অলিম্পিক্সে সোনা জিতে ইমেন খেলিফ বললেন, “যে কোনও নারীর মতোই আমিও এক জন নারী। আমি জন্মেছি নারী হয়েই। বেঁচেওছি নারী হয়ে।”
আলজিরিয়ার বক্সার, ২৫ বছরের তরুণী ইমেনকে নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে এমন প্রকাশ্য শংসাপত্র দিতে হল, কারণ তিনি ব্যতিক্রমী। নারী বললে যে গড়পড়তা ধারণা তৈরি হয়, যেমন ছবি চোখে ভাসে, তেমন দেখতে নন ইমেন। তাঁর শরীরও তেমন নয়। ইমেনের সেই বাহ্যিক অবয়বের সঙ্গে পরিচিত হয়েই নিমেষে তাঁর স্বঘোষিত, স্বযাপিত লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল জনতা। সেই প্রশ্নের জবাব ইমেন দিলেন ফাইনালে উঠে সোনা জিতে। বললেন, “ওই সব প্রশ্ন, ওই আক্রমণের জন্যই এই সাফল্যের স্বাদ আরও বেশি ভাল লাগছে।”
বিতর্কের সূত্রপাত অবশ্য ইমেনের ফাইনালে ওঠার অনেক আগেই। ইটালির এঞ্জেলা কারিনি ইমেনের আঘাত সহ্য করতে না পেরে ৪৬ সেকেন্ডের মাথাতেই জানিয়ে দেন তিনি আর লড়তে চান না। তাই অনায়াসেই পরের রাউন্ডে চলে যান ইমেন। আর তার পরেই নেট দুনিয়ায় বিশ্ব জুড়ে ইমেনকে আক্রমণ শুরু হয়। আক্রমণের বয়ান হল, ইমেনের শক্তি দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি নারী নন। তিনি লিঙ্গ পরিচয় ভাঁড়িয়ে নারীদের বিভাগে নেমেছেন সহজে জিততে।
তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের বক্সিং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আন্তর্জাতিক বক্সিং সংস্থার লিঙ্গ পরীক্ষায় উতরোতে পারেননি ইমেন। কিন্তু আক্রমণকারীরা এটা ভুলে যান যে, ওই সংস্থা কোন কোন মাপকাঠিতে এই পরীক্ষা করে তার স্বচ্ছতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ভুলে যান, অলিম্পিক্সে সমস্ত নিয়ম মেনেই প্রতিযোগিতার সুযোগ পেয়েছেন ইমেন।
যে-হেতু ইমেনের শারীরিক গড়ন নারী শরীরের সম্পর্কে সংখ্যাগুরুর যে ধারণা, তার সঙ্গে মানানসই নয়, সে কারণেই মূলত তাঁর লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু হয়। তবে এই সংস্কৃতি যে নতুন নয় তা দ্য মডার্ন আমেরিকান জার্নালের একটি প্রবন্ধে এক দশকেরও বেশি আগে দেখিয়েছেন এরিন বুজ়ুভিস। ২০০৯-এর অগস্টে বার্লিনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৮০০ মিটার দৌড়ে জয়ী হন দক্ষিণ আফ্রিকার কাস্টার সেমেন্যা। তাঁর গতি, গড়ন, গলার স্বর থেকেই প্রশ্ন তোলা হয় তাঁর লিঙ্গ পরিচিতি নিয়ে। তাঁকে লিঙ্গ পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।
দু’মাস পরে স্বর্ণপদক ও আর্থিক পুরস্কার ফিরে পান সেমেন্যা। কিন্তু তার আগে তাঁকে নিয়ে যে পরিমাণ চর্চা চলে তাতে তাঁর মানসিক অবস্থার উপর প্রচণ্ড প্রভাব পড়ে। বুজ়ুভিস তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ২০০৬ সালে এশিয়ান গেমসে দৌড়ে রুপো জিতলেও লিঙ্গ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় তা ফেরত দিতে হয়েছিল এক ভারতীয় মহিলা খেলোয়াড়কে। শোনা যায়, ওই ঘটনা তাঁর জীবনে এতটাই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল যে তিনি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন।
লিঙ্গপরিচয় নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হল, তার ভিত্তিটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে দু’টি প্রধান ভুল ধারণার উপরে। প্রথমত, লিঙ্গকে পুরুষ ও নারী— এই দু’টি স্থূল বিভাগের বাইরে ভাবাই হচ্ছে না। ক্রোমোজ়োমের গঠন, হরমোন ইত্যাদি নানা কারণে যে লিঙ্গ পরিচয়কে এত সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে বাঁধাই যায় না, সেই যুক্তিকেই অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, লিঙ্গ অনুসারে বিভাজন নিখুঁত হলেই যে সমস্ত প্রতিযোগী ‘সমান’ হয়ে প্রতিযোগিতায় নামবেন তা একেবারেই নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, নানা কারণে খেলার দুনিয়ায় বহু প্রতিযোগী অন্যদের থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন। তাই লিঙ্গপরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক।
সব প্রতিযোগী সমান সুবিধা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করুক— এই লক্ষ্য নিয়েই বিতর্ক হচ্ছে বলে মনে হতে পারে। তবে বাস্তবে তা নয়। বাস্তব হল, সংখ্যাগুরুর ধারণা, সংখ্যাগুরুর ছাঁচে মিল না হলেই তাকে আক্রমণ করা। এ হল সমাজমাধ্যমের চেনা বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশেই মাস দুয়েক আগে আমরা তা দেখেছি উত্তরপ্রদেশের কিশোরী প্রাচী নিগমের ক্ষেত্রে। দশম শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী প্রাচীর মুখে লোম তার বয়সি গড়পড়তা মেয়েদের চেয়ে বেশি। প্রাচীর সাফল্যের পর তাঁর ছবি প্রকাশিত হতেই দলবেঁধে এ নিয়ে হাসাহাসি শুরু হয় সমাজমাধ্যমে। প্রাচীও অবশ্য ইমেনের ঢঙে ওই আক্রমণকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমি কত নম্বর পেয়েছি সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মুখমণ্ডলে বেশি চুল আছে কি না তা নয়।”
সমাজমাধ্যমে গণ-মনের আচরণ মিলে যাচ্ছে ইমেন ও প্রাচী দু’জনের প্রতি ব্যবহার থেকেই। তা হল ব্যতিক্রমকে স্বীকার না করা। সংখ্যাগুরুর যে ধারণা, তার সঙ্গে খাপ না খেলেই চলে তাকে নিয়ে কাটাছেঁড়া। আলজিরিয়ার ইমেন খেলিফের সঙ্গে আমাদের দেশে উত্তরপ্রদেশের প্রাচী নিগমও বাঁধা পড়ে গেলেন এই সুতোয়। নারী বলতেই যেমন অবয়ব মনে পড়ে, এই দু’জন তার থেকে আলাদা। সে কারণেই তাঁদের দু’জনকেই ট্রোলিংয়ের মুখে পড়তে হয়।
তখন সমাজমাধ্যমের দাপাদাপি ছিল না। ‘ট্রোলিং’ শব্দটিরও ব্যবহার শুরু হয়নি। এই বাংলার খেলোয়াড় পিঙ্কি প্রামাণিকের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছিল এমনই। সুমনের গানে ছিল তার ইঙ্গিত, “ছবিটা কাগজে ছাপা, সবার সামনে পুলিশের হাতে তোমার শরীর মাপা...” এক দশক আগে ওই ঘটনার পরেও যে সমাজ বদলায়নি, ইমেন ও প্রাচীর ঘটনা সেটাই প্রমাণ করল। প্রাচী নিগম রাজ্য স্তরের পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান অর্জন করেছেন। ইমেন খেলিফ অলিম্পিক্সে সোনা জিতেছেন। তাও তাঁদের কাজ নিয়ে বা কৃতিত্বের নেপথ্য কারণ নিয়ে নয়, চর্চা হচ্ছে তাঁদের শরীর নিয়ে, যা আসলে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদকেই প্রতিষ্ঠা করছে। এই আধিপত্যবাদ মুছে দিতে চায় সব ব্যতিক্রম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy