Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
Legends of Indian Cinema

কিছু একটা করতে হবে তো

ভান্ডারে যত মেলোড্রামা বা অতিনাটকের উপাদান আছে সব একত্র করে নীতার আর্তনাদকে বার বার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করতে চেয়েছিলেন তিনি।

আবৃত: মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে নীতার ভূমিকায় সুপ্রিয়া দেবী।

আবৃত: মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে নীতার ভূমিকায় সুপ্রিয়া দেবী।

রোচনা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৫:১০
Share: Save:

ভারতীয় সিনেমা নিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণা এমন ভাবে আমাদের মনে গেঁথে থাকে যে সহজে তাদের সরানো যায় না। যেমন, একটা কথা আমরা খুব শুনি— কখনও গ্রাম্ভারি চালে কখনও বা রসিকতা হিসেবে— যে, আমাদের চলচ্চিত্র আসলে মিউজ়িক্যাল-এর মতো, ফেনিয়ে টেনে লম্বা করা, অতিনাটকীয়তায় ভরা, এই সব। এই বছর দুই জন চলচ্চিত্র পরিচালক তাঁদের শতবর্ষে পড়ছেন, যাঁদের দুই জনের কাজই কিন্তু এই সাধারণ ধারণাটির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে: এক জন, গুরু দত্ত (১৯২৫-১৯৬৪), অন্য জন— ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬)। এঁদের দুই জনেরই জীবন ছিল ঘটনাবহুল এলোমেলো, দুই জনেই প্রয়াত হয়েছেন অসময়ে— এখানে পাওয়া যেতে পারে এক ধরনের সাদৃশ্য। দুই জনেরই পরিচালিত চলচ্চিত্রে তাঁদের নিজেদের জীবনের ছায়া পড়েছে, গুরু দত্তের কাগজ় কে ফুল এবং ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার ও যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে। তবে কিনা, আমার মতে, দু’জনের সবচেয়ে বড় মিল অন্য জায়গায়। দুই জনেই এমন কাজ করে গিয়েছেন, যার মধ্যে সিনেমা-ফর্মের অতিনাটকীয়তা এবং নতুন ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের আধুনিকতা, দুইয়ের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে। এ বছর তাঁদের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর বিশ্ব-চলচ্চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে দুই জনের অবদান নিয়ে আপাতত শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে আমি ও আমার সহকর্মীরা কিছু ভিন্ন ধরনের ভাবনাচিন্তার চেষ্টা করছি।

তবে আমার মনে হয়, বাঙালির জন্য এই দুই জনের একটা বৈসাদৃশ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কথা। গুরু দত্তের উত্তরাধিকার তুলনায় অনেক সরলরৈখিক। সংক্ষেপে বলতে গেলে, গুরু দত্ত এক অসাধারণ সফল চিত্রপরিচালক, যাঁর চিত্রনির্মিতি অতি উচ্চ মানের, আধুনিকতার যাত্রাপথে ভারতের মতো দেশের চলনকাহিনি তিনি বুনে গিয়েছেন, আর সেই কাহিনির মধ্যে বইয়ে দিয়েছেন গভীর উদাস জাদুময় সঙ্গীতমূর্ছনা।

আর ঋত্বিক? তাঁর ছবির দু’টি বিশেষ দিকের কথা বলতে চাই আমি, দু’টিই দুরূহ, দু’টিই সহজে মীমাংসাযোগ্য নয়, অন্তত যখন তিনি এই সব ছবি তৈরি করছিলেন, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে— এক, ঋত্বিকের নারী-ভাবনা, দুই, দেশভাগের পর ইতিহাসের ঘাতে-প্রতিঘাতে তৈরি হওয়া পূর্ব বঙ্গ/ পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর কর্মজগৎ ও কল্পনাজগতের সম্পর্ক। তাঁর শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আজ আবার আমরা টের পাচ্ছি এই দু’টি বিষয়ই সত্যিই কতটা জটিল, বুঝতে পারছি তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ও উত্তরাধিকার এখনও কত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলেছে।

ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ভাষায়, দেশভাগের ট্র্যাজেডি ছিল “ঋত্বিক’স লাইফ-লং অবসেশন। ইট ইজ় রেয়ারলি দ্যাট আ ডিরেক্টর ডুয়েলস সো সিঙ্গল-মাইন্ডেডলি অন দ্য সেম থিম। ইট ওনলি সার্ভস টু আন্ডারলাইন দ্য ডেপথ অব হিজ় ফিলিং ফর দ্য সাবজেক্ট।” ঋত্বিক প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁর চোখে দেশভাগ-উত্তর সব বাঙালির পরিচয় ‘উদ্বাস্তু’। এই বর্ণনা নিশ্চয়ই হিন্দু বাঙালিকে মনে রেখেই করা, কেননা বাঙালি মুসলমান ও তাঁদের জগৎ খুব কম ধরা পড়েছে তাঁর ছবিতে।

আমার মতে, ঋত্বিকের ইতিহাস-ভাবনাকে দুই ভাবে বোঝার চেষ্টা করা যায়। দেশভাগের পর যে গভীর হারানোর বেদনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হল, তাঁর ছবিতে তা উঠে এল, কিন্তু তার সঙ্গে উঠে এল সেই সময়ের সঙ্গীত, বহুবিস্তৃত আবেগ, কথোপকথনের ধারা, কল্পনার প্রসার— এবং তার মধ্যে দিয়ে ধ্বনিত হল একটি জরুরি উচ্চারণ যে— রাজনৈতিক দেশ-বিভাগের পর উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তব কিন্তু বাঙালি সমাজের সামূহিক সংস্কৃতি নিঃশেষিত করে দিয়ে যায়নি। আজকে তিনি থাকলে কী বলতেন? গত জুলাই মাসে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে যে গণ-অভ্যুত্থান আমরা দেখেছি, তা দেখে তিনি সন্তুষ্ট হতেন বলেই মনে হয়। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ, বিশেষত ছাত্ররা, মেয়েরা, রাস্তায় দলে দলে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটা নতুন ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছে, একে তিনি সমর্থন জানাতেনই। কিন্তু বাঙালি জাতির যে সামূহিক অস্তিত্ব— এ নিয়ে তাঁর মনোভাব কী দাঁড়াত? কিংবা, ধরা যাক সময় যদি কথা বলতে পারত, তা হলে তাঁকে কী বলত আমাদের এই সময়— দেশভাগ নিয়ে তাঁর ওই ‘ট্র্যাজিক’ একবগ্গা মনোযোগ বিষয়ে?

এ বার আসি অন্য বিষয়টিতে: ঋত্বিকের ভাবনায় নারী। মেঘে ঢাকা তারা-র নীতা বা সুবর্ণরেখা-র সীতা প্রচুর ক্লেশ স্বীকার করে দেশভাগ-উত্তর মধ্যবিত্ত উদ্বাস্তু চালচুলোহারা পরিবারের হাল ধরে, টেনে নিয়ে চলে। মেয়েদের এই সংগ্রাম ও ক্ষয়ের কাহিনি হয়ে দাঁড়ায় ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা। মেঘে ঢাকা তারা-র শেষে নীতার সেই “দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম” আর্তনাদ সিনেমার পরিসরে নিঃসন্দেহে ট্র্যাজিক, কিন্তু একই সঙ্গে বাস্তবে, সে আর্তি বহু বাঙালি ও ভারতীয় সিনেমা-দর্শকের মনোজগৎটিকে ধরে ফেলে। কেননা, প্রায় প্রতি মধ্যবিত্ত বাড়িতেই তখন ছিল এক জন করে নীতা— যে নীতারা পরিবারে প্রথম প্রজন্মের নারী যাঁরা বাইরে কাজে বেরিয়েছেন, নিজেদের আবেগ যৌবন স্বপ্ন সব সরিয়ে রেখে এক-একটা বড় পরিবারের দায় নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছেন। প্রতিশ্রুতিময় সফল ছাত্রী নিজের উচ্চাশী, নিরাপত্তাবোধের অভাবে দীর্ণ প্রেমিকের কাছ থেকে সম্পর্কের প্রত্যাশা তুলে নিয়ে তাঁকে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে দিচ্ছেন। স্নেহময়ী দিদিরা আদরের ভাইবোনদের মুখের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের আনন্দের জন্য, নিজেদের জীবনের অকৃতার্থতা মেনে নিচ্ছেন। কুমার সাহনি এক বার লিখেছিলেন, “এই ছবির নায়িকা নীতা যেন সুরক্ষা ও যত্নের মুখ, বোন গীতা আবেগজর্জর ইন্দ্রিয়সুখের মুখ, আর তাদের মা নিষ্ঠুর স্বার্থচিন্তার মুখ।” তবে আসল কথা হল, নীতার মধ্যে এই তিন-কে মেলানো সম্ভব করতে দেয়নি সমাজ-সংসারের যে পরিস্থিতি, যে কারণে তার অন্য সব প্রবণতা বাদ দিয়ে কেবল ‘যত্ন’টুকুই করার অবকাশ পেয়েছিল সে, সেই সমাজের ইতিহাসেই ধরা আছে নীতাদের জীবনের সত্যিকারের ট্র্যাজেডি। ঋত্বিক চেয়েছিলেন, এই দীর্ণতাকে ভারতীয় সমাজের ছবি হিসেবে তুলে ধরতে। তাঁর আশ্চর্য শিল্পবোধ নিয়ে ভান্ডারে যত মেলোড্রামা বা অতিনাটকের উপাদান আছে সব একত্র করে নীতার আর্তনাদকে বার বার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিংবা চেয়েছিলেন, সীতার আত্মঘাতের মধ্যে বিধৃত সমাজ-হিংসা যাতে কিছুতেই দর্শকের বোধেন্দ্রিয় এড়িয়ে যেতে না পারে— সেটা নিশ্চিত করতে।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, আমরা যখন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি অভয়ার মর্মান্তিক ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে, যখন আরও অগণিত মেয়ের এমন অসহনীয় পরিণতি হয়তো আমাদের এই প্রচারমাধ্যম-অধ্যুষিত মস্তিষ্ক গ্রহণই করতে পারছে না, সে কথা জেনে— তেমন সময়ে কোনও একটা নতুন সূচনা কী ভাবে ভাবা সম্ভব? মনে হয়, গুরু দত্ত আর ঋত্বিক ঘটক দুই জনই আমাদের এখনকার এই ‘মিডিয়াটাইজ়ড’ বা প্রচারমাধ্যম-প্রস্নাত জীবন ও রাজনীতির বিচিত্র কর্কশতায় হতভম্ব হয়ে পড়তেন। গুরু দত্তের পিয়াসা ছবি থেকে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের অনাচারমুখিতা বিষয়ে কী বলতে পারতেন তিনি। এ ছবির শেষে শহর থেকে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন অজানার সন্ধানে, সঙ্গে নিয়েছিলেন গুলাবো নামের সেই যৌনকর্মী সহচরীকে— যে ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন গুরু দত্তের সর্বসময়ের সঙ্গিনী ওয়াহিদা রহমান।

আমরা কি কল্পনা করতে পারি, ঋত্বিক ঘটক কী বলতেন সমাজমাধ্যমের এই আওয়াজসর্বস্বতা আর ফেক নিউজ়-এর বিষাক্ততা দেখে? আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, সহজ কোনও সমাধানে বা সিদ্ধান্তে বিশ্বাস রাখতেন না তিনি। বরং জোর দিতেন যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-র নীলকণ্ঠের মতো ওই কথাটায়— “কিছু একটা করতে হবে তো!”

এ কথাটাই শেষ অবধি থেকে যায়। সে দেশভাগের ইতিহাসকে আমরা যে ভাবেই পড়ি না কেন, কিংবা ব্যক্তিমানুষ হিসাবে আমরা একক ভাবে বা সম্মিলিত ভাবে যে যার মতো পথেই নিজেদের ভবিষ্যৎকে ভাবি না কেন— এটাই হয়তো আমাদের জন্য তাঁর বার্তা।

অন্য বিষয়গুলি:

Guru Dutt Ritwik Ghatak Indian Cinema
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy