নবকলেবর: বিহারের নতুন মন্ত্রিসভা, (বাঁ দিক থেকে) জিতন রাম মাঁঝি, তেজস্বী যাদব, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, রাবড়ী দেবী, পটনা, ১৬ অগস্ট। ছবি: পিটিআই
সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ছিলেন। মঞ্চে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সীতারাম ইয়েচুরিও। ছিলেন তেজস্বী যাদব। অরবিন্দ কেজরীওয়াল, চন্দ্রবাবু নায়ডুও। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির তিন প্রধান চরিত্র অখিলেশযাদব, মায়াবতী, প্রয়াত অজিত সিংহকেও দেখা গিয়েছিল।
২০১৮-র মে মাসের কথা। কর্নাটকে বিজেপিকে রুখে জেডিএস-কংগ্রেস জোট সরকার গড়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এইচ ডি কুমারস্বামীর শপথ গ্রহণে গোটা দেশ থেকে এক ডজনের বেশি অ-বিজেপি দলের নেতানেত্রীরা একজোট হয়েছিলেন। শপথগ্রহণের পর সকলের হাতে হাত ধরে ছবি সব কাগজে প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল।
সে দিন অনেকেরই মনে হয়েছিল, ২০১৯-এ বিজেপির বিদায়-ঘণ্টা বেজে উঠল। লোকসভা ভোটে ঠিক এই ভাবেই বিজেপির বিরুদ্ধে সমস্ত দল এককাট্টা হবে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন এল। দেখা গেল, বিরোধীদের জোটের স্বপ্ন অধরাই রইল। বিজেপিকে তিনশোর বেশি আসনে জিতিয়ে নরেন্দ্র মোদী ফের প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে ফিরলেন।
এখনও আবার বিহারের পট-পরিবর্তনে অনেকেই দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন। নীতীশ কুমার বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে আরজেডি, কংগ্রেস, বামেদের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। বিরোধীদের অনেকেই দাবি করছেন, এ হল ২০২৪-এ বিজেপির জন্য বিপদসঙ্কেত। খোদ নীতীশ প্রশ্ন তুলেছেন, “২০১৪-য় যিনি এসেছিলেন, তিনি ২০২৪-এ আর আসবেন কি?” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, বিজেপি আর ২০২৪-এ ক্ষমতায় ফিরবে না। কী অঙ্ক কষে তিনি এ কথা বলছেন, তা অবশ্য এখনই বলতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন।
সত্যিই কোনও অঙ্ক নেই। কারণ বিহারে পালাবদল হয়েছে শুধু বিধানসভার অন্দরে। তাতে বিহারের ময়দানে বা গোটা দেশে মোদীর জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছে, এমন নয়। আর যে-ই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, নরেন্দ্র মোদীকে হটাতেই হবে— ভোটারদের মধ্যে এমন মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছে, এ কথা ঘোর মোদী-বিরোধী নেতাও বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন না। শুধুমাত্র বিরোধীরা এককাট্টা হলে সংসদীয় রাজনীতির অঙ্কে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটানো যায় বলে বার্তা দেওয়া গিয়েছে। তবে বিহারে যেমন বিজেপির বিরুদ্ধে কার্যত সবাই এক ছাতার তলায় চলে এসেছেন, জাতীয় রাজনীতিতে এখনই তেমন কোনও সম্ভাবনার দেখা মিলছে না।
আর তাতেই নরেন্দ্র মোদীর লাভ। বিহারের পালাবদলের পরেই স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে তিনি একটি কথা ফের মনে করিয়ে দিয়েছেন। তা হল, দেশের মানুষ বহু বছর পরে রাজনৈতিক স্থিরতার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। দেশের স্বার্থে এই রাজনৈতিক স্থিরতা জরুরি। প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, বিরোধী জোট কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। তিনি জানেন, সবাই এখন শেয়ার বাজারে টাকা লগ্নি করেন। অস্থির সরকার হলেই যে শেয়ার বাজার টলমল করবে, তা আঠারো বছরের কচি ভোটাররাও জানে। মোদী জমানায় অর্থনীতি তলানিতে ঠেকলেও শেয়ার বাজার ফুলেফেঁপে থেকেছে। দিনের শেষে আমজনতা যে ধর্মনিরপেক্ষতার থেকে শেয়ার বাজারের মুনাফাকে বেশি মূল্য দেয়, গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদী তা বিলক্ষণ জানেন।
এ সব কথা পরে! জোট বেঁধে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে হলে তো আগে বিরোধীদের জোট হওয়া দরকার! সেই জোটের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল, বিরোধী শিবিরে অনেকেরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। সেখানেই সংঘাত।
নীতীশ কুমার ২০০৫ সাল থেকে একটানা মুখ্যমন্ত্রী। বিহারের মতো রাজ্যেও তিনি ‘সুশাসন বাবু’ হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন। অনেকেরই ধারণা, তিনি বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রীর মুখ হয়ে উঠতে পারেন। সেই জোটে কি বাকি বিরোধীরা সকলে থাকবে? কংগ্রেস কি রাহুল গান্ধীর বদলে নীতীশকে বিরোধী জোটের মুখ হিসেবে মেনে নেবে? নীতীশকে মুখ করে বিরোধী জোটের জল্পনা শুরু হতে না হতেই আম আদমি পার্টি ঘোষণা করেছে, তারা এমন কোনও জোটে নেই। অরবিন্দ কেজরীওয়ালের ঘোষিত অবস্থান হল, তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান শক্তি হিসেবে কংগ্রেসের জায়গা দখল করতে চান। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে একমাত্র আম আদমি পার্টিই এখন একের বেশি রাজ্যে ক্ষমতায়। কেজরীওয়াল নিজে টানা বছর-সাতেক মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে। তিনি নীতীশকে জায়গা ছাড়তে নারাজ।
নীতীশের থেকেও ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক বেশি দিন মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন। তবে তিনি কোনও দিনই প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেননি। উল্টে গত কয়েক বছর তাঁর বিজু জনতা দল এনডিএ-পন্থী অবস্থান নিয়েই চলছে। তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা রয়েছে। মাঝেমধ্যেই তিনি কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট গড়তে নেমে পড়েন। এখন তিনি কংগ্রেসের সঙ্গেই বিজেপি বিরোধী জোটের মধ্যে মাথা গলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সে নিছক আগামী বছর তেলঙ্গানার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে নিজেকে প্রধান শক্তি হিসেবে তুলে ধরার জন্য। তাঁর নিজের স্বার্থ মিটে গেলে রাও যে কোন দিকে হেলে যাবেন, তা কেউ জানে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝুলিতেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দশ বছরের বেশি সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে নগদ টাকা উদ্ধার জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূলের ভাবমূর্তিকে ধাক্কা দিয়েছে। তার পরেই মমতার দিল্লি এসে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক, তার আগে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অবস্থান বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতে তৃণমূলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে— সে যতই তৃণমূলনেত্রী ‘সেটিং’-এর তত্ত্বকে খারিজ করে দিন না কেন!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও মনে করেন, যে দল যেখানে শক্তিশালী, তাকে সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে দিতে হবে। তার পিছনে বাকিরা দাঁড়াবে। প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, পরে দেখা যাবে। তাঁর তত্ত্ব মানতে হলে কংগ্রেসকে রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশের মতো হাতেগোনা রাজ্য বাদ দিলে বাকি সব রাজ্যে লড়াইয়ের ময়দান আঞ্চলিক দলগুলোকে ছেড়ে দিতে হয়।
তা না করেও অবশ্য কংগ্রেস নীতীশ কুমারকে বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারে। নীতীশ কুমার ওবিসি কুর্মি নেতা। তিনি বিরোধী জোটের মুখ হলে বিজেপি ওবিসি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মোদীকে মুখ করে যে ওবিসি ভোটে ফয়দা তোলে, তা ঠেকানো যেতে পারে। নীতীশের বিরুদ্ধে পরিবারবাদের অভিযোগ তোলা সম্ভব নয়। মমতা-কেজরীওয়ালদের রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস সম্পর্কে ‘অ্যালার্জি’ রয়েছে। নীতীশ সামনে থাকলে সেই সমস্যা হবে না। বরং নীতীশকে সামনে রেখেই কংগ্রেস বিজেপির দুর্গে আঘাত করার কাজ শুরু করতে পারে।
এক জেডিইউ নেতা অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে লোকসভায় বিজেপির অন্তত ৪০টি আসন কমবে। তা হলেই বিজেপি চাপে পড়ে যাবে। এই তিনটি রাজ্য থেকে ২০১৯-এ বিজেপি মোট ৪৫টি আসন জিতেছিল। জেডিইউ নেতার অঙ্ক মিললেও, খোদ জেডিইউ ২০২৪-এ লোকসভায় কতগুলো আসন জিততে পারে? নীতীশ ফের মুখ্যমন্ত্রী হলেও তাঁর দল বিহারের লোকসভা আসনের সব ক’টি জিতবে, এমন নয়। গত লোকসভায় জেডিইউ বিহার থেকে ১০টি আসন জিতেছিল। বিহারে এখন আরজেডি, বিজেপিই প্রধান শক্তি। ফলে জেডিইউ খুব বেশি হলে ১২ থেকে ১৪টি আসন জিততে পারে। নীতীশ নিজে নির্বাচনে বহু বছর লড়েন না। বিধান পরিষদে নির্বাচিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন। লোকসভায় তিনি নালন্দা আসন থেকে প্রার্থী হতে পারেন বলে জোর জল্পনা চলছে। কিন্তু মাত্র ১২-১৪ জন সাংসদ দলের নেতা হয়ে কি নীতীশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার হওয়া সম্ভব? এর আগে ছোট দলের নেতা হয়েও এইচ ডি দেবগৌড়া, ইন্দ্রকুমার গুজরালরা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু সে সব জোট হয়েছে নির্বাচনের পরে। সরকারও বেশি দিন টেকেনি।
কর্নাটকে কুমারস্বামীর শপথগ্রহণ মঞ্চে বিরোধীরা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে জমায়েত হয়েছিলেন। ওই এক বছরের মধ্যেই বিরোধীরা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিলেন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের এখনও দু’বছর বাকি। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কখন বদলে যাবে, তার ঠিক থাকে না। বিরোধীদের কাছে দিল্লি এখনও দূর অস্ত্ বলেই মনে হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy