Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Election

ভোটার যাক, ভোট থাক?

সমীক্ষা বলছে, দেশের ৩১ শতাংশ মানুষ এখন ভোট চান না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রায় একশো শতাংশ মানুষ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:২৩
Share: Save:

পুরভোট পিছোল। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল। এই সিদ্ধান্ত নিতে এত দিন লাগে কী করে? কেবল পুরভোটের প্রশ্নই নয়। প্রতি দিন যখন দেশে আড়াই লক্ষ আর রাজ্যে প্রায় ২৫০০০ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন— আশ্চর্য— তখন কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছে কী করে? অথচ নির্বাচনের মধ্যে সংক্রমণ আগেও বেড়েছে, এখন ভোট হলে আবারও সংক্রমণ বাড়বে, এ নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, যা পরিস্থিতি, তাতে নির্বাচন হলে দেশে হয়তো প্রতি দিন দশ লক্ষের কাছাকাছি আর রাজ্যে পঞ্চাশ হাজারের মতো মানুষ নিয়মিত আক্রান্ত হতে পারেন।

সমীক্ষা বলছে, দেশের ৩১ শতাংশ মানুষ এখন ভোট চান না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রায় একশো শতাংশ মানুষ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু তাতে কী। নীতি ঠিক করেন নেতারা! এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মানুষের স্বার্থবিরোধী হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলিতে আইনের ফোড়ন ছড়িয়ে, কিছু ‘কঠিন শর্তাবলি’ চাপিয়ে, তাকে আইনসিদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই যেমন সাগরমেলার ক্ষেত্রে ঘটল। এক সঙ্গে পঞ্চাশ জনের বেশি জমায়েত করা যাবে না বা পাঁচ জনের বেশি বাড়ি বাড়ি প্রচারে যেতে পারবেন না— এ সব বিধি কি ভাঙার জন্যই তৈরি হল না? খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, যখনই এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে যাতে সাধারণ মানুষের সুবিধা হলেও রাজনৈতিক স্বার্থের কিছু প্রত্যক্ষ বা এমনকি পরোক্ষেও ক্ষতি হতে পারে— তখনই রাজনৈতিক দলগুলি মহাজোট করে ফেলে। পরিবেশ থেকে শিল্প, এমন উদাহরণ সাম্প্রতিক কালেই প্রচুর।

রাজ্যের গত বিধানসভা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত মাপের বড় জয় পাওয়ার পর এক পোড়-খাওয়া তৃণমূল নেতা বলেছিলেন, ঘোর কোভিড সংক্রমণকালে প্রতিবাদকে পাত্তা না দিয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের আট দফা নির্বাচনের ফতোয়া বজায় রাখাই নাকি তৃণমূলের জয়ের কারণ। বিজেপির এই কৌশল ‘অন্যায়’ বলেই নাকি মনে করেছিল আমজনতা। দেখা যাচ্ছে, মাত্র কয়েক মাসের তফাতে পাশা পাল্টে গিয়েছে। রাজ্যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ীই সংক্রমণের হারে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে উপরের সারিতে। সরকারি হিসাবে রাজ্যের প্রতি তৃতীয় মানুষ কোভিড-আক্রান্ত। এমন অবস্থায় রাজ্যে পুর নির্বাচন নিয়ে শাসক পক্ষ যা অবস্থান নিয়েছিল, তা কি সেই গত বছরের কেন্দ্রীয় শাসকের অবস্থানের থেকে এক চুলও আলাদা?

অবশ্য এমন সিদ্ধান্তের ফলে কোনও বড় রাজনৈতিক সঙ্কট ঘটবে, এমন আর ভাবার পরিসর নেই। রাজ্যের কথাই যদি ভাবি, তৃণমূল কংগ্রেস এখন রাজনৈতিক ভাবে বহু যোজন এগিয়ে এবং আগামী পাঁচ বছর রাজ্যের তখতে থাকা দলকে হারিয়ে উন্নয়নের বিড়ম্বনায় বোধ হয় পড়তে চাইবে না কোনও শহরই। ও দিকে গোড়ায় দলছাড়া আর বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়ার যৌথ ধাক্কায় বর্তমান বিরোধী দল বিজেপি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে।

তা হলে, ইচ্ছা করলেই সরকার বা নির্বাচন কমিশন সাধারণ মানুষের উপর সাংবিধানিক জবরদস্তি করতে পারে আমাদের দেশে, যেখানে ভোটের প্রচারে দশ হাজারি মিছিল, ত্রিশ হাজারি জমায়েত না করলে, বাড়ি বাড়ি কুড়িটা বাইক আর তাতে চল্লিশটা দামাল ছেলে নিয়ে যেতে না পারলে মাঝারি নেতাও রীতিমতো মনঃক্ষুণ্ণ হন? যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় লক্ষ মানুষের ব্রিগেড দেখে বিহ্বল হয়ে যান?

নির্বাচনী প্রক্রিয়া কোভিড বাড়াবে, এই যুক্তির পাশাপাশি আর একটি কথাও উঠে আসছিল। ভারতীয় সংবিধানে দেশের প্রত্যেক মানুষকে ভোট প্রয়োগের সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে, কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে। প্রশ্ন হল, ভোটারের এক-তৃতীয়াংশ বা বেশি যদি কোভিড-আক্রান্ত হয়ে ঘরবন্দি হন তাঁদের পরিবারের সঙ্গে, তবে সংবিধানের সেই ধারাকে যথেষ্ট ভাবে মান্য করার মতো পরিস্থিতি থাকে কি? আইন কী বলে? আর, আইনের উপরে যে নীতি— তা-ই বা কী বলে?

এ ক্ষেত্রে কোভিড-আক্রান্তদের জন্য যে ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাকে অর্থহীন বলা যেতে পারে। প্রথমত এমন শারীরিক অবস্থায় একটা বড় অংশের মানুষ ভোটবুথ অবধি যাওয়ার ক্ষমতা রাখবেন না। অথচ নাগরিক তো নিজের দোষে কোনও রোগে ভুগছেন না, অতিমারিতে ভুগছেন। তবে কেন এঁদের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভোট পিছোনোর কথা ভাবা এত কঠিন হচ্ছিল?

খোঁজ নিলে দেখব, ভোট পিছোনো কিছু অদ্ভুত বিষয় নয়, সারা পৃথিবীতেই তা ঘটছে। গত দুই বছরে সারা পৃথিবীতে নানা দেশে প্রায় ৬০টি ভোট পিছোনোর ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ভোট হয়েছে যেখানে নানান নতুন প্রক্রিয়ায় বিপদকে কমিয়ে ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ দেশে অবশ্য এমন কথা ভাবাও যায় না। না, পরিকাঠামোর ন্যূনতার কারণে নয়। কারণ, সোজা হিসাব— এ দেশের রাজনীতিকরা মনে করেন, ভোটের খাতিরেও ভোটারের কোনও গুরুত্ব নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Election Pandemic Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy