জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখা চাই, এই যুক্তিতে কেরলের হাই কোর্ট একটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিল। ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২২ বিচারপতি জেএম নাগরেশ এই রায় দেন। ফলে ওই চ্যানেলের লাইসেন্স বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছিল, তা বহাল রইল। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ হাই কোর্টের আরও বড় একটি বেঞ্চের কাছে আপিল করেছে। কিন্তু এই মামলাটি আমাদের মনোযোগ দাবি করে, কারণ এর প্রভাব পড়তে পারে ব্যক্তি এবং কর্পোরেশনের নাগরিক স্বাধীনতার উপর।
সাংবাদিকতার জন্য দীর্ঘ দিন কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে এই বিশেষ চ্যানেলটি। ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা বিশদে রিপোর্ট করার পরে আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য সম্প্রচার বন্ধ হয় ওই চ্যানেলের। যখন সম্প্রচার করার লাইসেন্স পুনর্নবীকরণের সময় আসে, তখন যে হাজার বাধা খাড়া করা হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী। কোনও সরকারই কি আর ‘গণতন্ত্রের বাড়াবাড়ি’ পছন্দ করে? কিন্তু লাইসেন্স দিতে আপত্তির কারণ হিসেবে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ উল্লেখ করাতেই যে ভাবে কেরল হাই কোর্ট কার্যত ‘সেন্সর’ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিল, সেটা বেশ বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
বেদের অংশ ‘অত্রিসংহিতা’ উদ্ধৃত করে বিচারপতি জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বকে মনে করালেন এবং বললেন যে কেন্দ্রীয় সরকার
মুখবন্ধ খামে যে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছে, তাতে তিনি লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ না করার যুক্তিতে সন্তুষ্ট। বিচারপতি এমনও বলেন যে, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ন্যায়ের (ন্যাচারাল জাস্টিস) ভূমিকা খুবই সীমিত। এই পর্যবেক্ষণ কেবল যে আইনের চোখে প্রশ্নযোগ্য তা-ই নয়, তা সুপ্রিম কোর্টের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণেরও বিপরীতে যায়। গত বছর পেগাসাস ফোন ট্যাপিং মামলায় প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা বলেছিলেন, “জাতীয় সুরক্ষার উল্লেখ করলেই বিচারব্যবস্থা মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে না। জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই আদালত ঢুকতে চায় না, কিন্তু কোনও বিষয়কে বিচারব্যবস্থার বিবেচনা থেকে সম্পূর্ণ বাইরে রাখা যায় না... কেবলমাত্র জাতীয় নিরাপত্তার উল্লেখ করে রাষ্ট্র আদালতকে মূক দর্শকে পরিণত করতে পারে না।”
এই মামলায় কেরল হাই কোর্ট বলেছে যে, সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণের উপর এ ক্ষেত্রে নির্ভর করা চলে না, কারণ একটির প্রসঙ্গ ছিল ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার (রাইট টু প্রাইভেসি)। কেরল হাই কোর্টের এই বক্তব্য যৌক্তিকতার সমস্ত শর্তকে লঙ্ঘন করে। যদি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার (প্রাইভেসি) অধিকারে হস্তক্ষেপের চেষ্টার ঢাল হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তাকে ব্যবহার না করা যায়, তা হলে বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের জন্য তাকে ব্যবহার করা যাবে কী করে? কী করেই বা একটি সংবাদসংস্থার কয়েকশো কর্মীর জীবিকা খারিজ করে দেওয়া যাবে, তাদের সংস্থাকে বক্তব্য রাখার কোনও সুযোগ না দিয়েই? দার্শনিক জন লক বলবেন যে, জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার হল মানুষের অস্তিত্বের মৌলিক দিক, যা থেকে কখনওই ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। করতে হলে অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত, যুক্তিসঙ্গত উপায়ে হতে হবে।
মেনকা গান্ধী বনাম ভারত সরকার মামলা-সহ বেশ কয়েকটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিয়েছে যে, নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘনের সময়ে স্বাভাবিক ন্যায় (ন্যাচারাল জাস্টিস) অতিক্রম করলে তা কেবলমাত্র অন্যায্য পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য সরকারের সিদ্ধান্তকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করবে। তাই অপর এক আদালতই যখন বহু বছরের প্রতিষ্ঠিত ধারা থেকে অনেকখানি সরে এসে— গৌতম ভাটিয়ার মতো বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ‘বন্ধ খামের দ্বারা সেন্সরশিপ’ জারি করে, তখন তা স্ববিরোধী বলে মনে হয়— যেন এই রায় দেশের শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্তকে বিদ্রুপ করছে।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি এই অতিরিক্ত গুরুত্ব, এমনকি স্বাভাবিক ন্যায়ের চাইতেও তাকে বড় করে দেখার কিছু অতীত দৃষ্টান্ত বিচারব্যবস্থায় নেই, এমন বলা যায় না। সুপ্রিম কোর্ট এক বার ২০১৫ সালে (এক্স-আর্মিমেন প্রোটেকশন সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড বনাম ভারত সরকার) এবং আর এক বার ২০১৯ সালে (ডিজি কেবল নেটওয়ার্ক প্রাইভেট লিমিটেড বনাম ভারত সরকার) এমনই দু’টি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যে দু’টির ভিত্তি ছিল ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডের হাউস অব লর্ডসে গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত। তবে দুর্ভাগ্যবশত এ ক্ষেত্রে হাউস অব লর্ডসের এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য সুপ্রযুক্ত কি না, সে বিষয়ে দু’টি কারণে প্রশ্ন থেকে যায়। এক, ব্রিটেনের সাংবিধানিক রীতি ভারতের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। তাদের সংবিধান অলিখিত এবং সেখানে সংসদের সার্বিক ক্ষমতার উপর নির্ভরতা অনেক বেশি।
দুই, যেখানে মৌলিক অধিকার ভঙ্গের প্রশ্ন এসেছে, সেখানে ভারতীয় আদালতগুলি বহু বছর ধরে বিচারব্যবস্থার উপর নির্ভরতার সুযোগ রেখেছে অনেক বেশি। আদালতের উপরেই তাঁরা ভার দিয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান এবং সামঞ্জস্য বজায় রাখার। এর ফলে ভারতে আদালত কখনও কখনও সক্রিয় হয়ে ক্ষমতার বিভাজনকে অগ্রাহ্য করে নীতির ক্ষেত্রেও প্রবেশ করেছে, যেখানে ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টার মডেল বরাবর ক্ষমতার বিভাজনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এই ধরনের পার্থক্যকে পাশ কাটিয়ে কেরল হাই কোর্ট ২০১৫ সালের রায়ের খাপে ধরাতে চাইছে মিডিয়াওয়ান মামলার প্রশ্নগুলিকে। কিন্তু তাতে সর্বাধিক বিপন্ন হচ্ছে মৌলিক এবং মানবিক অধিকার, ন্যায়ের ধারণা, সকল পক্ষকে সমান সুযোগ দানের ধারণা, এবং গণতন্ত্রের আদর্শ।
বাক্স্বাধীনতার তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা বলেন যে মন খুলে কথা বললে আইনি, বা আইন-বহির্ভূত আঘাত আসতে পারে, শাস্তি হতে পারে, এই আশঙ্কার পরিণাম অনেক সময়ে মানুষকে চুপ করিয়ে দেয় (‘চিলিং এফেক্ট’)। গোটা বিশ্বেই এখন বিরোধী কণ্ঠের প্রতি অসহিষ্ণু ভাব ক্রমশ বাড়ছে। রাষ্ট্র কী ভাবে স্বতন্ত্র কণ্ঠকে বাক্রুদ্ধ করছে, তা-ও আমরা দেখছি। কিন্তু আলোচ্য মামলার মতো ঘটনা আমাদের আরও বেশি বিচলিত করে। মনে হয়, এমন রায় দিয়ে সমালোচকের কণ্ঠরোধের এই পরিবেশকে আরও যেন ঘনীভূত করে তুলছে বিচারবিভাগ। তাদের বিচারের মূলে যেন কাজ করছে সেই আদ্যিকালের ধারণা— রাজার কখনও ভুল হয় না। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও এই ভ্রান্ত ধারণাকে মেনে নেওয়া চলে কি?
এটা অবশ্যই চতুর্থ স্তম্ভের উপরে প্রথম আঘাত নয়, একটা আস্ত ইমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থা আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। এ বারেও এটাই যে শেষ আক্রমণ হবে না, তা-ও নিশ্চিত। কিন্তু যে ভাবে জাতীয় নিরাপত্তার উল্লেখমাত্র রাষ্ট্রের কাছে একক বিচারপতির বেঞ্চ নতিস্বীকার করল, তার ভিত্তিহীনতা আমাদের আঘাত করতে বাধ্য। আশা কেবল এই যে, পরবর্তী পর্যায়গুলিতে বিচারব্যবস্থা তার শক্তিমত্তা ফিরে পাবে। ভারতের গণতন্ত্রের উপর যে সব প্রশ্নের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকবে, সেগুলির অর্থপূর্ণ আলোচনা হবে আদালতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy