Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
বন্ধুত্বে বিশ্বাস, আবার
Amartya Sen

নানা মতের কথোপকথনে যখন মন নমনীয় আর সহিষ্ণু হয়

অমর্ত্য সেনের বইটি আমাদের বন্ধুত্বে ও কথোপকথনে আবার বিশ্বাস রাখতে বলে। বলে বন্ধুত্বে বিশ্বাস হারানো পাপ।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২১ ০৫:১৮
Share: Save:

এ দেশের রাজনীতিতে এখন যে কোনও নাগরিকের পরিচয়ের প্রসঙ্গটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এমনিতে পরিচিতিকে অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই। তবে কোনও একটি পরিচিতিকে গ্রহণ করলেই যে অন্য সব বাদ দিয়ে নিজেকে বিশেষ কোনও ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্‌’ পরিচিতির খোপে ঢুকিয়ে রাখতে হবে এই সঙ্কীর্ণতায় বিশ্বাস করা ভাল নয়, অথচ সেটাই এখন ভারতে অনেকের দস্তুর। পরিচিতির এই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্‌’ উগ্রবাদে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন বিশ্বাস করত না, বিশ্বাসী ছিল না পুরনো ভারতও। অমর্ত্য সেনের স্মৃতিগ্রন্থ পড়তে পড়তে এ কথা আবার মনে হল।

১৯৪১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ হল অমর্ত্য সেন তখন বছর আটেকের বালক, পড়াশোনা করছিলেন ঢাকার ইস্কুলে। এর কিছু দিন পরেই তিনি চলে আসবেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথ নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শের শিখা সেখানে জ্বালিয়ে রেখেছেন ক্ষিতিমোহন সেনের মতো মানুষেরা। অমর্ত্য তাঁর ইংরেজি স্মৃতিকথায় শান্তিনিকেতনের ইস্কুলকে প্রাচীরবিহীন বিদ্যালয় বলে চিহ্নিত করেছেন। পাঁচিল-ছাড়া এই ইস্কুলে যা শিখেছিলেন তিনি, কবুল করেছেন, তা আজীবন কাজে লেগেছিল।

এই ইস্কুল তাঁকে কী শিখিয়েছিল? শিখিয়েছিল মানুষের পরিচয় কোনও একটা খোপের মধ্যে আটকে থাকে না। মানুষকে চেনা-বোঝার জন্য কোনও এক রকম মূল্যায়ন পদ্ধতিও যথেষ্ট নয়। এই দুই মূল্যবোধ যে বেদবাক্যের মতো প্রতিমুহূর্তে শান্তিনিকেতনে ঘোষণা করা হত তা নয়, তবে ইস্কুলের পরিবেশে ও কাজকর্মে তা দিব্য টের পাওয়া যেত। অমর্ত্য লিখেছেন, শান্তিনিকেতনে পরীক্ষার নম্বর দিয়ে মেধা বিচার করা হত না। অন্যান্য কাজ ও দক্ষতার উপরেও গুরুত্ব দেওয়া হত। অনেক সময় বেশি নম্বর পেত যারা তারা মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিল না। শান্তিনিকেতনে তাঁর সহপাঠী মঞ্জুলা সম্বন্ধে এক শিক্ষকের কৌতুককর মন্তব্য মনে পড়ে। তাঁকে এক শিক্ষক বলেছিলেন, “জানো ও সত্যি নিজের মতো চিন্তা করতে পারে, আবার পরীক্ষাতেও ভালো ফল করে।” এই যে পরীক্ষায় ভাল ফল করাকে আমরা অনেকে পড়ুয়াদের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ পরিচিতি’ বলে মনে করি, এখানে সেটাকে অস্বীকার করা হত।

পাঠভবনের অঙ্কের মাস্টারমশাই জগবন্ধুদা ক্লাসঘরের বাইরে নিজের বাড়িতে অমর্ত্যকে অঙ্কের অন্যতর যুক্তির কথা বলতেন। পরে ট্রিনিটি কলেজে তিনি যখন গাণিতিক মডেলের সাহায্যে যুক্তিনির্মাণ বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন তখন বুঝতে পারছিলেন জগবন্ধুদার সেই সব কথার গুরুত্ব, সেই গাণিতিক যুক্তির প্রাথমিক শিক্ষা না-থাকলে উচ্চতর গণিতের জগতে প্রবেশ কঠিন হত। জগবন্ধুদা ছাঁচভাঙা মাস্টারমশাই, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের পরিচিত ছাঁচকে তিনি যেমন ভেঙেছেন, তেমনই ভেঙেছেন পাঠ্যসূচির পাঁচিল। কাজেই পাঁচিল-ছাড়া ইস্কুল কথাটি সে কালের শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে বিবিধার্থে সত্য। কেবল গাছতলায় প্রকৃতির মধ্যে ক্লাসই হত না, আত্মপরিচয়ের ও জীবনচর্যার সঙ্কীর্ণ প্রাচীর ভেঙে পড়ত।

শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটির দিকে ঝুঁকে পড়ে অমর্ত্যের মন। লেখেন বন্ধুত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে চান না তিনি, শুধু বলতে চান ভালবাসার মস্ত ছাতার তলায় বন্ধুত্বের ঠাঁই। আর দু’জনের ঐকান্তিক প্রেমের থেকে বন্ধুত্ব গোত্রে আলাদা। খেয়াল করলে দেখা যাবে অমর্ত্য সেনের ইংরেজি স্মৃতিকথায় বার বার এসেছে তাঁর বন্ধুদের কথা, নানা প্রসঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ কথাটি ফিরে ফিরে আসে। শুধু শান্তিনিকেতনের ছেলেবেলার বন্ধুদের কথাতেই নন, দেশ-বিদেশের বড়বেলার বন্ধুদের কথায় নানা প্রসঙ্গে তিনি সহজ ও অনর্গল। কিন্তু কেন?

এমনিতে মনে হতে পারে অর্থহীন এই প্রশ্ন। বর্ণময়, বহুদর্শী মানুষের স্মৃতিকথায় বন্ধুপ্রসঙ্গ তো অনিবার্য, সেই সূত্রেই হয়তো তাঁদের উল্লেখ করেছেন। এই উত্তর ‘ভুল’ নয়। তবে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে চৈতন্যদেব ও রায় রামানন্দের কথোপকথনের যে বিবরণ আছে তাতে প্রশ্ন ও উত্তরের নানা স্তর। চৈতন্যদেব রায় রামানন্দকে বলেছেন কোনও উত্তর নিতান্ত ‘বাহ্য’, কোনও উত্তর এটাও ‘হয়’ তবে এটাই ‘সর্বোত্তম’ নয়। এই ভাবে শেষ অবধি প্রকৃত প্রশ্ন ও উত্তরের দিকে পৌঁছে গিয়েছে তাঁদের কথোপকথন। এ ক্ষেত্রেও মনে হয় দীর্ঘ দিন ধরে পরিচিতি (identity)-র প্রসঙ্গটিকে যে ভাবে নানা
দিক থেকে বিচার করছিলেন অমর্ত্য, এখানেও ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধুবৃত্তের বিবরণে সেই পরিচিতির দর্শন ও রাজনীতিকেই আর এক দিক দিয়ে স্পর্শ করলেন।

‘বন্ধু ও বন্ধুবৃত্ত’ অধ্যায়ে কত জনের কথাই যে এল। নানা দেশের, নানা মহাদেশের মানুষ তাঁরা। তাঁদের রুচি ও সংস্কৃতির ভিন্নতা স্বাভাবিক। কেউ উদার, কেউ তুলনায় রক্ষণশীল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকাগ্রস্ত জাপানের ছেলে চাকো-কে বন্ধুরা ‘রক্ষণশীল’ বলেই মনে করতেন। অমর্ত্য তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন, জাপানি বন্ধু স্বদেশের সেনাবাহিনীর দানবীয় কাজকর্মকে যুদ্ধ-অপরাধ হিসাবেই বিচার করতে চান, তাঁর কাছে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণও ‘ওয়ার ক্রাইম’, যুদ্ধই এমন অপরাধের কারণ। বন্ধুবৃত্তে কথা বলার সূত্রে দু’টি বিষয় স্পষ্ট, মানুষের দেশ-কাল-জাতিগত পরিচয় তার কথার ভিত্তি ও প্রেক্ষিত নির্মাণ করে, তা স্বীকার করেই কথা বলে যেতে হবে। বন্ধুতার অর্থ তো কথা বিনিময়, ভালবাসার বৃহত্তর ছাতায় যে বন্ধুতার আশ্রয় সেই বড় ছাতায় প্রেমিক-প্রেমিকা সুলভ ঐকান্তিকতা যেমন থাকে না তেমনই কণ্ঠরোধকারী অধিকারবোধও থাকে না। ফলে কথা চালানো সহজ। বন্ধুত্বের পরিচয়টি যেন খোলা উঠোনের মতো, চেপে বসে না, অন্য স্বভাবের সহচরকে অপরিচয়ের দূরত্বে ঠেলে দেয় না কিংবা পরিচয়ের সঙ্কীর্ণতায় অপরকে বাদ দেয় না। চাকোর সঙ্গে কেবল যুদ্ধ নিয়ে নয়, বৌদ্ধ ধর্ম নিয়েও কথা বলতেন, সেই বৌদ্ধধর্ম কোরিয়ার পথ বেয়ে যা প্রবেশ করেছিল জাপানে। দু’জন দু’রকম হলেও যে চলতে পারে সংলাপ তার বড় উদাহরণ অমর্ত্যের মতে গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন-ইস্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে কোনও কোনও সন্ধেবেলায় গাঁধী-রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য নিয়ে আলোচনা হত। অমর্ত্য রবীন্দ্রপন্থী, বৈজ্ঞানিক যুক্তিপন্থাতেই তাঁর মতি। তবে যে ভাবে গাঁধী কায়িক শ্রমের গুরুত্বকে স্বীকার করেছিলেন এবং কায়িক শ্রমের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের অবতলবর্তী মানুষদের সঙ্গে সহিতের ভাব (‘টুগেদারনেস’) বিনিময় করতে চেয়েছিলেন, তা অমর্ত্যকে গাঁধীর প্রতি আগ্রহী করে তোলে। এও তো নিজের পরিচয়ের সীমাকে অতিক্রমের চেষ্টা। তাঁর শিক্ষক পিয়েরো স্রাফার কাছে অমর্ত্য জেনেছিলেন, লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনেরও ছিল কায়িক শ্রমের প্রতি গভীর আগ্রহ। ভিটগেনস্টাইন তাঁর অনুজ ‘বন্ধু’ স্রাফাকে কায়িক শ্রমের প্রতি তাঁর আগ্রহের কারণ নিয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন।

এই যে বন্ধুবৃত্তে চলাচলকারী মন, তা নমনীয় ও সহিষ্ণু। নমনীয়তা ও সহিষ্ণুতা না থাকলে তো সংলাপ চালানো অসম্ভব। শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকটি অমর্ত্যের খুব প্রিয়। এই নাটকের অন্যতম মুখ্য চরিত্র বসন্তসেনা তাঁকে খুবই আকর্ষণ করে। কারণ এই নাটক শেখায় এক জন মানুষের থাকতে পারে আত্মপরিচয়ের নানা রূপ, বিদগ্ধ বসন্তসেনা তো তারই নিদর্শন বহন করছেন। চারুদত্তের প্রেমিকা বসন্তসেনা, জনপদবধূ বসন্তসেনা, নমনীয় আবেগ ও প্রখর যুক্তির একত্র অধিকারিণী বসন্তসেনা। এক পরিচয় অপর পরিচয়ের প্রতিবন্ধক নয়। বসন্তসেনা তো কেবল চারুদত্তের প্রেমিক নন, বন্ধুও।

অমর্ত্য তাঁর আত্মকথন এ ভাবেই পরিচয়ের সীমাকে স্বীকার করে তা অতিক্রমের কথা ভাবেন। এই ভাবনা ভারতবর্ষীয়, এই ভাবনা রাবীন্দ্রিক আবার এই ভাবনা বৈশ্বিকও বটে। অথচ দুঃখের হলেও এ কথা সত্য, আজকের ভারত বন্ধুতার শর্ত ও সংলাপ যেন ভুলে যাচ্ছে ক্রমশ। পাঁচিল হারার ভাবনা যাপনের দেশে ক্রমশই যেন কঠোর পাঁচিল উঠছে চারিদিকে— বিরল হয়ে উঠছে নমনীয়তা ও সহিষ্ণুতা যাপনের ছবি।

অমর্ত্য সেনের বইটি আমাদের বন্ধুত্বে ও কথোপকথনে আবার বিশ্বাস রাখতে বলে। বলে বন্ধুত্বে বিশ্বাস হারানো পাপ।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

অন্য বিষয়গুলি:

Amartya Sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy