ভারত কি পারবে চিনের জায়গা নিতে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক দশক জুড়ে ক্রমান্বয়ে ধীর গতিতে চলার পর চিনের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতির পিছনে আংশিক ভাবে কাজ করছে চিনের বাইরে অবস্থিত কারখানা এবং জোগান ব্যবস্থার দিকে উৎপাদন তথা অর্থনীতির অভিমুখ ঘুরে যাওয়ার ঘটনা। কিন্তু ৪ দশক ধরে উৎপাদন এবং বাণিজ্যে চিনের সাফল্য, যা তাকে ‘বিশ্বের কারখানা’ বলে পরিচিত করেছে, তা থেকে এক নতুন হাওয়ার ঘূর্ণিতে পৃথিবীর যাবতীয় কর্পোরেট পরিচালকদের নজর একেবারে উল্টো দিকে ঘুরে যাওয়ার বিষয়টি সে দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তার প্রতিষ্ঠিত ধারণার সঙ্গে একেবারেই জুতসই নয়। তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, চিন ব্যতীত অন্য প্রতিযোগী দেশগুলির শিল্পনীতিতে কী এমন বদল ঘটল যা বিভিন্ন সংস্থাকে সে সব দেশগুলির দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করল?
চিন থেকে জাপানের সংস্থাগুলিকে তাদের উৎপাদন কেন্দ্রগুলি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে অর্থ বিনিয়োগ করছে টোকিও প্রশাসন। গত গ্রীষ্মে জাপান এক নতুন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আইন পাশ করেছে যার দ্বারা ১৪টি ক্ষেত্রকে একটি সামাজিক পরিকাঠামোর অঙ্গীভূত করা সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান তুলনামূলক ভাবে ‘রি-শোরিং’ (দেশের বাইরে চলে যাওয়া কোনও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া) শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল অবশ্যই চিন থেকে তাদের ব্যবসাকে দেশে ফিরিয়ে আনা। সুতরাং, এশিয়ার সব থেকে বেশি শিল্পায়িত ৩টি দেশ তাদের সংস্থাগুলিকে চিন থেকে দেশের মাটিতে ফিরে আসতে ইনসেন্টিভ দিচ্ছে।
‘রি-শোরিং’-এর জন্য টোকিওর বাজেট ২৫০ কোটি আমেরিকান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা)। কমবেশি আড়াইশো জাপানি সংস্থা গত কয়েক বছরে চিন ছেড়ে চলে গিয়েছে বলে জানা যায়। আর এই চিন-ত্যাগের (যাকে অনেকেই ব্রেক্সিটের অনুসরণে ‘চেক্সিট’ বলছেন) প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এই সব সংস্থা যে চিন ছেড়ে সব সময় জাপানে ফিরে যাচ্ছে, তা-ও নয়। বরং ওই ভূগোলের অন্য দেশে তারা আস্তানা গাড়ছে। জাপানের সংবাদমাধ্যম ‘আসাহি শিমবুন’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর ১৩৫টি সংস্থা চিন ছেড়ে অন্য দেশে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছে। এই সব সংস্থা মূলত সেমিকন্ডাক্টর, মোটরগাড়ি, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং পোশাক নির্মাতা। সোনি তার স্মার্টফোন উৎপাদনের একাংশকে তাইল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছে। লক্ষণীয়, এই স্থানান্তরণের ফলে ২০২১ নাগাদ সেখানে উল্লেখযোগ্য রকমের বিদেশি বিনিয়োগ ঘটেছে (আরও লক্ষ করার বিষয় এই যে, বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ কিন্তু চিনেরই বিভিন্ন সংস্থা)।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থাগুলিও যে শুধুমাত্র ‘ফ্রেন্ড-শোরিং’ (বন্ধুরাষ্ট্র বা যে সব দেশ পরস্পরের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তির দ্বারা আবদ্ধ, সেখানে যন্ত্রাংশ তৈরির বরাত দেওয়া বা সরবরাহের পরিধিকে সেই সব দেশের মধ্যে আবদ্ধ রাখার নীতি) করছে, এমন নয়। স্যামসাং ভিয়েতনামে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সে দেশ গুগলকে তার পিক্সেল ফোন বানাতে। অ্যাপলকে তার ম্যাকবুক এবং আইফোন উৎপাদনে এবং এমনকি নাইকি ও অ্যাডিডাসকেও বিনিয়োগে আকৃষ্ট করেছে। চিন থেকে বত্রিশটি প্রকল্প সরিয়ে নিয়ে গিয়ে মালয়েশিয়া লাভবান হয়েছে। এবং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তরফে এশিয়ার শিল্প-দানবদের চেয়ে বেশি ইনসেন্টিভ দেওয়ার ঘোষণার উত্তরে হুন্ডাই পাল্টা ঘোষণা করেছে যে তারা জর্জিয়ায় একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং ব্যাটারি কারখানা গড়ে তুলবে। পাশাপাশি, হন্ডার সঙ্গে যৌথ ভাবে এলজি ওহায়োতে একটি নতুন ব্যাটারি কারখানার উদ্যোগ নিয়েছে।
চিন এ ব্যাপারে আগ্রাসী আচরণ দেখাতে অবশ্যই বাকি রাখেনি। তারা তৈরি করেছে এক দ্বিমুখী ভিসা নিষিদ্ধকরণ যা জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে আঘাত করে এবং যা থেকে রাজনীতির আঙিনায় উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। কোরিয়ায় লোত্তে-র খুচরো ব্যবসার পরিকাঠামো, সুইডেনের এরিকসন, অস্ট্রেলিয়ার সুরা-নির্মাতারা, তাইওয়ানের আনারস চাষিরা এবং লিথুয়ানিয়ার সকলেই চিনা ড্রাগনের আগুনে নিশ্বাসের উত্তাপ পুইয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, বিশ্ববাণিজ্য মহল সার্বিক অর্থে চিনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি দেখতে পেয়েছে, সে দেশে বিভিন্ন রকমের বৈষম্য, ক্রমাগত বাড়তে থাকা উৎপাদন ব্যয় (যেখানে ভিয়েতনামে অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি চিনের থেকে ৬০ শতাংশ কম), পরিবেশ সংক্রান্ত কঠোর নিয়মকানুন, এবং অবশ্যই বার বার বিঘ্নিত সরবরাহ ব্যবস্থার সম্পর্কে শুনেছে। ইউরোপের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ২৩ শতাংশ সংস্থা চিন থেকে সরে আসার কথা ভাবছে।
উপরের কোনও কারণই কিন্তু চিনকে উৎপাদন কেন্দ্র বা বাজার হিসেবে খাটো করে দেখাচ্ছে না। ২০২২-এ চিনে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ কার্যত বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জার্মানির বিএএসএফ তার কর্মকাণ্ড চিনে ফিরিয়ে আনছে। চলতি সপ্তাহে ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-এ প্রকাশিত দুই কিস্তির এক নিবন্ধ থেকে বিস্তারিত ভাবে দেখা যাচ্ছে যে, কী উপায়ে অ্যাপলের উৎপাদন পদ্ধতি চিনের পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। আমেরিকা বা ভারতের মতো দেশ চিন থেকে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত টের পেয়েছে চিন-বাণিজ্যের ঘাটতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ সব সত্ত্বেও বলা যায়, পরিবর্তনের হাওয়া কিন্তু বইছেই। সিএনবিসি এক সরবরাহ ব্যবস্থা সংক্রান্ত ‘হিট ম্যাপ’ (ডেটা প্রদর্শনকারী পদ্ধতি বিশেষ)-এ দেখাচ্ছে যে, চিন ক্রমে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ভারত এবং তাইওয়ানকে হারাতে চলেছে।
সুতরাং, বিশ্বায়নের দিনগুলিতে যত পরিহাসই করা হয়ে থাকুক না কেন, জাতীয় শিল্পনীতির পুনরুজ্জীবন এক বাস্তব ঘটনা, যা কার্যত জাতীয় নিরাপত্তা, সরবরাহ-শৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক উদ্বেগের দ্বারা চালিত হয়। এবং এই সমস্ত কিছুই একত্রে সোজাসাপ্টা তুরুপের তাস হয়ে দাঁড়ায়। গত সেপ্টেম্বরে চিন নিজেই এক বিস্তারিত জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছিল (বিশদ কিছু অবশ্য প্রকাশ না করেই)। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সমস্ত কিছুরই নিরাপত্তা বিধান’।
ভাল-মন্দ যা-ই হোক না কেন, উপরের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, ভারতের সাম্প্রতিক উৎপাদন বিষয়ক ইনসেন্টিভ, পুঁজির ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান ইত্যদি নীতির উপর জোর দেওয়ার ব্যাপার কিন্তু বিশেষ ভাবে পুর্ব এশিয়া তথা বিশ্বের প্রবণতার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখে। যদিও ভারত ২০২১ সালের জাতিপুঞ্জের বৈদেশিক বিনিয়োগ-তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে, তবুও এ কথা বলা যায় যে, এখনও চিনের পরিবর্ত হিসাবে তাকে বিশ্বের বৃহৎ সংস্থাগুলি দেখছে না। এই দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটাতে গেলে ভারতকে পুর্ব এশিয়ার সঙ্গে আরও বেশি মাত্রায় বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি করে, শুল্কনীতিকে শিথিল করে, তার শ্রমক্ষমতার গুণগত মানের উন্নতি ঘটিয়ে যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy