দ্রষ্টা: নতুন দেশের জন্মের পর বাংলাদেশের দুই শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদ্যাপন করল বাংলাদেশ, গণপরিষদ কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদনেরও অর্ধশতক হল। একটা নতুন দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে কোন মতাদর্শ বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং কেন, এখন হয়তো তা ফিরে দেখার সময়।
যেমন ধরা যাক, ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের প্রথম আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে আমায় বলেছিলেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় এই নীতিটির গুরুত্ব উদ্ভাসিত হয়েছিল। তৎকালীন প্রাইম মিনিস্টার-ইন-এগজ়াইল তাজউদ্দীন আহমদ ইসলামের নামে পূর্ব পাকিস্তানের উপর নেমে আসা পাক-আক্রমণের মুখে এই মতবাদের প্রচার করেছিলেন। ১৯৭১-এর মে মাসে আঠারো দফা ঘোষণাপত্রে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান ‘ধর্ম দল ও শ্রেণি-নির্বিশেষে বাঙালি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ’ হতে। বাংলাদেশ বেতারে নিয়ম করে কোরান, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ সম্প্রচারিত হত, ঠিক যেন গান্ধীর বহুধার্মিক প্রার্থনাসভার মতো।
তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থনে আরববিশ্বকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ‘ইয়াহিয়া খানের সেনারা ইসলামের অধিকারের জন্য লড়ছে’, এই পাক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। একই কাজ করেন মৌলানা ভাসানীও, মিশরের আনোয়ার সাদাত, আরব লিগের আবদেল খালেক হাসুনা-সহ বিশ্বের নেতাদের উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর চিঠিতে বলেন, এক মুসলিম সেনাবাহিনী কী অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে প্রধানত মুসলমান এক জনগোষ্ঠীর উপরে। এর আগেও ১৯৫৬-তে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে গণপরিষদের বিতর্কে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদ করেছিলেন বিনা বিচারে কারাবন্দি করে রাখার বিষয়ে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, বিনা বিচারে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না, এমনকি সৃষ্টিকর্তাও তা করেন না। কিন্তু তথাকথিত ‘ইসলামিক সংবিধান’ কিনা বলে, ‘শৃঙ্খলা রক্ষায় ও পাকিস্তানের স্বার্থে’ যে কাউকে বিনা বিচারে বন্দি করা যেতে পারে।করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের বলা হয়, তারা যেন পাকিস্তানের পক্ষে অবমাননাকর কোনও কর্মকাণ্ডে না জড়ানোর শপথ নেয়— মুজিব এরও বিরোধিতা করেছিলেন: ছাত্ররা দেশবিরোধী, এ ভাবনা নিতান্ত অমূলক। দেশের নাম হবে পাকিস্তানি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন শুধু মুসলিম— মুজিব ও সুরাবর্দির মতো নেতারা এ সবের প্রতিবাদ করেন।
তা সত্ত্বেও, চোদ্দো বছর পর যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন যে, ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’-এর (এলএফও) যে পাঁচটি মৌলিক নীতির অধীনে দেশে নির্বাচন হবে তার একটি হল ইসলামি মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য, এবং এটিই ‘পাকিস্তানের উদ্ভবের ভিত্তি’, আওয়ামী লীগ তা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু হাওয়া ঘুরে গেল যুদ্ধের সময়, ইসলামের নামে নিপীড়নের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার পালে বাতাস এল। তবু প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কী ছিল?
যুদ্ধ শেষের কিছু পরেই তাজউদ্দীন আহমদ এক বৌদ্ধ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ অবজ়ার্ভার পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন বাংলাদেশ হবে এক সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটি ধর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন রাষ্ট্র কোনও ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না, সেই সঙ্গে এ-ও বলেন: ধর্মের নামে কেউ মানুষকে শোষণ করবে, রাষ্ট্র তা হতে দেবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার এই বোধ— যে কোনও রকমের সাম্প্রদায়িকতা, কোনও একটি ধর্মের পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে পাশে থাকা, রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার, কোনও বিশেষ ধর্মের আচরণকারীকে নিপীড়ন বা তাঁর প্রতি বৈষম্য, এই সব ক’টির অনুপস্থিতি— বাংলাদেশের সংবিধানের ৮ নং অনুচ্ছেদে সুরক্ষিত হয়। ১৯৫৬ (এবং ১৯৭৩)-র পাকিস্তান সংবিধানের বিপ্রতীপে বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ কোনও মুসলিমের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি।
নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধান বিল পাশ হওয়ার আগের ভাষণে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মাচরণের বিরোধিতা নয়। তাঁর আপত্তি ছিল ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহারে— যেমন হয়ে আসছিল তার আগের পঁচিশ বছর ধরে। “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে— তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে— তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে... খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।” ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থে সব ধর্মকে সম্মান, এই বোধ মুজিবের একার ছিল তা নয়। সেই সময়ের তোলা ছবিতে দেখা যায়, তাঁর ভাষণের পর ধর্মগ্রন্থ পাঠ হচ্ছে, সমগ্র গণপরিষদ শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে আছেন।
বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার এই বোধ— ধর্মাচরণের বিরোধিতা না করা— বারংবার বোঝাতে হয়েছিল অন্যান্য দেশের মুসলিম নেতাদের, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকারে যাঁরা খুব আগ্রহী ছিলেন না। স্মৃতিকথায় কামাল হোসেন বলেছিলেন, পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে বাংলাদেশকে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, লাহোরে ইসলামি সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিতে পারেন তার জন্যও বিস্তর চেষ্টা লেগেছিল। পাকিস্তানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত শোনার স্মৃতিচারণ করেছেন কামাল হোসেন, গার্ড অব অনারের সময় মিলিটারি ব্যান্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ বেজে উঠল প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে, জেনারেল টিক্কা খান-সহ পাক প্রধানরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করলেন! এই সেই রবীন্দ্রসৃষ্ট ‘আমার সোনার বাংলা’, যে রবীন্দ্রনাথের গান ‘ইসলাম-বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল রেডিয়ো পাকিস্তান।
কামাল হোসেন বিশদে বলেছেন সৌদি আরবের রাজা ফয়সলের সঙ্গে সাক্ষাতের কথাও। ফয়সল যখন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটি তুললেন, কামাল তাঁকে বোঝালেন কোন পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সংবিধানে এই নীতি গৃহীত হয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত পাকিস্তান ১৯৭১-এ (এবং তার আগেও) এমন সব কাজ করেছে যা ইসলামের পক্ষে অবমাননাকর, দেশের জন্যও বিধ্বংসী। বুঝতে যেন ভুল না হয় যে, বাংলাদেশের মুসলিমরা পাকিস্তানি মুসলিমদের থেকে কোনও অংশে কম ধর্মপ্রাণ নন। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে ধর্মের অপব্যবহার আর অসহিষ্ণুতার জেরে ভুক্তভোগী দেশ সংবিধানে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতামুক্ত পরিবেশ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ইসলাম ও নবির মতাদর্শের সঙ্গে এর সাহমত্য— ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নাগরিকরা যাতে ধর্মের নামে কাউকে পীড়ন না করেন, তা নিশ্চিত করা। মুসলিম সংখ্যাগুরু রাষ্ট্র বাংলাদেশে বরাবরই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহনশীলতার এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ছিলই। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ‘নন-অ্যালাইনড সামিট-এ শেখ মুজিব প্রায় একই কথা বলেন গদ্দাফিকে: বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু ধর্মবিরোধিতা নয়, তার অর্থ সকল ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্প্রীতি।
ধর্মের অপব্যবহার কোন পর্যায়ে যেতে পারে, যুদ্ধই বুঝিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। ভারতও তখন সাক্ষী ছিল এক পরিবর্তনের। কংগ্রেসের সদস্যরা সংসদে ঘোষণা করছিলেন, একমাত্র ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার জোরেই পাকিস্তানের ‘দ্বি-জাতি’ তত্ত্বকে পরাস্ত করা সম্ভব। অন্য দিকে, আরএসএস কর্মপন্থা প্রসঙ্গে নাগপুরের সালভে বলেছিলেন, আরএসএস-কে সাংস্কৃতিক সংগঠন বলা হয়ে থাকে, কিন্তু মুসলিম আর খ্রিস্টানদের কাছে যে সংগঠনের দরজা বন্ধ, তার সংস্কৃতি কোন ভারতের সংস্কৃতি? খ্রিস্টান বা মুসলিমের কি চরিত্রগঠনের দরকার নেই? সালভে জনসঙ্ঘ ও কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গির তফাতও বুঝিয়েছিলেন। জনসঙ্ঘ নাকি বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে খুশি, ভারতের অবদানেও; কিন্তু তাদের আর কংগ্রেসের খুশি হওয়ার কারণে তফাত আছে। কংগ্রেসের কাছে এ ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের পক্ষে লড়াই; আর জনসঙ্ঘের কাছে এ ছিল এক ইসলামি রাষ্ট্রের ধ্বংস হওয়ার যুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কংগ্রেস পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়নি, কিন্তু জনসঙ্ঘের মত ছিল ভিন্ন।
যুদ্ধের পরবর্তী মাসগুলোয়, এবং ১৯৭১-এর সাধারণ নির্বাচনে (যেখানে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়) ভারতের সংসদ ভারতীয় দণ্ডবিধির সেই সব ধারায় সংশোধন এনেছিল, যাতে সাম্প্রদায়িক ও আধাসামরিক সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়; দেশের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়বিশেষের বিরুদ্ধে আঙুল তোলাকে অপরাধ বলে গণ্য করা যায়। চার বছর পর, ইমার্জেন্সির সময় সংবিধান সংশোধন করা হয়, প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি ঢোকানো হয়। তাতে অবশ্য আরএসএস-এর দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া আটকানো যায়নি।
ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy