Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
Rahul Gandhi

‘পাপ্পু’ থেকে ভারতীয় রাজনীতির ‘ফরেস্ট গাম্প’?

শতাব্দীপ্রাচীন একটি দলের বোঝা (না কি আসলে দলটাই এখন ‘বোঝা’) জন্মসূত্রে এসে পড়েছে তাঁর উপর।

বাহান্ন বছরের এক আপাত-উদাসীন রাজনীতিক কেন কোমর বেঁধে বেরোলেন ভারতকে জোড়ার এই দুর্মর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে!

বাহান্ন বছরের এক আপাত-উদাসীন রাজনীতিক কেন কোমর বেঁধে বেরোলেন ভারতকে জোড়ার এই দুর্মর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে! ছবি: পিটিআই।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:০৮
Share: Save:

কেউ একজন বললেন, ‘‘কার্ল মার্ক্সের মতো লাগছে না?’’ একজন বললেন, ‘‘উঁহু, অনেকটা বাবা রামদেবের মতো লাগছে।’’ অন্য একজন আবার বললেন, ‘‘কেশর-ফোলানো সিংহের মতো লাগছে কিন্তু।’’

আনন্দবাজার অনলাইনের সম্পাদকীয় দফতরে ছেঁড়া ছেঁড়া মন্তব্যগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই তো! কেমন লাগছে? অনেক ভেবেটেবে দেখলাম, এই রাহুল গান্ধীর সঙ্গে একজনেরই মিল পাচ্ছি। ১৯৯৪ সালের কালজয়ী ছবি ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রের। সেই ফরেস্ট, যে এক প্রায় অনন্তযাত্রার দৌড় শুরু করেছিল।

সেরা ছবি, সেরা অভিনেতা-সহ মোট ছ’টি অস্কারজয়ী ছবি ‘ফরেস্ট গাম্প’ তৈরি হয়েছিল আমেরিকার পটভূমিকায়। কেন্দ্রীয় চরিত্র ফরেস্ট। তার জীবন ঘিরেই আবর্তিত হয় ছবিটি। যার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন টম হ্যাঙ্কস। ফরেস্ট অ্যালাবামার বাসিন্দা। থাকে তার মায়ের সঙ্গে। তিনি একজন একলা মা। একলা সেই মানুষটি একটি বোর্ডিং হাউস চালান। এবং তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তানকে দুনিয়ার যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ঠেলে দেন (সনিয়া গান্ধীর ছায়া দেখা যাচ্ছে কি কোথাও?)। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ফরেস্টের দু’পায়ে ‘ব্রেস’ পরানো। কোনও এক বিপন্ন মুহূর্তে ফরেস্ট শুনতে পায় তার অন্তরাত্মার ডাক। বেভুল পায়ে ব্রেসের বন্ধন অগ্রাহ্য করে সে দৌড়তে শুরু করে। এক একটা ঝটকায় খুলে যায় তার পায়ের ধাতব বাঁধন। মুক্তির আনন্দে প্রায় পাখির মতো উড়তে শুরু করে কিশোর ফরেস্ট।

‘ফরেস্ট গাম্প’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে এই রাহুল গান্ধীর অদ্ভুত মিল। ভাবনা সৌজন্য: ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব।

‘ফরেস্ট গাম্প’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে এই রাহুল গান্ধীর অদ্ভুত মিল। ভাবনা সৌজন্য: ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব।

জীবন এগিয়ে যায়। ফরেস্টের দিনরাত কাটতে থাকে ঝোড়ো হাওয়ার মতো। নাটকের মতো। সেই ঝড়ের কোনও মাইলফলকে লেখা স্পোর্টসে দেশের হয়ে তুঙ্গ সাফল্য, কোনওটায় লেখা ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়ে সতীর্থের প্রাণ বাঁচানো, কোনওটিতে কুচো চিংড়ির ব্যবসা করে লাখোপতি হওয়া। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সেই পর্বতসদৃশ সাফল্য পাওয়ার পরেও (এমনকি, বাল্যকালের প্রেমিকার সঙ্গে চরম ঘনিষ্ঠতার পরেও) কে জানে কেন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিরন্তর দৌড় শুরু করে ফরেস্ট। টানা তিন তিনটে বছর সে সেই ক্রস কান্ট্রি ম্যারাথন দৌড়ে যায়। দৌড়েই যায়।

সেই দৌড়ের মধ্যে ফরেস্টের চারপাশের দৃশ্যপট বদলে বদলে যায়। আবহাওয়া বদলে যায়। পরিপার্শ্ব পাল্টে যায়। তার দাড়ি বেড়ে যায় প্রাজ্ঞ রবি ঠাকুরের মতো। উস্কোখুস্কো হয়ে যায় মাথার চুল। চতুর্পাশ্বের প্রভাবে তার মধ্যে একটা বিবর্তন হতে থাকে। গড়পড়তা মানুষের চেয়ে অনেক কম, মাত্র ৭৫ আইকিউ নিয়ে জন্মানো খানিকটা জড়ভরত, খানিকটা প্রান্তিক, খানিকটা সমাজের সঙ্গে লড়তে লড়তে বেঁচে-থাকা ফরেস্টের অন্তিম চরণের জীবন বদলে দেয় সেই দৌড়। ঘরে ফিরে সে আবিষ্কার করে তার সন্তানকে। যার নাম ফরেস্ট জুনিয়র।

১৯৯৩ সালের অগস্টে শুটিং শুরু হয়েছিল ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর। ডিসেম্বরে শেষ। ১৮ বছর পর, কী কাণ্ড, হলিউডের সেই ছবির ‘ফ্রেম বাই ফ্রেম’ রিমেক হল এ দেশে! নাম ‘লাল সিংহ চড্ডা’। আমির খান-করিনা কপূর অভিনীত সেই অক্ষম অনুকরণটি দর্শক দেখতে পেয়েছেন ২০২২ সালের অগস্টে। যদিও একেবারেই দাঁড়াতে পারেনি সে ছবি। ফরেস্টের মতো তার দেশি সংস্করণ লাল সিংহকেও দৌ়ড়বাজের ভূমিকায় দেখা যায়। এ নিশ্চয়ই কাকতালীয় যে, রাহুলের হাঁটন শুরু হয়েছে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে। ‘লাল সিংহ চড্ডা’ মুক্তির এক মাসের মাথায়।

সমাপতন? কে জানে! হতে পারে। না-ও পারে। কিন্তু সেই অনুসন্ধিৎসার চেয়েও বৃহত্তর প্রশ্ন হল— রাহুলের রাজনৈতিক জীবন কি বদলাতে পারবে তাঁর এই যাত্রা?

বদলে যাচ্ছেন এ ভাবেই। কিন্তু রাহুলের রাজনৈতিক জীবন কি বদলাতে পারবে তাঁর এই যাত্রা? ছবি সৌজন্য: ভারত জোড়ো ডট ইন।

বদলে যাচ্ছেন এ ভাবেই। কিন্তু রাহুলের রাজনৈতিক জীবন কি বদলাতে পারবে তাঁর এই যাত্রা? ছবি সৌজন্য: ভারত জোড়ো ডট ইন।

আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর ‘আ প্রমিস্‌ড ল্যান্ড’ বইয়ে রাহুল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ওঁকে দেখে মনে হয়, সব সময় ছটফট করছেন। মনে হয়, ও ক্লাসের সেই ছাত্র, যে দ্রুত নিজের কোর্স শেষ করে শিক্ষককে ইমপ্রেস করতে চায়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিষয়টাকে আত্মীকরণ করতে চায় না। সেই প্যাশনটার একটা খামতিও তার মধ্যে দেখা যায়।’

রাহুলকে বরাবর রাজনীতি-উদাসীন বলে মনে হয়ে এসেছে। যিনি মনে মনে একেবারেই রাজনীতির কুম্ভীপাকে থাকতে চান না। কিন্তু বহিরঙ্গে পারিবারিক ঐতিহ্যের ক্রুশ বহন করতে বাধ্য হন। শতাব্দীপ্রাচীন একটি দলের বোঝা (না কি আসলে দলটাই এখন ‘বোঝা’) জন্মসূত্রে এসে পড়েছে তাঁর উপর। তিনি এ দিক-ও দিক করে কেটে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারছেন না। সে কারণে ঈষৎ ন্যুব্জও বটে।

বাহান্ন বছরের (মধ্যবয়স্কই বলা যায়) এমন এক আপাত-উদাসীন রাজনীতিক কেন কোমর বেঁধে বেরোলেন ভারতকে জোড়ার এই দুর্মর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে! দেড়শো দিন ধরে যিনি হাঁটছেন ৩,৫৭০ কিলোমিটার। কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর— তাঁর এই সফর যাবে ১২টি রাজ্য এবং দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়ে। দেশে ঘৃণা আর বিভেদের প্রতিবাদে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে। জুড়তে। ভারতের অন্তরাত্মার সন্ধানে।

তবে রাহুলের যাত্রায় লোক মন্দ হচ্ছে না। কখনও তাঁর সঙ্গে হাঁটছেন রিয়া সেন, কখনও স্বরা ভাস্কর, কখনও পূজা ভট্ট, কখনও সুশান্ত সিংহ। কখনও রঘুরাম রাজন, কখনও সনিয়া গান্ধী, কখনও প্রিয়ঙ্কা গান্ধী।

কিন্তু এ-ও প্রণিধানযোগ্য যে, ভারতকে জোড়ার এই যাত্রা পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতকে ছুঁচ্ছে না (রাহুলের ‘বকলমা’ নিয়ে অধীর চৌধুরী বাংলায় একটা যাত্রা করছেন বটে। কিন্তু তা মামুলি নিয়মরক্ষার্থে। মা মনসাকে চাঁদ সওদাগরের বাঁ-হাতে ফুল দেওয়ার মতো)। মধ্যপ্রদেশকে সামান্য ছুঁলেও একেবারেই ছোঁয়নি গুজরাতকে। উত্তরপ্রদেশকে স্রেফ বুড়ি ছোঁয়ার মতো করে ছুঁয়েছে। তবু এর নাম ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’।

এ কি প্রচার-চমক? নাটক? না কি সত্যি সত্যিই দেশের মানুষের কাছে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থাকার আহ্বান?

প্রতিদিন গড়ে ৩০ কিলোমিটার করে হাঁটছেন প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি। রোজ ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে তৈরি হচ্ছেন হাঁটা শুরু করার জন্য। চুল-দাড়ি যে দীর্ঘ দিন কাটছেন না, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে নখ কাটছেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে ছবিগুলো ‘জুম’ করে দেখলে। কৌতূহল হয়, কে তাঁর নখ কেটে দিচ্ছে? যে নখ কেটে দিচ্ছে, সে কি চুল-দাড়ি ছেঁটেছুঁটে তাঁকে একটু পরিচ্ছন্ন করতে পারত না? না কি ওই যোগীপুরুষ-সদৃশ চেহারাটাও আসলে প্যাকেজ!

স্বেচ্ছাশ্রম-প্রসূত রাহুলের এই যাত্রা সাধারণ নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে প্রথম থেকেই সংশয়ী অনেকে। সন্দিগ্ধেরা সে কথা বলতেও কসুর করেননি। অনেকে তাঁর এই যাত্রাকে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন (আসলে বলতে চেয়েছেন, রাহুল আডবাণীকে ‘টুকলি’ করছেন)। বলেছেন, আডবাণীর রামরথ নিয়ে সারা দেশ জুড়ে যাত্রার ফল পেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সে না হয় হল। কিন্তু রাহুল ভবিষ্যতের কোন নেতার কথা ভেবে এই ফরেস্ট গাম্প-সুলভ হণ্টন শুরু করেছেন! না কি তিনি আসলে এই হাঁটা শুরু করেছেন নিজেরই জন্য?

তবে রাহুল এ সবে কান দেননি। সম্ভবত তিনি কোনও ব্যক্তির নয়, ‘দল’ হিসেবে কংগ্রেসের এক দীর্ঘমেয়াদি ব্র্যান্ড পুনর্নির্মাণের কথা ভেবেছেন। যা এই ধ্বস্ত দলের পক্ষে রাতারাতি করা সম্ভব নয়। মোদী সরকার দোর্দণ্ডপ্রতাপে আট বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর এটাই কংগ্রেসের তরফে সে অর্থে প্রথম লম্বা চেষ্টা। এতে কংগ্রেসের এখনও পর্যন্ত কী লাভ হয়েছে বলা কঠিন। তবে বাঁ-হাতের কব্জিতে নীল ফিটনেস ব্যান্ড পরিহিত রাহুল আরও ফিট, আরও ছিপছিপে এবং আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

ছ’মাসের যাত্রার শেষে ভারতীয় রাজনীতির ‘ফরেস্ট গাম্প’ কি নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারবেন? ছবি: পিটিআই।

ছ’মাসের যাত্রার শেষে ভারতীয় রাজনীতির ‘ফরেস্ট গাম্প’ কি নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারবেন? ছবি: পিটিআই।

ভারত জোড়ো যাত্রার যা রুট তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া রয়েছে, তাতে আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ জম্মুর পাঠানকোটে পৌঁছে হাঁটা শেষ করবেন রাহুল। তখন কিন্তু আসল হিসেব শুরু হবে। রাহুলের এই যাত্রা কি কংগ্রেসকে রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ় ধরে রাখতে সাহায্য করল? বা কর্নাটক থেকে বিজেপিকে উৎখাত করাতে পারল? দেশে বিজেপির যে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট আছে, তাতে টোল ফেলতে পারল?

ক্রস কান্ট্রি দৌড় শেষে ফিরে এসে জুনিয়র ফরেস্টকে পেয়েছিল গল্পের ফরেস্ট। নতুন জীবন। নতুন দায়িত্ব। নতুন শুরু।

ছ’মাসের যাত্রার শেষে ভারতীয় রাজনীতির ‘ফরেস্ট গাম্প’ কি নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারবেন? না কি অমানুষিক কায়িক শ্রমের এই ইতিহাস শেষ পর্যন্ত তাঁকে শুধুই অ্যাথলিট হিসেবে দুরুস্ত করবে। আর তাঁর গোটা যাত্রাটা বাক্সবন্দি হয়ে কালের মহাফেজখানায় চলে যাবে ‘শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অ্যাথলেটিক মিট’ হিসেবে! সেই বাক্সের উপরে স্টিকারে লেখা থাকবে— পাপ্পু!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy