পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এ চালু হয়েছিল ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে সহায়তার অঙ্ক বাড়িয়ে হাজার টাকা (সাধারণ) ও বারোশো টাকা (তফসিলি জাতি-জনজাতি) করা হয়। এই প্রকল্পের দৌলতে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন আরও বেড়েছে, এমন কথা শাসক ও বিরোধী, সব দলের নেতারাই বলেছেন। ভোট-পরবর্তী সমীক্ষাতেও সেই তথ্য দিয়েছে। অনেকের মতে নগদ টাকায় অনুদান, কিংবা সরকারি সহায়তায় আবাস, রেশন, রান্নার গ্যাসের মতো জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোই ভোটের লড়াইতে তুরুপের তাস। এর আর মার নেই।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? অন্ধ্রের সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডির একটা চলতি নাম ছিল, ‘বোতাম-টেপা মুখ্যমন্ত্রী’। তিনি নিজেই বলতেন, তিনি বোতাম টিপলেই জনগণের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে। অন্ধ্রে জনকল্যাণের প্রায় সব সরকারি উদ্যোগই ‘বোতাম-টেপা প্রকল্প’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য নেতা-আমলারা সে কথা বড়াই করে প্রচারও করতেন। কিন্তু তাতেও নির্বাচনে ধরাশায়ী হলেন। কেন্দ্রে বিজেপি-ও গত কয়েক বছরে বোতাম টেপা জনকল্যাণের পথেই গিয়েছে। উজ্জ্বলা গ্যাসের ভর্তুকি, চাষিদের অনুদানের প্রকল্প পিএম-কিসান, শূন্য ব্যালান্সে জনধন অ্যাকাউন্ট, পিএম আবাস, একশো দিনের কাজের মজুরি, সবই বোতাম টিপে জনগণের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তবু সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে বিজেপি।
কংগ্রেস কর্নাটকে গত বছর ক্ষমতায় এসে চারটে প্রকল্প চালু করেছিল— বিনামূল্যে দশ কেজি চাল, মেয়েদের বাস ভাড়া মকুব, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত নিখরচায় বিদ্যুৎ, এবং বেকার ভাতা। ভোটের বাক্সে তার ফল পাওয়ার আশায় রাজ্য সরকার জেলা পরিষদ ও তালুক (ব্লক) পঞ্চায়েত নির্বাচন পিছিয়ে দিয়েছে। পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠায় কর্নাটক অন্যতম পথিকৃৎ হওয়া সত্ত্বেও ওই দুই স্তরের ভোট স্থগিত রাখল কংগ্রেস, কারণ দল ধরে নিয়েছিল যে, ওই জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর বিনিময়ে এক বারই কংগ্রেসকে সমর্থন দেবেন ভোটদাতারা। তাই প্রকল্প চালু হওয়ার পর তাঁরা লোকসভা ভোটকেই প্রথম নির্বাচন রাখতে চেয়েছিলেন। তাতে সাতটা আসন বেড়েছে কংগ্রেসের, তবে সতেরোটা নিয়ে বিজেপি এগিয়ে। আশানুরূপ লাভ দেয়নি চারটি প্রকল্প।
এ বারের ভোট-পরবর্তী সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে রেশন, পিএম আবাস, একশো দিনের কাজ, উজ্জ্বলা প্রভৃতি প্রকল্পের উপভোক্তাদের প্রায় ৬০% কেন্দ্রীয় সরকারকে সেগুলির কৃতিত্ব দিচ্ছেন, কিন্তু ভোট দেওয়ার বেলায় তাঁদের ৪৫% বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ জনকল্যাণ ও ভোটের সম্পর্ক খুব সোজাসুজি নয়। কয়েকটি জনকল্যাণ প্রকল্প, আর তার সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক পর্যালোচনা করতে গিয়ে একটি অদ্ভুত নকশা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে দল যে প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সরকারে এসে তা রূপায়ণ করলে ভোটে খুব বেশি সুফল মিলছে না। কর্নাটকের মানুষের মনোভাব যেন এই যে, ফ্রি চাল, ফ্রি বাসের টিকিট তো পাওয়া গেল, এর পর কী? অন্ধ্রে জগন রেড্ডির বেশ কিছু জনকল্যাণ প্রকল্প যথেষ্ট সফল। অথচ, ভোটদাতা তা দেখে আর ভোট দিতে নারাজ।
তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কেসিআর-এর ‘রায়তবন্ধু’ এক বারই সুফল দিয়েছিল। ২০১৮-র জুন মাসে চাষিদের অনুদানের প্রকল্পটি চালু হয়, আর ডিসেম্বরে ১১৯টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৮৮টি জেতে বিআরএস। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ২০১৯-এ লোকসভার তার আসন হয়ে দাঁড়াল ন’টি, হিসাব মতো হওয়ার কথা ছিল কমপক্ষে ১৬টি। এ বারে তো ভরাডুবি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সরকারে ক্ষমতাসীন দল নতুন জনকল্যাণ প্রকল্প শুরু করার অল্প দিনের মধ্যে নির্বাচন হলে তার প্রভাব থাকে। বেশি দিন হয়ে গেলে প্রভাব ফিকে হয়ে যায়। তাই আন্দাজ করা যায়, লক্ষ্মীর ভান্ডারের বর্ধিত টাকা পরবর্তী নির্বাচনে খুব একটা কাজে আসবে না।
প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে, এর পর কী— এই প্রশ্ন কাজ করেছে রামমন্দির নিয়েও। ফেব্রুয়ারি মাসে রামমন্দির হল অযোধ্যায়, সেখানেই ফৈজ়াবাদ লোকসভা আসনে বিজেপি হারল। ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রতিশ্রুতিও বিজেপি দিয়ে এসেছে দীর্ঘ দিন। অথচ, ৩৭০ ধারা বাতিলের কয়েক বছর পরে কাশ্মীরে বিজেপি প্রার্থীই দিতে পারল না। জোটও করতে পারল না।
অবশ্যই মনে রাখতে হবে, নির্বাচনী ফলাফল শুধু অনুদান বা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রভাবের উপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন কারণ একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে সরকারের বিরুদ্ধে, বা সরকার পক্ষে, হাওয়া তৈরি করে। কখনও একটা কারণ অন্যটিকে খারিজও করে। এ ছাড়া রয়েছে দলের জনপ্রিয়তা, প্রার্থীর ভাবমূর্তি, জাতি-ধর্মের সমীকরণ, দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা, প্রচার কৌশল, ইত্যাদি। অবশ্য সারা দেশে যদি কোনও একটি পক্ষে (বা বিপক্ষে) জোরালো নির্বাচনী হাওয়া থাকে— যেমন ২০১৪ বা ২০১৯-এ ছিল— তখন ওই হাওয়ায় বাকি কারণগুলি উড়ে যায়।
এ সব সত্ত্বেও ‘পাইয়ে দেওয়া’ প্রকল্পের কিছু সুবিধা হয়তো মেলে নির্বাচনে। তবে ইঙ্গিত মিলছে যে, এগুলি থেকে ভোট পাওয়ার একটা মেয়াদ আছে। একটা সময়ের পরে খুচরো জনকল্যাণ আর কাজ করে না। শহরে আর গ্রামেও পার্থক্য হয়— নানা তথ্য দেখাচ্ছে যে, জনকল্যাণের প্রকল্প শহরে খুব একটা দাগ কাটে না। আম আদমি পার্টি দিল্লিতে মেয়েদের ফ্রি বাসের পাস, সুলভে জল ও বিদ্যুৎ কার্যকর করেছে। মহল্লা ক্লিনিক, সরকারি স্কুলের উন্নতিও করেছে। অথচ, লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে তাদের প্রাপ্তি শূন্য। যা দেখে মনে হয়, জনকল্যাণ, সরকারি পরিষেবায় উন্নতির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাও প্রত্যাশা করেন শহরের মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy