বিধিলিপি। এ ছাড়া আর কী বা বলব? কাকে দোষ দেব? ফরিয়াদ শোনার জন্যই বা কে আছে? তাই মেনে নিয়েছি, আমার কপালের দোষ। না হলে, কেনই বা এমন জনম হবে— যেখানে দিনের বেলায় আলো নেই, নিশিরাতে আঁধার হারায়?
ভাবছ, পাগলি মেয়ের প্রলাপ? না গো, আমার মাথায় গোল নেই। আসলে, তোমরা তো এমন বে-লাইন কথা শুনতে পাও না, শুনতে চাও না। চাইলে, আমার মতো কত মেয়ের, কত ছেলের, বুড়ো-বুড়ি-জোয়ানের মুখে একই গান শুনতে, “আতেলারে তেল দাও না দয়াল, বেশি লাগবে বলে।” কিন্তু, সত্যি কি আমাদের আতেলা মাথায় একটু তেল দিতে কিছু বেশি লাগত? আমরা কি খুব বেশি কিছু চেয়েছি? এই ধরো আমার কথা। এই নদীকূলে আমাদের বাসা। মায়েরা মীন ধরে, কাঁকড়া ধরে। বাপেরা কেউ গেছে বাহিরে কাজের খোঁজে, বিদেশ মুলুকে। যারা আছে তারা, কেউ মাছ ধরে, অনেক দূর দূর চলে যায় নৌকা নিয়ে, আর কেউ বা মউলি। হামেশা এক জন-দু’জন বাঘের পেটে যায়।
তাদের বড় আশা, তাদের বাচ্চাদের আতেলা মাথায় একটু তেল পড়ুক। সেই আশায়, আমার মা-বাপ আমাকে ভর্তি করে দিল ইস্কুলে। আমাদের এই দেউলবাড়ি গাঁ। এই যে এতগুলো পাড়া, বাবুরামের চক, নস্করপাড়া, চাঁপাদার পাড়া, হরিহর পাড়া, যজ্ঞেশ্বর পাড়া, স্লুইস গেট পাড়া— আঠারোশো ভোটার। তবু, আমাদের পায়ের নাগালে প্রাইমারি ইস্কুল নেই। একেবারে কাছের যেটা, রাস্তা তিন কিলোমিটারের বেশি বই কম না। রাস্তা মানে নদী বাঁধ, কাদা। এখন তো আরও বেশি হাঁটতে হয়, কেননা এখন আমি ক্লাস সিক্সে। দিনে প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটা, ইস্কুল সেই কাটামারি বাজার। সবাই পারে না, তাই বেশির ভাগেরই ইস্কুলে যাওয়া হয়নি।
তোমরা বলতে পারো, মা-বাপ ইস্কুলে পাঠাতে চায় না। বাচ্চারা ছোট থেকেই খাটতে শিখুক, মীন-কাঁকড়া ধরতে শিখুক— এমনটাই তারা চায়। না গো, তোমরা ঠিকটা জানো না। মা-বাপদের জিজ্ঞাসা করে দেখো, সবার বড় খায়েশ তাদের বাচ্চারা লেখাপড়া শিখুক। সে জন্যই তো, ২০১৯ সালে, পরিমল দে নামে এক সদাশয় লোক যখন একটা ইস্কুল খুললেন, দলে দলে ছেলেমেয়েরা তাতে ভর্তি হল। এখন খাতায় মোট বাচ্চার সংখ্যা ১৬৬।
গাঁয়ের মানুষ অনিল বৈদ্য ইস্কুল খোলার জমি দিলেন, এক পয়সা মূল্য না নিয়ে। পুলিশ বিভাগ থেকে অবসর নেওয়া পরিমলবাবু তাঁর যেটুকু সঙ্গতি ছিল, তাই দিয়ে ইস্কুল বানালেন, আরও কেউ কেউ তাঁকে সাহায্য করলেন। এলাকার কিছু লেখাপড়া জানা যুবা নগণ্য পারিশ্রমিকে পড়াতে লাগলেন। পরিমলবাবুরা শুধু ইস্কুল গড়া ও শিক্ষকদের মাইনে দেওয়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন, তা-ই নয়— বাচ্চাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও জারি রেখেছেন। সে দিন কলকাতার ক’জন বাবু এসেছিলেন। তাঁদের এক জন যখন বাচ্চাদের কাছে জানতে চাইলেন, সকালে কী খেয়ে এসেছে, যে একশোর বেশি ছেলেমেয়ে হাজির ছিল তাদের অন্তত পঁচিশ জন বলল, কিচ্ছু খেয়ে আসেনি। মায়েরা সেই কোন সকালে বেরিয়ে যায়, তাদের খাবার বানিয়ে দেবে কে? তা ছাড়া, সরকার থেকে বিনে পয়সায় রেশন দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু তাতে মাসভর চলে না, দিনে অ-দিনে চাল বাড়ন্ত।
ইস্কুল হল, কিন্তু সরকার থেকে তার স্বীকৃতি আসেনি। সে নাকি অনেক হ্যাপা। আইনে নাকি বলা আছে, ইস্কুলের স্বীকৃতি পেতে হলে, ফায়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে ছাড়পত্র পেতে হবে। সে অনেক খরচের ব্যাপার। কেন এত খরচ, কী তার যুক্তি, সে-প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, আইনে নাকি বলা আছে— গ্রামাঞ্চলে লোকবসতির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইস্কুল খুলতে হবে। তা সরকার তার আইন কেন মানে না? কেন এখানে ইস্কুল গড়েনি? তা হলে তো আর পরিমলবাবুকে স্কুল খুলতে হত না।
আমাদের গাঁয়ের লোকে আইন ভেঙে জঙ্গলে গেলে জেলে যেতে হয়, কিন্তু সরকার যখন আইন ভাঙে তখন কেন কিছু হয় না? ভোটে জিতেছে বলেই, সংবিধানকেও না-মানার হক পেয়ে গেছে? এই যে, আমি এত কষ্ট করে, এত দূর হেঁটে ইস্কুলে যাচ্ছি, আসছি, তার পরও আমি জানি, আমার লেখাপড়া বেশি দূর এগোবে না। কারণ, আমি নাকি পিছিয়ে পড়া বাচ্চা, আমি পড়া বুঝতে পারি না, পড়া করতে পারি না। কেন পারি না? আমি যে টিউশনি পড়তে পারি না। এক, আমার মা-বাপ টিউশনি পড়ানোর খরচ দিতে পারবে না; আর দুই, দিতে পারলেও, আমাদের অঞ্চলে পড়ানোর লোক নেই। ওই যে দু’-চার জন ছেলে— মেয়েরা নয়— টিউশনি পড়তে যায়, তারা বেরোয় সেই কাকভোরে। কাটামারিতে, কুলতলিতে টিউশনি পড়ে। তার পর ইস্কুল, তার পর টিউশনি, তার পর নিশুত রাতে বাড়ি। আমি তো এটাই ভেবে কূল পাই না, ইস্কুলে যখন পড়ব, তখন আবার টিউশনির দরকার হবে কেন? সরকার তো বলেছে, শিক্ষা হবে নি-খরচায়। হা কপাল! যাদের একটু-আধটু পড়াশুনো হচ্ছে, তার জন্য তাদের খরচ কত? আমার ক্লাসের কথা বলি, যারা পড়াশুনোয় ভাল, তাদের পড়াশুনোর খরচও বেশ ভাল— এই ক্লাস সিক্সেই, গড়ে মাসে পাঁচশো টাকা। যত উঁচু ক্লাসে উঠবে, খরচ তত বাড়বে। আর যদি কেউ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায়, তা হলে তো কথাই নেই। তাকে থাকতে হবে শহর বাজারে, কেননা, আমাদের অঞ্চলে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ নেই। আশেপাশে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ানো হয় না। থাকার খরচের চেয়ে বেশি টিউশনির দাম। লোকের কথা কী বলি, মাস্টারদেরই কেউ কেউ বলেন, টিউশনি ছাড়া বিজ্ঞান তো দূর, কিছুই পড়া হবে না। কিন্তু, কেন হবে না, সেটাই কেউ বলে না।
এটাই হয়তো নিয়ম। আমার ছোট মাথায় বুঝি, যে যা বলে, তাকে সেটা করতে হয়, কথার খেলাপ করলে পাপ হয়। হয়তো বড় মাথাগুলো বড় করে বোঝে, যা বলা হয় সেটা ‘জুমলা’— বলার জন্য বলা, আর যা করা হয়, সেটা না বলাই দস্তুর।
শুনছি, কলকাতায় খুব আন্দোলন হচ্ছে। মাস্টারদের চাকরিতে সরকারের নানা দুর্নীতি-গাফিলতি নিয়ে মিছিল-মিটিং। এমন আন্দোলন হওয়া দরকার, যাতে কোনও সরকার ভুলেও বে-আইন কিছু করার সাহস না পায়। সেই সঙ্গে, সরকার যে আমাদের মতো কোটি কোটি বাচ্চাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙেই চলেছে, এই না-ইনসাফি নিয়ে কেউ দু’কথা বলবে না? আমাদের আতেলা মাথায় দু’-ফোঁটা তেল পড়লে কারও কম পড়বে না। বরং বাড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy