রাজ্যের বর্তমান বিধানসভা ভোটের পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে, তা গ্রীষ্মের উত্তাপকেও হার মানায়। রাজনৈতিক সন্ত্রাস, ভাষা সন্ত্রাস, এক শ্রেণির মানুষের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, সমস্ত কিছু বঙ্গবাসীর পরজীবীতে পরিণত হওয়ার বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার দিকে নির্দেশ করে। রাজনৈতিক দলগুলি চায় যে, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য সাধারণ মানুষ যেন তাদের উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ একটি বিপুল জনগোষ্ঠী যেন তাদের উপর নির্ভরশীল থাকে। তারা চায় এই জনগোষ্ঠীকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে, আর সামান্য কিছু দয়াদাক্ষিণ্যের মাধ্যমে সহজেই সন্তুষ্ট করে হাতে রাখতে। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের স্বার্থেই অনুন্নত একটি ‘সিস্টেম’ চালু রাখতে পারে, এবং পশ্চিমবঙ্গে এই জিনিস চলে আসছে বিগত ৪০ বছর ধরে।
বিগত চার দশকে পশ্চিমবঙ্গে কূপমণ্ডূকতার চাষ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর কূপমণ্ডূকতা ও পরজীবী হয়ে ওঠা এতটাই পরিব্যাপ্ত যে, কেউ যদি এখন শিল্প গড়তেও চান, হয়তো পারবেন না, এবং ভোটে হেরে যাবেন। যে দশা আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর হয়েছিল। এবং হালে যে দশা ভাঙড়ে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বসানোর ক্ষেত্রে হয়েছিল। শিল্প চাইলেও গড়তে পারবেন না, আর এটা উপলব্ধি করে কেউ গড়তেও চাইবেন না। মোটের উপর, আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
হালের কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য ও ভাষণের দিকে লক্ষ করা যাক। কেউ বলছেন যে, আপনারা এই রাজ্যেই থাকুন, যেটুকু রোজগার করছেন সেটা জমান, আমরা সব বিনামূল্যে দেব। অর্থাৎ, আপনাদের বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই, অন্য রাজ্যে চাকরি করতে যাওয়ার দরকার নেই, আপনারা এই রাজ্যেই চপ-মুড়ি ভাজুন। আর পাঁচ বছর অন্তর ভোটটা আমাদের দিয়ে যান, তা হলেই হবে। কেউ সোনার বাংলা গড়ার ও কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার করছেন।
কেউ আবার বলছেন, বিগত দিনে আমরা বেশ কিছু ঐতিহাসিক ভুল করেছি, যা আমরা স্বীকার করছি। কিন্তু এখন আর স্বীকার করে কী হবে? যে সর্বনাশটি হয়ে গিয়েছে এবং যা এখন বৃহৎ বঙ্গ-জনগোষ্ঠীর মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে, তা থেকে তো সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বাড়িতে একটি বিড়াল ছিল। বিড়ালটি খুব সুন্দর লাফিয়ে লাফিয়ে শিকার করত। এর জন্য আমরা তাকে খুব ভালবাসতাম। অধিক ভালবাসায় সেটি আমাদের পোষ্য হয়ে ওঠে; তাকে আদর করে দুধ, মাছ ইত্যাদি খাওয়ানো শুরু করি। কিছু দিন পর থেকে শিকার করা বন্ধ ও তার কিছু দিন পর থেকে শুধু ঘুম আর আহার, আহার আর ঘুম। বিনামূল্যে সব কিছু পেলে আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ঘুম আর আহারে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে, হয়তো গিয়েছেও। তাই হয়তো এত রাজনৈতিক হিংসা— নিজের ঘুম আর বিনামূল্যের আহারকে সুরক্ষিত রাখতে।
তবে আমার বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গবাসী দয়ার দান-এর চেয়ে সম্মানের জীবনযাপন পছন্দ করবেন, আর সেই জন্যই এত পরিযায়ী শ্রমিক বাংলার বাইরে যান জীবিকার সন্ধানে। এই সম্মানের জীবন পশ্চিমবঙ্গবাসীর অধিকার, যা আসতে পারে শুধু কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলির উচিত কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া— দান খয়রাতির নয়।
শুধু সাধারণ মানুষ কেন? লেখক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, অধ্যাপক, আইনজীবী, সবাই হয় এই দলের সক্রিয় সমর্থক, নাহয় ওই দলের। বাঙালির জীবনে রাজনীতি কতটা অঙ্গাঙ্গি, তার একটা সামান্য উদাহরণ দেওয়া যাক।
২০১১ সালের পালাবদলের ঠিক আগে আমি কলকাতার একটি মোটামুটি মধ্যবিত্ত অঞ্চলে ছোট বাসস্থান কিনি। কেনার পর যিনি আমাকে কিনতে সাহায্য করেছিলেন, তাঁর কাছে জানতে চাই যে, আমার হবু প্রতিবেশীরা কে কী করেন। তিনি আমাকে প্রত্যেক বাড়ি ধরে কারা ‘বামপন্থী’ আর কারা ‘বামপন্থী’ নন, সেটা বলতে থাকেন। আমি অবাক হয়ে বলতে যাচ্ছিলাম যে, এটা আমি জানতে চাইনি, কার কী পেশা জানতে চেয়েছি— কিন্তু, নিজেকে সংযত করি, আর উপলব্ধি করি যে, ওঁর কাছে এক জন ব্যক্তির পরিচয় তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, তা দিয়ে।
উনি কোনও ব্যতিক্রম নন। দশ বছর আগে যা একটি রোগ ছিল, এখন তা মহামারিতে পরিণত হয়েছে। অনেক শিল্পী বন্ধুর কাছে শোনা, এখন রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া অভিনয়ে ভাল সুযোগ পাওয়া যায় না, বা ভাল অনুষ্ঠানে ডাক পাওয়া যায় না। আপনাকে পরজীবী হতেই হবে, আপনার প্রতিভা থাক, বা না থাক। খুব আত্মবিশ্বাসী কয়েক জন হয়তো এই রাজনীতিকরণকে উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু বেশির ভাগই পারবেন না। শিক্ষাক্ষেত্রের রাজনীতিকরণ সম্বন্ধে আমরা জানি, তা অবশ্য বিগত চার দশক ধরেই আছে। তা নিয়ে আর কথা না-ই বা বাড়ালাম। আমার বাড়িতে যে মহিলা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন, তাঁর পুত্র অটো চালান। ওঁর কাছেই শোনা যে, রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া ওঁর পুত্রের অটো রাস্তায় নামাতে দেওয়া হবে না। তাই ওঁকে বাড়ি যেতেই হবে ভোট দিতে।
আমাদের জীবন, জীবিকা সর্বত্র রাজনীতি। রাজনৈতিক সমর্থন থাকলে তবেই এক জনের বাঁচার অধিকার, নচেৎ নেই। আমাদের কোনও ব্যক্তিপরিচয় নেই— হয় আমরা এই পার্টির, নাহয় ওই পার্টির! খুব আশ্চর্য লেগেছিল এটা শুনে যে, বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিক সুদূর কেরল থেকে নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ফিরেছিলেন ভোট দিতে। কেন ফিরেছিলেন? তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন বলে? কিসের আশায়? এই রাজ্য তাঁদের চাকরি দিতে পারেনি। তা হলে কি কোনও ভয়ে? না কি, কোনও বদলের আশায়? এই কথাগুলো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়, কারণ সুদূর কেরল থেকে রাজ্যে ফেরার খরচ কম নয়। আর পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে এঁদের আয়ও বেশি নয়। কেন ফিরলেন তাঁরা?
আকিরা কুরোসাওয়ার রশোমন ছবিটির কথা মনে পড়ে যায়। এক মহিলার উপর একটি মধ্যযুগীয় বর্বরতার কাহিনি। একটিই ঘটনা, কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি সেই ঘটনাকে বিভিন্ন ভাবে দেখছে, বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করছে। কুরোসাওয়া হয়তো ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করার আঙ্গিক থেকে বিষয়টি দেখেননি, কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। বর্তমানের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অনেক অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। আমাদের প্রত্যেকের দেখা উচিত, যাতে এই জাতীয় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর না ঘটে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষুদ্র স্বার্থে এই ঘটনাগুলির নানা প্রকার ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করা হয়, যা সমস্যার সমাধান তো কোনও ভাবেই করে না, বরং পরিস্থিতি আরও জটিল ও উত্তেজক করে তোলে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই খেলায় কিছু তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিও জড়িয়ে থাকেন। প্রত্যেকের নিজেদের ‘অ্যাজেন্ডা’ আছে আর তাঁরা সেই অনুসারে কাজ করছেন, অনেকটাই ক্ষুদ্র স্বার্থে।
রাজনৈতিক দলগুলি ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা করবে, এতে আমি অবাক নই। সংবাদমাধ্যম এই ঘটনাগুলিকে উত্তেজক করে ‘টিআরপি’ বাড়ানোর চেষ্টা করবে, এতেও আমি খুব অবাক নই। ওঁরাও এই ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’র-ই অঙ্গ। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ফেক নিউজ়’, যা ‘সোশ্যাল মিডিয়া’র মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরাও যন্ত্রের মতো সেগুলি এ দিক-ও দিক পাঠিয়ে চলেছি। সাধারণ মানুষের এর থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। আমরা বড় বেশি রাজনৈতিক হয়ে গিয়েছি। এতে কোনও লাভ নেই, উল্টে রাজনৈতিক হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে চারিদিকে।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy