বইয়ের নাম সাহিত্যমেলা। উপশিরোনাম ‘বিভাগোত্তর পূর্ব-পশ্চিম বাংলা সাহিত্য ১৩৫৪-১৩৫৯’। শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সাহিত্যমেলার বিভিন্ন অধিবেশনের প্রতিবেদন। সম্পাদনা করেছেন ক্ষিতীশ রায়। সম্পাদকমণ্ডলীতে আছেন মেলা-সমিতির সাধারণ সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায়। আছেন লীলা মজুমদার, লীলা রায়, নিমাই চট্টোপাধ্যায়, গৌরী দত্ত। স্বাধীনতা-উত্তর পাঁচ বছরে দুই বাংলার লোকসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, কাব্য ও নাট্যসাহিত্য, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধসাহিত্যের সরেজমিন মূল্যায়ন। উদ্বোধক রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আলোচক, অগুনতি নক্ষত্র। আশুতোষ ভট্টাচার্য, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শান্তিদেব ঘোষ, প্রবোধচন্দ্র বাগচি থেকে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আশাপূর্ণা দেবী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, কাজী মোতাহার হোসেন, অম্লান দত্ত, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ১৫-১৭ ফাল্গুনে আয়োজিত এই মেলায় সীমান্তহীন বাঙালি আর বাংলার সমবেত আত্মবীক্ষণ। সম্প্রতি বইটির প্রতিলিপি-সংস্করণ প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।
কথা অবশ্য অন্য। মূল বইয়ে কোথাও খ্রিস্টাব্দ বা ইংরেজি মাস-তারিখের উল্লেখ নেই। প্রকাশসাল হিসাবে বলা আছে আষাঢ়, ১৮৭৯ শকাব্দ। কালচিহ্নগুলি খ্রিস্টীয় সাল-তারিখে আনতে বেশ কসরত করতে হয়। এ কি কোনও অসচেতন বিভ্রম, না কি সচেতন প্রত্যাখ্যান? দুই বাংলার দীপ্যমান চিন্তাবিদদের কোনও গোপন বার্তা? একেই কি বলে ‘অস্মিতা’? বাংলা আদিযুগের আখ্যানে এমনই কোনও নিশান কি ওড়াতে চেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র? “৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন।”
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, আমাদের ইতিহাসবোধ, সমকালবোধও, আজ আন্তর্জাতিক খ্রিস্টীয় কালপঞ্জির দ্বারা এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে, বাংলা সন-তারিখ, এমনকি শকাব্দ দেখলে একটু বিহ্বল বোধ করি। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, অন্য বহু লোকের বইপত্র বা রচনার তারিখ বাংলা সনে উল্লিখিত হলে সমস্যায় পড়তে হয়। কোন মাস? ঠিকঠাক কী ভাবে বুঝব খ্রিস্টীয় বা ইংরেজি সালটা কী? কেননা, ইংরেজি বছরে ঢুকে থাকে দু’-দু’খানা বাংলা সাল। ও দিকে ঐতিহাসিক পারম্পর্যের কাহিনিবিন্যাসটি খ্রিস্টাব্দের পরিপ্রেক্ষিতেই মনোলোকে সাজানো আছে। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত কালপঞ্জির প্রতি এত আগ্রহ নিশ্চয়ই তারিফযোগ্য, কিন্তু হারিয়ে যাবে না তো ছোট ছোট অনুভূতির বিবিধ বর্ণালি?
টি এস এলিয়ট লিখেছিলেন, ‘এপ্রিল ইজ় দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ...’ (জগন্নাথ চক্রবর্তীর তর্জমায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুর মাস...’)। কে জানে, তারই কোনও সঙ্গ-অনুষঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের ডাকসাইটে ছাত্র সমর সেন লিখেছিলেন কিনা— ‘উজ্জ্বল, ক্ষুধিত জাগুয়ার যেন,/ এপ্রিলের বসন্ত আজ’। চমৎকার, ‘সর্বজনগ্রাহ্য’ অনুষঙ্গ-কাঠামো। ইউরোপের যে কোনও ভাষায় হয়তো অনুবাদ করা সহজও। কিন্তু হুড়মুড় করে ঘিরে ধরল এই মুহূর্তেই, ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’, ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, ‘শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু’, ‘কার্তিকের মাঠে’ জীবনানন্দের ছায়া, ‘প্রকৃতি’ পর্বের গান হাতে রবিঠাকুরের জোব্বা। কবির লেখালিখিতে তো গভীর হয়ে থাকবে তার জল-মাটি-হাওয়ার নিজস্ব চিহ্ন, ঋতুর নাম ইংরেজি নিয়মে থাকুক না-থাকুক— পাঠক কি কেঁপে উঠবেন না এমন পঙ্ক্তিতে— ‘আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে;/ হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি,/ মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে/ মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী।’ বিশ্বসাহিত্যের তদ্গত পাঠক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাংলার ঋতুস্পর্শ এড়াতে পারেননি, তার উপর এই কবিতার নায়িকা তো স্পষ্টতই বিদেশিনি! এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন কবিতার নাম দেন ‘স্বপ্ন, একুশে ভাদ্র’ কিংবা অলোকরঞ্জন লেখেন, ‘আমাকে আমি ভুলেছি এই একুশে আশ্বিনে’, তখন তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, দু’টিই যথাক্রমে ওঁদের জন্মতারিখ! সম্প্রতি পড়লাম, স্মৃতিমূলক একটি নিবন্ধে সবিতেন্দ্রনাথ রায় নজর টেনেছেন ২৮ ভাদ্র তারিখটির দিকে। দুই বন্ধু। দুই কথাসাহিত্যিক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন আর তারাশঙ্করের মৃত্যুদিন। আমরা খেয়াল রাখি? পথের পাঁচালী উপন্যাস জুড়ে বাংলার
ঋতুচক্র প্রায় চরিত্রের মতো বাঙ্ময়, সঙ্কেতবহুল। জানুয়ারি-জুন-ডিসেম্বরের শরীরে তাকে অনুভব করা দুঃসাধ্য।
কথাটা চমৎকার বুঝতেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন শিক্ষাঙ্গনে তাই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল একের পর এক নিজস্ব ‘দিকচিহ্ন’ (বাঙালি অস্মিতা?)। ৭ পৌষ, বর্ষামঙ্গল, এমনকি ‘বুধবার ছুটি’। বিশ্বকবি কোনও ‘কেন্দ্রগতং নির্বিশেষং’ অস্তিত্বে আশ্রম সাজাননি। নিয়তির প্রসাদে হয়তো তার স্বীকৃতিও রয়ে গেল। বহু সাধারণ, বহু মেধাবী, বহু শিক্ষিত মানুষই বলেন, রবীন্দ্রনাথের জন্ম পঁচিশে বৈশাখ ১৮৬১ আর প্রয়াণ বাইশে শ্রাবণ ১৯৪১!
‘পয়লা বৈশাখ’ এলেই হঠাৎ চারিদিকে দেখি এক দিনের বাঙালিয়ানার হুঙ্কার। সকাল থেকে ধুতি-শাড়ি পরে নানা মাধ্যমে লুচি-মাংসে, বাংলা গান-কবিতায়, বাংলা জগঝম্পে কান ঝালাপালা। মনে পড়ে কবি বিষ্ণু দে’র দীর্ঘশ্বাস— ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?’ আমরা আসলে বেশি উদ্যাপন করেছি ক্ষণোন্মাদনার তীব্রতা, ধারণ করেছি কম। উদ্যাপন বাহ্যিক, ধারণ অভ্যন্তরীণ। প্রমিত তথা ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজ়ড’ আন্তর্জাতিক হওয়ার অতি-আগ্রহে ভুলতে চেয়েছি আত্মপরিচয়ের প্রাতিস্বিক চিহ্ন! ইদানীং দেখছি অনেক বই ও পত্রিকায় প্রকাশতথ্যে শুধু ইংরেজি সাল-তারিখ।
তাত্ত্বিক বন্ধুরা অনেকেই হেসে বলেছেন, একে বলে ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’ অথবা ‘হেজিমনি হে, হেজিমনি।’ কিংবা কেউ বলেছেন, ‘গোলকায়নের ভবিতব্য।’ তাত্ত্বিকরা সরেস ব্যাখ্যায় এতই পুলকিত হয়ে ওঠেন যে মোকাবিলার প্রশ্নে বিরক্ত হন। বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা-ডিগ্রির জাঁতাকলে যখন শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিতে হল বিকল্পসন্ধানী বিষণ্ণ রবীন্দ্রনাথকে, তিনি কি বোঝেননি, পথের শেষ কোথায়? তৎসত্ত্বেও নিজস্ব আত্মপরিচয় রক্ষার চিহ্নগুলি সৃষ্টি এবং বিকশিত করার কাজে কি এক মুহূর্তও বিরত থেকেছেন? নিরন্তর, নিরবচ্ছিন্ন সেই ব্রত, পরাজিত হওয়ার নিশ্চিতিতেও কর্মমুখর।
এখন দেশ জুড়ে এক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কর্ণবিদারী ঢক্কানিনাদ— এই সব ‘দেশীয়’ ‘আত্মপরিচয়’ ‘বিকল্পসন্ধান’ ধরনের শব্দ বললেই বহু ধীমান জ্ঞানদীপ্তিমান সন্দেহের কটাক্ষে বিদ্ধ করেন। ভুল বুঝবেন না, আমি বিশ্বাস করি, বাঙালির সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয় নির্মাণ এক দিকে সীমান্তহীন, ধর্মনির্দিষ্টতাহীন, আর অন্য দিকে বহুস্বরিক। তার বহু শরিকও। ‘প্রমিত আন্তর্জাতিকতা’ আর ‘নিজস্ব পরিচয়চিহ্ন’কে বনামবদ্ধ শব্দ-যুগ্মক হিসেবে না-ই বা দেখলাম। কোনও সন্দেহ নেই, আগ্রাসন একটা আছে। খুব বলশালী, ধূর্ত আর কৌশলী সেই আগ্রাসন। তবু, শঙ্খ ঘোষের ভাষায় নিজেদেরই প্রশ্ন করা যায় কি? ‘কিছুতেই কিছু নয় ললাটে না ভাষায় না/ নতনীল বুকে কিছু নয়... কী আমার পরিচয় মা?’
‘আধুনিকতা’ বলতে কেনই বা বুঝতে হবে কোনও একমাত্রিক একঢালা বানানোর প্রকল্পকে? হতে পারে তো এমন এক বহুস্তরিক আধুনিকতা, যেখানে গণতান্ত্রিক এক আবহে সংরক্ষিত হয় সসম্মানে ‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্ত’। ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’। ‘অস্ত্রশালী’ আর ‘নিরস্ত্র’। ‘প্রতাপান্বিত’ আর ‘দুর্বল’। অন্তত একটা ভারসাম্যের দুনিয়া। বাইরের কথা ছেড়ে দিন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ‘আন্তর্জাতিক’ সত্তা আর ‘বাঙালি’ অস্মিতার সংলাপ যদি বন্ধ হয়ে যায়? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘...মুখে তার চাহি/ কথা বলিবারে গেনু— কথা আর নাহি।/ সে ভাষা ভুলিয়া গেছি...’
তার চেয়ে বিশ্বমন অটুট রেখেই নাহয় চৈত্রপবনে মাতি, শ্রাবণরজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসুক চিতে, হেমন্তে শুনি কোন বসন্তের বাণী। বুঝতে চেষ্টা করি কোনটা লালনের গানে বলা ঈশান কোণ, কোনটা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অগ্নিকোণ... কোথায় আলাদা যখন ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে। দুই-ই নাহয় থাকুক। খ্রিস্টাব্দ আর বাংলা সন-তারিখ, বছরভর দু’টিকেই মনে রাখি। আর এক আরম্ভের জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy