সম্প্রতি তেহট্টতে এক নির্বাচনী জনসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন যে, মতুয়ারা বহু কাল পশ্চিমবঙ্গে ‘শরণার্থী’র জীবনযাপন করছেন, ভোটের পর বিজেপি তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে। প্রত্যুত্তরে হাবড়ার জনসভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “তার মানে মতুয়ারা কি এখন নাগরিক নন?” মুখ্যমন্ত্রীর মতে, “১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সবাই এ দেশের নাগরিক।”
এনআরসি-এনপিআর এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ ২০১৯-এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলনের পর উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে উত্তপ্ত বিতর্কের জন্ম দেবে, সেটা খানিকটা প্রত্যাশিত। কিন্তু এই প্রশ্নে কার অবস্থান ঠিক? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর?
প্রথমত, অমিত শাহ যে ভাবে মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলছেন, সেটা একেবারেই আইনসম্মত নয়। সিএএ ২০১৯-এর কোনও ধারায় মতুয়া উদ্বাস্তুদের আলাদা করে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা নেই। এই আইন অনুযায়ী আফগানিস্তান, বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তান থেকে কোনও হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকলে এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে পাসপোর্ট অ্যাক্ট ১৯২০ এবং ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬-এর আওতায় অব্যাহতি দিয়ে থাকলে, তবেই তিনি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
আবেদনকারী ‘শরণার্থী’রা বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে পারলে তবেই তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন। যেমন পাসপোর্ট অ্যাক্ট ১৯২০ এবং ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬-এর আওতায় কেবল তাঁরাই অব্যাহতি পাবেন, যাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বা আশঙ্কায় ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই আইন পাশ হওয়ার আগে যে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে এই নাগরিকত্ব বিল নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তার রিপোর্ট অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ইন্টেলিজেন্স বুরো কমিটিকে জানিয়েছিল যে, পাকিস্তান থেকে আসা যে ৩১,৩১৩ জন ‘শরণার্থী’ ভারতে প্রবেশের সময়েই ধর্মীয় নিপীড়নের কথা জানিয়েছিলেন, তাঁরাই কেবল এই আইনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পাবেন। বাকি যাঁরা আবেদন করবেন, তাঁদের ধর্মীয় নিপীড়নের প্রমাণ দেখাতে হবে। পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে বহুলাংশই এই ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’-এর প্রমাণ দেখিয়ে নাগরিকত্ব আদায় করতে পারবেন না।
তদুপরি, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা কোনও উদ্বাস্তু এই আইনের আওতায় আবেদন করলে তার অর্থই হবে লিখিত ভাবে এই কথা মেনে নেওয়া যে, তিনি এত কাল ভারতে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে বসবাস করেছেন। যাঁরা এই আবেদন করবেন, তাঁরা নানাবিধ সমস্যায় পড়তে পারেন এবং ভবিষ্যতে এনপিআর-এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হলে সহজেই ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই কথাটা শুধু চেপেই যাচ্ছেন না, নাগরিকত্বের মুলো ঝুলিয়ে যাতে মতুয়া বা নমশূদ্র উদ্বাস্তুদের সমর্থন আদায় করা যায়, তার জন্য ‘শরণার্থী কল্যাণ প্রকল্প’-এর নামে প্রত্যেক উদ্বাস্তু পরিবারকে পাঁচ বছর ধরে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। এটা ‘অনুপ্রবেশকারী’ ধরার একটা ফাঁদ ছাড়া আর কিছু নয়।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ আর অসমের নির্বাচনী ইস্তাহারে দু’রকম কথা বলে বিজেপি ইচ্ছাকৃত দ্বিচারিতার মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। অসমে নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার জন্য আবেদন করেন ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। ২০১৯-এর ৩১ অগস্ট প্রকাশিত এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়ে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম, যার মধ্যে আনুমানিক ১২ লক্ষ বাঙালি হিন্দু, ৫ লক্ষ বাঙালি মুসলমান; বাকিদের মধ্যে আছেন গোর্খা, বিহারি, এমনকি অনেক স্থানীয় দলিত এবং আদিবাসীরাও। এনআরসি-ছুট এই বিশাল সংখ্যক মানুষের নাগরিকত্বের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত— এঁদের কি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করা হবে, না তাড়ানো হবে বাংলাদেশে, এই প্রশ্নের সদুত্তর এখনও মেলেনি।
অসম বিধানসভা নির্বাচনের ইস্তাহারে বিজেপি বলেছে যে, তারা ‘সংশোধিত’ এনআরসি চায়। অর্থাৎ, চার বছর ধরে ১,৬০০ কোটি টাকা সরকারি ব্যয়ে যে প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে, বিজেপি সেটার আংশিক পুনরাবৃত্তি করে আরও কয়েক লক্ষ মানুষের নাম বাদ দিতে চায়। অথচ, যে সিএএ ২০১৯ আইন মোদী সরকার পাশ করিয়েছে, অসমে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারে তার উল্লেখমাত্রও নেই। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইস্তাহারে বিজেপি বলছে, ‘মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) প্রয়োগ’ করা হবে।
অর্থাৎ, অসমে বিজেপি বলছে ‘ইয়েস এনআরসি, নো সিএএ’ আর পশ্চিমবঙ্গে বলছে ‘নো এনআরসি, ইয়েস সিএএ’! এর ফলে বিজেপির অবস্থানের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকছে না।
অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মতুয়া উদ্বাস্তুদের যে আশ্বাস দিচ্ছেন, সেটাও বেশ গোলমেলে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, যদি শুধু তাঁরাই ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পান, তবে ১৯৭১-এর পরে আসা উদ্বাস্তুদের কী হবে? ১৯৭১-এর পর ভারতে প্রবেশ করলে ‘বিদেশি’— এটা অসম চুক্তির অঙ্গ, যেটা কেবল অসম রাজ্যে প্রযোজ্য। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এর প্রাসঙ্গিকতা কী?
১৯৭১-এর পরে পশ্চিমবঙ্গে আসা উদ্বাস্তুদের সংখ্যাটা যে বেশ কয়েক লক্ষ, তা সর্বজনবিদিত। ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের আমলে যে ‘সিএএ ২০০৩’ পাশ হয়, তার পর থেকে রাষ্ট্রের চোখে এই সমস্ত উদ্বাস্তু কিন্তু ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হয়ে গিয়েছেন। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী ছিলেন— তিনি সিএএ ২০০৩ আইন সমর্থন করেন। পরবর্তী কালে ২০০৫-এর অগস্ট মাসে, বাংলাদেশ থেকে আসা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’-দের নাম পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি সংসদে কাগজ ছুড়ে প্রতিবাদ করেন— সাংসদ হিসেবে পদত্যাগ করারও চেষ্টা করেন। উদ্বাস্তুদের প্রশ্নে অতীতে এই রকম অবস্থান নিয়েছিলেন বলেই হয়তো আজকে মুখ্যমন্ত্রী এনআরসি-র মৌখিক বিরোধিতা করলেও তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারে এনআরসি-এনপিআর, সিএএ ২০০৩ অথবা সিএএ ২০১৯ নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করা হয়নি।
সিএএ ২০০৩ আইন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মতুয়া, নমশূদ্র, রাজবংশী এবং অন্যান্য অংশের হিন্দু উদ্বাস্তুদের গায়ে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র তকমা এঁটে দেয় এবং এনপিআর-এনআরসি’র মাধ্যমে তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশকারী’দের চিহ্নিত করার কথা বলে। সিএএ ২০০৩ আইন বাতিল করে উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করার দাবি নিয়ে এক সময় আন্দোলন শুরু হয়েছিল মতুয়া মহাসঙ্ঘের পীঠস্থান ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি থেকেই। মোদী সরকারের সিএএ ২০১৯ আইনও কিন্তু উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি।
উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করার সহজ উপায়, সিএএ ২০০৩ এবং সিএএ ২০১৯, এই দু’টি আইনকেই বাতিল করা এবং নতুন আইন পাশ করে ২০১৪ বা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ভোটার তালিকায় নথিভুক্ত সকলকে ভারতের নাগরিক হিসেবে মান্যতা দেওয়া। এই রকম একটি নতুন আইনের প্রতিশ্রুতি কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, কেউই দিচ্ছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy