)(ক) ধারায় নাগরিকদের দেওয়া হয়েছিল মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। অবশ্য দেড় বছরের মধ্যেই, ১৯৫১ সালের জুন মাসে, সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে সেই স্বাধীনতার পায়ে ‘যুক্তিসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ’-এর বেড়ি পরানো হল, ১৯(২) ধারাটি জুড়ে। তবে মতপ্রকাশের জন্য অগ্রিম ছাড়পত্র নিতে হবে, এ কথা বলা হয়নি। কিন্তু ১৯৫২ সালের মার্চে চলচ্চিত্র আইনে সিনেমাকে কার্যত নিয়ে আসা হল এই মৌলিক অধিকারের বাইরে। ১৯৫২ সালের আইনটি তৈরি হয় ব্রিটিশ আমলের চলচ্চিত্র আইন ১৯১৮-র আদলে, যে আইনের সূত্রে ভারতে চলচ্চিত্রের উপর প্রাক্-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সূচনা— মুক্তির আগেই ছবির প্রদর্শনযোগ্যতা বিচার করার জন্য। তবে ব্রিটিশ আমলে নাটকের ঘাড়েও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রাক্-নিয়ন্ত্রণের জোয়াল, লেখালিখি আর খবর পরিবেশনের উপরেও এসেছে নানা ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু স্বাধীন ভারতের সংবিধান চালু হওয়ার পরে দ্রুত সেই সব নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম চলচ্চিত্র— যা একই সঙ্গে সাংবিধানিক অসঙ্গতির অনন্য নিদর্শন, আর ইতিহাসের ট্র্যাজিক পুনরাবৃত্তি। এ রকমই কিছু হতে চলেছে, তা বোঝা গিয়েছিল ১৯৫১-তে, যখন আগের পাঁচটি প্রাদেশিক পর্ষদের জায়গায় একটি কেন্দ্রীয় পর্ষদ গঠন করার পরে সরকারের কর্তারা আশ্বাস দিলেন একটি যুগোপযোগী আইনের।
১৯১৮ সালের আইন-মাফিক পাঁচটি প্রাদেশিক সেন্সর পর্ষদ গঠনের সময় ঔপনিবেশিক সরকার দর্শকদের নিরাপত্তা, নৈতিকতা আর মানসিক স্বাস্থ্যের দোহাই দিলেও আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক— আমেরিকা, সোভিয়েট, আর মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ডের ছবির হাত ধরে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদের কথা যেন ভারতীয় প্রজাদের কাছে না পৌঁছয়। ১৯৫২-র আইনে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার হিসেবে চলচ্চিত্রের সেন্সরব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দেওয়া হল। ঠিক তখনই না-হলেও ১৯৫৯ সালে এই আইন সংশোধনের সূত্রে বোঝা গেল যে, স্বাধীন ভারতেও সেন্সরশিপের উদ্দেশ্যটা রাজনৈতিক— ছবি মুক্তির আগে সেন্সর পর্ষদ দেখবে সেটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে কি না, রাষ্ট্রযন্ত্রকে উৎখাত করার কথা বলছে কি না, বিচারব্যবস্থার সমালোচনা করছে কি না, হিংসাত্মক কাজে উৎসাহ দিচ্ছে কি না, আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে বিপজ্জনক বক্তব্য আছে কি না, অথবা সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত করবে কি না। এর সম্ভাবনা থাকলে ছবিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের নিদান দেওয়া হল, দরকারে নিষেধাজ্ঞা জারিরও ব্যবস্থা হল।
১৯৭৩ সালে আইন সংশোধন করে জানানো হল যে, সেন্সর পর্ষদ আরও দেখবে কোনও ছবি ভারতের সার্বভৌমত্ব আর অখণ্ডতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কি না। প্রতি বারই অবশ্য ইতি গজ হিসেবে ছিল শালীনতা আর নৈতিকতার কথাও। ফিল্ম সেন্সরশিপ নিয়ে আলোচনায় আর বিতর্কে বহু দিন প্রাধান্য পেয়ে এসেছে শেষের দু’টি বিষয়ই। এগুলির জন্যে সেন্সর পর্ষদের বেঁধে দেওয়া গণ্ডি লঙ্ঘনকেই ধরা হয়েছে সাবালকত্বের লক্ষণ। রাজনৈতিক কারণে সংশোধন আর নিষেধাজ্ঞাগুলি যেন ‘স্বাভাবিক’ প্রশাসনিক পদক্ষেপ। মজার ব্যাপার, যে যে কারণে সিনেমাকে নজরবন্দি করার কথা চলচ্চিত্র আইনে বলা হয়েছে, সে সব সংবিধানের ১৯(২) ধারারই পুনরাবৃত্তি।
উদ্দেশ্য এক হলেও ১৯১৮ সালের আইন আর ১৯৫২ সালের আইন প্রণীত হয়েছে দু’টি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯১৮ সালের আইন এসেছিল ব্রিটিশ শাসনের অন্তিম পর্বে, যখন থেকে শুরু হয়েছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় বিক্ষোভ-সংঘর্ষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ শক্তিও তখন কিছুটা হীনবল। ঔপনিবেশিক সরকার চায়নি এমন কোনও ছবি এ দেশে দেখানো হোক, যা ভারতীয় প্রজাদের মনে উপনিবেশবাদ-বিরোধী আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেবে, তাদের অন্য কোনও মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করবে। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় প্রজাদের কোনও নাগরিক অধিকার ছিল না, তাই ১৯১৮ সালের আইন কোনও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ১৯৫২ সালের আইন আনা হল নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার চালু হওয়ার পরে। স্বাধীন ভারতের সেই উষালগ্নে নাগরিকদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি তখন ভাবা হচ্ছে আদর্শ নাগরিক হিসাবে তাদের চরিত্র-গঠনের কথাও। সামাজিক পরিসরে এত দিন সিনেমা কী হতে বা করতে চেয়েছে, এই সব প্রশ্ন ছাপিয়ে নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে জরুরি হয়ে উঠল সিনেমাকে কী হতে হবে, এই প্রশ্নটি। ভাষা আর জাতিগত বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যসাধনের সরকারি পরিকল্পনার পরিপূরক হিসেবে অনেকগুলো দায় চাপল সিনেমার উপর— তাকে হতে হবে তথ্যের বাহন, গণশিক্ষার মাধ্যম, মনোরঞ্জনের উপাদান এবং সামাজিক স্বাস্থ্যরক্ষার হাতিয়ার। সেই ‘সদর্থক’ ভূমিকা পালনে সিনেমা যাতে অবিচল থাকে, তার জন্যেই নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার: এই যুক্তিতে ব্যতিক্রমী আইনটির পক্ষে তৈরি করা হল নাগরিক সম্মতি। আধিকারিকদের তত্ত্বাবধানে নব-কলেবরে সেন্সর পর্ষদ গঠিত হল, নিয়মাবলি আর নির্দেশিকাও তৈরি হল, সবই নাকি নাগরিকদের ভালর জন্য!
১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জি ডি খোসলাকে দিয়ে সেন্সরব্যবস্থার পর্যালোচনা করাল। তাঁর তিনটি মূল পর্যবেক্ষণ— আইনের বিচারে চলচ্চিত্র-নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলি আর নির্দেশিকার অনেক কিছুই ধোপে টিকবে না; সে সবের প্রয়োগও যুক্তিসঙ্গত ভাবে হয় না; আর সেন্সর পর্ষদে নিয়োগ বা মনোনয়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যোগ্যতামান বা নীতি নেই। ফলে সেন্সরব্যবস্থা মূলেস্থূলে ত্রুটিপূর্ণ। ১৯৬৯ সালে খ্বাজা আহমেদ আব্বাস বিষয়গুলি উল্লেখ করে সেন্সরব্যবস্থার সাংবিধানিক অসঙ্গতির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ১৯৭০ সালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ অবশ্য বলল, ভারতের সামাজিক পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রে প্রাক্-অনুমোদন ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে।
বিষাদগাথা দ্রুত এগিয়ে চলল প্রহসনের দিকে। ১৯৮৩-তে আর এক বার চলচ্চিত্র আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় সেন্সর পর্ষদের নাম পাল্টে রাখা হল কেন্দ্রীয় সার্টিফিকেশন পর্ষদ। এটা করা হল শ্যাম বেনেগালের নেতৃত্বে গঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ফিল্ম পলিসির ১৯৮০ সালের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। সিনেমা নিয়ে একটি সর্বাত্মক নীতি নির্ধারণের কথা বলেছিলেন তাঁরা। এর মধ্যে ছিল সেন্সরব্যবস্থাকে উদার এবং যুগোপযোগী করার প্রস্তাবও। কিন্তু সার্টিফিকেশন পর্ষদ পূর্বতন সেন্সর পর্ষদের মতোই কাজ করে চলেছে। অথচ সার্টিফিকেশন আসলে ছবির বিষয়, দৃশ্যগত উপাদান, ভাষাব্যবহার আর সম্ভাব্য প্রভাবের ভিত্তিতে সেটি কোন রকম দর্শকের জন্য উপযুক্ত, সে বিষয়ে মূল্যায়নের উপায়— কাটাছেঁড়া বা আটকানো নয়। যত দিন যাচ্ছে, এই হাঁসজারু ব্যবস্থার ছাড়পত্র পাওয়া ছবি দেখানো নিয়ে জটিলতা বেড়েই চলেছে। যে ব্যবস্থায় প্রযোজক-পরিচালক আর সার্টিফিকেশন পর্ষদ মূল দুই পক্ষ, এখন তাদের ছাপিয়ে সক্রিয় হচ্ছে সরকার-সহ নানা স্বার্থান্বেষীর দল। তাদের সঙ্গে শিল্প বা মনোরঞ্জনের যোগ নেই। লক্ষ্য শুধু, ক্ষমতা দেখানো।
এই অরাজকতা নির্মূল করার জন্য ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মুকুল মুদ্গলের নেতৃত্বে একটি কমিটি ১৯৫২ সালের আইনের জায়গায় একটি নতুন আইনের সুপারিশ করে। ২০১৬ সালে শ্যাম বেনেগালের নেতৃত্বে আর একটি কমিটি তৈরি হয় পরামর্শ দিতে। সার্টিফিকেশনের একটি বিস্তারিত রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে বেনেগাল কমিটি বলে: মূল্যায়নের বাইরে ছবি কাটাছেঁড়ার কোনও অধিকার পর্ষদের থাকবে না। তবে অনিবার্য পরিস্থিতিতে ছবির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো যাবে সংবিধানের ১৯(২) ধারা প্রয়োগ করে।
২০১৭ সালের এপ্রিলে অমোল পালেকর সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানান, বেনেগাল কমিটির সুপারিশ মেনে সিনেমা-হলে দেখানো ছবির ব্যাপারে সার্টিফিকেশন চালু করার জন্য আদালত সরকারকে নির্দেশ দিক। তাঁর যুক্তি, এই সেন্সরব্যবস্থা এখন অচল— যে হেতু ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সিনেমা-হলের বাইরেও সব কিছুই বিপুলসংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছয়। প্রচলিত ব্যবস্থা কেবল বৈষম্য তৈরি করছে, যা সংবিধানের পরিপন্থী। চার বছর হতে চলল মামলার ফয়সালা হয়নি, নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগও হয়নি।
সত্তর বছরে সিনেমার ক্ষেত্রে ভারতীয় রাষ্ট্র তার কর্তৃত্বপরায়ণ আর দমনমুখী ভূমিকার অবসান চায়নি। বিশ্বায়ন আর উদারীকরণের যুগেও কথাটা সত্যি। — প্রহসন কিন্তু জমে উঠছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy