প্রতীকী ছবি।
অর্থনীতি বহু রকমের দুর্বিপাকে পড়তে পারে, কিন্তু কর্পোরেট ভারত এক দুর্যোগের দশক পার হয়ে বর্তমানে এমন এক উজ্জ্বল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, যা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত ২,৭৮৫টি সংস্থা ২০২১-২২ সালে তাদের পণ্য বিক্রি করে ৯.৭ শতাংশ লাভের মুখ দেখেছে। এমন ঘটনা গত এক দশকে তো দেখাই যায়নি, বরং বলা চলে ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সঙ্কটের কাল থেকেই দৃশ্যমান হয়নি। দু’বছর আগে, ২০১৯-২০ (মূলত প্রাক-অতিমারি সময়টিতে) সাল নাগাদ লাভের পরিমাণটি ছিল পণ্য বিক্রি করা অর্থের ৩.৪ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ের আগে ২০০১৬-১৭-ই বোধ হয় ছিল এই দিক থেকে দেখলে সব থেকে উজ্জ্বল বছর, যখন লভ্যাংশের অনুপাতটি ছিল ৭.২ শতাংশ। এ ছাড়া, বেশির ভাগ বছরেই এই সংখ্যাটি ৬ শতাংশের আশপাশে থেকেছে। এমত পরিস্থিকে মাথায় রেখে দেখলে ৯.৭ শতাংশকে এক বিরাট উল্লম্ফন বলেই মনে হবে।
লভ্যাংশের এই উল্লম্ফনের পিছনে মূলত চারটি কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, বেশির ভাগ সংস্থাই তাদের ঋণ মিটিয়ে দিয়েছে। ফলে তাদের তরফে প্রদেয় সুদের পরিমাণও কমেছে। দ্বিতীয়ত, অর্থ-ক্ষেত্রগুলিতে (ব্যাঙ্ক, ‘শ্যাডো ব্যাঙ্ক’ বা প্রথাগত ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের বাইরে ব্যাঙ্কের অনুরূপ কাজ করা সংস্থাগুলি, বিমা সংস্থা, দালালির ক্ষেত্র ইত্যাদি) পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষতিকারক ঋণ এবং হতশ্রী ব্যালান্স শিট গ্রোথ-এর প্রেক্ষিতে এই পুনরুজ্জীবন অবশ্যই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। গত তিন বছরে অর্থ-ক্ষেত্রগুলির লাভের পরিমাণ চারগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলির লভ্যাংশে অর্থ-ক্ষেত্রের ভাগের পরিমাণ ২০১২-১৩-র ২৭ শতাংশ থেকে ২০১৭-১৮ নাগাদ ৮ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তা বেড়ে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি উজ্জ্বল ছবি।
তৃতীয়ত, বেশ কিছু সংস্থা পণ্যের দাম কমিয়ে অতিমারির সময়ের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলায় সফল হয়েছিল। ২০২০-২১ নাগাদ এই প্রবণতা নাটকীয় ভাবে দেখা গিয়েছিল, যখন পণ্য বিক্রি প্রায় ৪ শতাংশ কমে গেলেও মোট লাভ বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছিল। এক বছর পরে আবার তা ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এবং চতুর্থত, সংস্থাগুলি অর্থমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত কর্পোরেট লভ্যাংশের উপরে প্রযোজ্য কর হ্রাসের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবের সঙ্গে সংস্থার ইচ্ছানুযায়ী কোনও কোনও ক্ষেত্রে ছাড় না নেওয়ার প্রস্তাবও ছিল। সংস্থাগুলি তাদের পক্ষে লাভজনক প্রস্তাবটিকেই গ্রহণ করে। সুতরাং সার্বিক ভাবে কর্পোরেট-করের হার (লভ্যাংশের অনুপাতে) কমে আসে। এর অনিবার্য ফল হিসেবে কর প্রদানের পরে থেকে যাওয়া লভ্যাংশের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
এ সবের ফলে আজকে দেখা যাচ্ছে যে, বেশ কিছু সংস্থা নতুন উদ্যমে বিনিয়োগ করতে এবং নিশ্চিন্তে তাদের ব্যবসা বাড়াতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। একই ভাবে, এই মুহূর্তে ব্যাঙ্কগুলিও পুনরায় স্বচ্ছন্দ বোধ করছে ঋণ প্রদানের ব্যাপারে। এই উজ্জ্বল ছবির মাঝে একটিই নেতিবাচক দিক রয়েছে। সেটি হল এই যে, এই মুহূর্তে গৃহস্থ-ভোক্তা জগতে এক উল্লেখযোগ্য অবনমন দেখা দিয়েছে। এর পিছনে মুদ্রাস্ফীতির কারণে চাহিদা হ্রাসের বিষয়টি যতখানি কাজ করছে, তার চাইতে অনেক বেশি মাত্রায় কাজ করছে বহু মানুষের আকস্মিক জীবিকাচ্যুতি। সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিকে দেখা যাচ্ছে যে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মধ্যে ব্যক্তিগত স্তরের ভোক্তার অংশটি ক্রমশ কমছে। সুদের হারের ক্রমবৃদ্ধি আবার ঋণ-ভিত্তিক ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস ঘটাবে বলেও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে, সামান্য হলেও নতুন ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। অবশ্য সেই সব ক্ষেত্র, যা রফতানির বাজারে জোগান দেয় অথবা সেই সব ক্ষেত্র, যেখানে ব্যক্তিগত স্তরের চাহিদার অভাব পুষিয়ে দিতে সরকার টাকা ঢালছে, সেখানে তা সম্ভব নয়। কার্যত, এক দশক ধরে দেখা গিয়েছে যে বাণিজ্য সংস্থাগুলির নমুনা-ভিত্তিক তালিকায় খুব কম ক্ষেত্রেই বিক্রয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। যেখান থেকে বার্ষিক অন্তত ৭ শতাংশ বৃদ্ধির ছবিটি স্পষ্ট হবে। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আপস করে প্রকৃত বৃদ্ধির হার কিন্তু বেশ সীমিতই বলা যায়। সামনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, চাহিদার এক স্বল্পকালীন পুনরুজ্জীবনকে কিন্তু ততখানি বর্ণোজ্জ্বল বলে প্রতিভাত হবে না। কারণ, মুদ্রাস্ফীতি বহমান রয়েছে এবং আগামী মাসগুলিতে এমন অবস্থাই বহাল থাকবে। জ্বালানি তেল সংক্রান্ত এক বৃহৎ সঙ্কটের সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে, যা দেশজ অর্থনীতির বিবিধ পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে পারে। এবং এরই সঙ্গে বিদেশে কোথাও কোথাও অর্থনীতির স্থবিরতা ও মুদ্রাস্ফীতির যৌথ সম্ভাবনা রফতানি বাণিজ্যকে আঘাত করতে পারে বলেও মনে হচ্ছে। এই সব কারণেই বেসরকারি বিনিয়োগের বিষয়টি হয়তো আপাতত দৃশ্যমান নয়। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে এবং বিনিয়োগ বাড়লে অর্থনীতির উজ্জীবন হয়তো পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের আশায় মানুষ বেশ কিছুটা সময় ইতিমধ্যেই কাটিয়ে ফেলেছেন।
এই সমস্যাকে সাম্প্রতিক সময়ে আয়-সমতার বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করে দেখার বিষয়টি খুব অলীক হবে না। চাকরির বাজার থেকে হাজার হাজার মানুষ বহিষ্কৃত এবং ক্রমবর্ধমান অথচ অস্থির অর্থনীতিতে কর্মনিযুক্তির ৯০ শতাংশের মধ্যেই কিন্তু স্থায়িত্বের কোনও সম্ভাবনাই নেই। মার্ক্সীয় অভিধায় যে সমস্যাকে ‘আন্ডার-কনজাম্পশন’ বা ‘উপভোক্তার অভাব’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়, তার একটি হেনরি ফোর্ড-সুলভ সমাধান রয়েছে। সেটি হল এই যে, জনগণের বেতন বৃদ্ধি করলে তারা বেশি মাত্রায় পণ্য ক্রয় করবে। এই সময়ে অগণিত মানুষ এতখানি কম আয় করেন যে, অর্থনীতি যে পরিমাণ ভোক্তা-বিবর্ধনকে দাবি করে, তা পূরণ করতে পারে না। এর উল্টো অথচ অনিবার্য দিকটি হল এই যে, বাণিজ্য সংস্থাগুলি এমন পরিস্থিতিতে যতখানি সম্ভব লাভের অঙ্ক পকেটস্থ করে চলেছে!
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy