Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
নেতামন্ত্রীরা নির্বিকার, 'শিক্ষিত' উচ্চবর্গও তথৈবচ
Education

‘আমি পড়তে চাই’

সুনীতার ওই কথাটা কিন্তু ভারতের সমস্ত শিক্ষিত সমাজকে চপেটাঘাত। সুনীতার বয়স ঊনত্রিশ। ওই পরিবারে কাজ করেছেন দশ বছর, আগে হয়তো আর কোথাও।

সুনীতার কাছ থেকে অনেক শেখার আছে।

সুনীতার কাছ থেকে অনেক শেখার আছে।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৪৪
Share: Save:

সুনীতা কুমারীর নামটা শুনতে না শুনতেই হারিয়ে গেল। দু’দিন যে শোনা গেল, শোরগোল হল, সেটাই অমন মানুষের পক্ষে ঢের। সুনীতা রাঁচীর আদিবাসী গৃহসেবিকা, প্রায় এক দশক অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে এখন বিধ্বস্ত অবস্থায় হাসপাতালে। তাঁর নিয়োগকর্ত্রী বিজেপির রাজ্যস্তরের নেত্রী (এখন বরখাস্ত), ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ কার্যক্রমের পরিচালক; গৃহকর্তা অবসরপ্রাপ্ত আইএএস আধিকারিক।

টিভিতে সুনীতার ক’টা টুকরো কথা শুনলাম। প্রশ্নকারী সাংবাদিক অত্যন্ত সংবেদনশীল। সুনীতা বললেন তাঁর দীর্ঘ নরকবাসের কথা। ব্যাকুল প্রশ্ন করলেন, তিনি ভাল হয়ে উঠবেন তো? আর কী নাছোড় তাড়না, অস্ফুট গলায় একটাই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন: সেরে উঠে তিনি লেখাপড়া শিখতে চান।

আবদার শুনে চড় কষাতে ইচ্ছে করে না? সুনীতার ওই কথাটা কিন্তু ভারতের সমস্ত শিক্ষিত সমাজকে চপেটাঘাত। সুনীতার বয়স ঊনত্রিশ। ওই পরিবারে কাজ করেছেন দশ বছর, আগে হয়তো আর কোথাও। হয়তো স্কুলে এক-আধটু গিয়েছেন, হয়তো যাননি। উপযুক্ত লেখাপড়ার সুযোগ পেলে অবশ্যই এই কাজে আসতেন না, এলেও এত দিন অত্যাচার সহ্য করতেন না।

আমরা যারা সুযোগটা পেয়েছি, আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ধন-মান-মোক্ষলাভের চাবিকাঠি ওই শিক্ষার পুঁজিটুকু কুক্ষিগত করে রাখতে। যে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের আমরা নিন্দামন্দ করি, তাদের চেয়ে আমাদের গৃধ্নুতা কিছু কম নয়। ওদের টাকা, আমাদের শিক্ষা— যার যাতে অধিকার। টাকার একটা ভগ্নাংশ যেমন চুইয়ে বাকিদের ভোগে আসে, আমরাও বাকি সমাজকে শিক্ষার ভাগ দিয়েছি সেই ‘ট্রিকল-ডাউন’ ভিত্তিতে।

শিক্ষাজগতের প্রতারক আর কালোবাজারিদের পুঞ্জিত টাকা-গয়নার ছবি দেখে রোমাঞ্চিত ছিছিক্কারের সঙ্গে এ কথাটাও তাই ভাবা দরকার: শিক্ষাকে সাধারণ অধিকার হিসাবে আমরা প্রতিষ্ঠিত হতে দিইনি বলেই এই অপরাধীরা তার জোগান কব্জা করে লুটেপুটে নিয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে নয়ছয় করেছে, কারণ গোটা সমাজের নীরব স্বীকৃতি যে সেই শিক্ষকরা সাধারণ ঘরের যে সন্তানদের পড়াবেন, তাদের লেখাপড়া নেহাত ফালতু পড়ে-পাওয়া ব্যাপার— হলে হল, যেটুকু হল। পাঁচটা ক্লাস পড়াতে নাহয় দু’জনের জায়গায় এক জন শিক্ষক রইলেন। স্কুলবাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ল, বাড়িটাই ভাঙনে ধূলিসাৎ হল— এমন কী ব্যাপার? লাইব্রেরির বই, বিজ্ঞানের সরঞ্জাম না-ই থাকল; ওদের ঠাকুর্দার আমলে ছিল?

ভারতের টাটকা নতুন শিক্ষানীতি এই মনোভাবকে মান্যতা দিচ্ছে। ‘আর্থ-সামাজিক ভাবে বঞ্চিত গোষ্ঠীদের’ বিশেষ স্বার্থে তাই বিধান, তাদের সন্তানেরা পুরোদস্তুর স্কুলে কেন, সশরীরে কোনও স্কুলেই ঢুকবে না। শিশুশ্রমিক আর স্কুলছুটদের জন্য যে মুক্ত বিদ্যালয়ের নিদান আছে, সভ্য শিক্ষাব্যবস্থায় যার অবলুপ্তি ঘটা উচিত, সেটাকে বাড়িয়ে পোক্ত করা হবে এই ছেলেমেয়েদের জন্য। আদৌ যদি স্কুল থাকে, নিয়মকানুন শিথিল করে সেই দুয়োরানি বিদ্যাকেন্দ্রের জন্য কম টাকা কম রসদ বরাদ্দ হবে। অকপটে বলা হচ্ছে, এতে দাতব্য সংস্থাগুলির মায় সরকারের কাজ সহজ হবে। শিক্ষানীতির ৩.৫ আর ৩.৬ ধারা দ্রষ্টব্য।

তাও এই নীতির মুসাবিদা হয়েছিল অতিমারির আগে, ফলে অনলাইন শিক্ষার কথা এখানে বড় নেই। আজ শিক্ষাকর্তারা হাতে মোবাইল তো নয়, চাঁদ পেয়েছেন। স্থির মেনেছেন, ল্যাপটপ নয়, ট্যাবলেট নয়, একটা মুঠোফোনই লেখাপড়ার জন্য যথেষ্ট, পরিবারে চারটি বাচ্চা থাকলেও। সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট বলছে, দেশের ৭৭% ছাত্রের ওই সঙ্গতিটুকুও নেই। তাতে কী, ওরা এমনিতেই হিসাবের বাইরে।

ঠিক বাইরেও নয়, জ়িরো-ব্যালান্স জনধন অ্যাকাউন্টের মতো তারাও গুনতিতে ধরা। অধিকাংশের স্কুলের খাতায় নাম আছে বা অতিমারির আগে ছিল, প্রাথমিক স্তরে প্রায় ১০০ শতাংশ। স্কুলবাড়ি আছে, কখনও পোড়ো কখনও চলনসই। আছেন কিছু শিক্ষক— দরকার আট জনের, পদ হয়তো পাঁচটা, বহাল তিন জন। (উল্টোটাও হয়।) আর কী আশ্চর্য, কিছু শিক্ষক যেমন অলস অদৃশ্য, অনেকে মাটি কামড়ে দেখভাল করছেন শুধু ছাত্রদের নয়, তাদের পরিবার তথা গোটা পল্লির।

যে ব্যবস্থা ধসে পড়লে নেতামন্ত্রীরা নির্বিকার থাকবেন, শিক্ষাভিমানী উচ্চবর্গ টেরই পাবে না, সেই ব্যবস্থা তাই খাড়া থাকে, নড়বড়িয়ে এগোয়, কোটি-কোটি শিশুকিশোর কমবেশি লেখাপড়া শেখে। অনেকের পক্ষে ঘরের মলিন পরিসরের বাইরে স্কুলই হল কয়েক ঘণ্টার জন্য আর এক জগতের আস্বাদবহ আশ্রয়। আশ্বাস না হলেও এই বিশ্বাসটুকু তারা ধরে রাখতে চায়, আস্বাদটা হয়তো বা স্থায়ী হতে পারে, জীবনের মতো একটা অবলম্বন জুটতে পারে।

এই বিশ্বাস আঁকড়েই ভারত জুড়ে সুনীতার মতো কোটি-কোটি ছেলেমেয়ে বলে চলেছে, “আমরা লেখাপড়া শিখতে চাই।” বাবা-মায়েরাও চান, যে জীবন তাঁরা নিজেরা পাননি, সন্তানরা যেন লেখাপড়া শিখে পায়। উচ্চবর্গের শ্রেণিদুষ্ট ধারণা, হীনদীন মানুষ শিক্ষার কদর বোঝে না। বাস্তব বলে, আশাভঙ্গের চরম কারণ না ঘটলে (প্রায়ই ঘটে) সন্তানের শিক্ষার জন্য গরিব লোকে উদ্‌গ্রীব, সে জন্য খরচ করে আয়ের অনুপাতে বিত্তবানদের চেয়ে বেশি। তারা নির্বোধ নয়, লেখাপড়া শিখলেই গাড়িঘোড়া চড়বে এমন খোয়াব দেখে না; কিন্তু সেটা গাড়িঘোড়া চড়ার প্রাথমিক অবশ্যশর্ত তা বোঝে।

শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে এ সব নিয়ে ভাবতে হয় না। পড়তেই হবে, পাশ করতেই হবে— নিষ্কৃতি নেই। এত সহজে সিলমোহর মেলে বলে তাতে আস্থাও হারায় অবলীলায়। বঞ্চিত শ্রেণির মধ্যে হতাশ দিকভ্রান্ত ছেলেমেয়ের সংখ্যা আরও প্রচুর, তবে কারণগুলো ভিন্ন। শিক্ষিতের সন্তানদের শিক্ষায় অরুচি ধরে। শিক্ষাবঞ্চিত ঘরের ছেলেমেয়েরা অনেকে দন্তস্ফুট করতে পারে না, স্রেফ ‘ধুত্তোর’ বলে লেখাপড়ায় ক্ষান্ত দেয়। এটা সচরাচর হয় মেধার অভাবে নয়, আর্থিক বা সামাজিক প্রতিবন্ধকতায়; আর অবশ্যই স্কুলের দৈন্যদশার জন্য, দক্ষ শিক্ষক আর পরিকাঠামোর অভাবে। এই স্কুলছুটরা অন্য পথ দেখে, পায়ও হয়তো— প্রায়ই কোনও স্থানীয় নেতার ছত্রছায়ায়।

পাশাপাশি কিন্তু আর এক দল মাটি কামড়ে লেখাপড়া চালিয়ে যায়, সফলও হয় বহু ক্ষেত্রে। এই সাফল্যের সংজ্ঞা বিশাল ধন বা খ্যাতিলাভ নয়, অল্প আয়ের হলেও একটা নিশ্চিত জীবিকা আর এক-আধটু আত্মসম্ভ্রম। কেউ-কেউ কয়েক ধাপ এগিয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অফিসার কি নিদেনপক্ষে শিক্ষক হয়। কখনও বা দু’-এক জনের সাফল্য রীতিমতো নজর কাড়ে, স্থানীয় কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। তা থেকে পরবর্তীরা— ‘অনুপ্রেরণা’র মতো গালভরা শব্দ থাক, স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায়।

বঞ্চিত সমাজের অগণিত মানুষের চোখে লেখাপড়াই একমাত্র উপায় যাতে দরজা না হোক, জীবনে অন্তত একটা জানলা খুলে যাবে, বাইরের হাওয়া ঢুকবে, বাইরের জগৎটা দেখা যাবে। আর সত্যিই বেরোতে পারলে কোনও একটা রাস্তার সন্ধান মিলতে পারে— হয়তো উঁচুনিচু ভাঙাচোরা, তবু উত্তরণের পথ।

এই উত্তরণে বাধা সৃষ্টি করা আমাদের সন্তানদের বিরুদ্ধে পাপ। সেই পাপ শুধু নাটকীয় খবরে-ওঠা পর্যায়ে নয়— মারধর নির্যাতন করে, অর্থলোভে শিক্ষা বেচে, বা আরও কুটিল ফন্দিতে শিক্ষার বঞ্চনাকে রাষ্ট্রনীতির মর্যাদা দিয়ে। চোরাপথে সেই পাপ ঢুকে পড়ে আমাদের নিটোল সংসারে, যেখানে আদরের সোনামণিদের ভবিষ্যতের জন্য আমরা প্রাণপাত করছি, ফলে তাদের অত্যাচারও করছি কম নয়। আমাদের ইটের দেওয়ালের বাইরে শিক্ষার মস্ত বটগাছ আছে, আধ হাত মাটি খুঁড়লে দেখব তার শিকড় আমাদের বাড়ির ভিতে পৌঁছেছে— সেটা খেয়াল করার না আছে ফুরসত, না আছে তাগিদ। সজ্ঞানে অন্যায় অবিচার করলে শোধরানো যায়; যদি বুঝতেই না পারি, অনিষ্টটা অগোচরে বেড়েই চলে।

এই ঔদাসীন্য কিন্তু সহজাত মনুষ্যত্বের লক্ষণ নয়। ভেবে দেখুন সুনীতার কথা। এই মুহূর্তে তিনি আহত অক্ষম। তবু সেরে ওঠার আশা জাগতেই ভাবছেন, তার পর কী করবেন। নিঃশ্বাসের মতো সহজ তাঁর অকল্পনীয় উত্তর: কেন, লেখাপড়া। অনেক বিকল্পের একটা নয়, একমাত্র, ন্যায্য, স্বাভাবিক। শিক্ষা তো সকলের প্রাপ্য, এ বার নাহয় সুনীতাও পাবেন। বন্দি মানুষের আলো-হাওয়া জোটে না; তা বলে কি ছাড়া পেলেও আমরা অন্ধকারে থাকব?

সত্যি তাই আছি। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও আমরা ভাবতে পারি না শিক্ষা একটা খোলামেলা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, সকলকে সকলের উপহার। সুনীতার কাছ থেকে অনেক শেখার আছে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Education school
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy