Advertisement
০৫ অক্টোবর ২০২৪
নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার
police

সাধারণ নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কি প্রশাসনের কর্তব্য নয়

আমজনতা পুলিশের কাজের সমালোচনা বা অসন্তোষ প্রকাশ করলে তাঁদের রাষ্ট্রবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে কেন?

আনন্দ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩৭
Share: Save:

সংবিধান মোতাবেক ভারতের প্রতিটি নাগরিকই সমান অধিকার ও সুযোগ ভোগ করার অধিকারী। যদিও রাজনৈতিক নেতৃবর্গ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট শিল্পপতি, অভিনেতা, বিচারপতি, আমলা এমনকি নামজাদা ধর্মগুরুও বিভিন্ন সময় ভিআইপি বা ভিভিআইপি সুরক্ষাব্যবস্থা-সহ নানা ধরনের বিশেষ সরকারি সুযোগসুবিধা ভোগ করে থাকেন জনগণের প্রদেয় করের অর্থে। এক দিকে যখন এই ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিদের জীবনের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্যাটেগরির সুরক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে, তখন অপর দিকে প্রাণহানির আশঙ্কা করে পুলিশি হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করলেও আমজনতার ভাগ্যে প্রত্যাখ্যান ও সরকারি অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই জোটে না।

এই রাজ্যের প্রেক্ষাপটে তরুণ ছাত্রনেতা আনিস খানের কথাই ধরা যাক। নিজের জীবনহানির আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হলেও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর নিরাপত্তার জন্য কোনও পদক্ষেপই করা হয়নি। উল্টে, তাঁর অপমৃত্যুর পিছনে পুলিশেরই প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে, মৃতের পরিবারের পক্ষ থেকে এমনই মারাত্মক দাবি করা হয়েছে। অপর দিকে, গত বছর হওয়া রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পর পরই রাজ্য জুড়ে চলা রাজনৈতিক হিংসার কারণে বিজেপির সাতাত্তর জন বিধায়ককে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক উত্তরপ্রদেশ ও পঞ্জাবের নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত পঁচিশ জন বিজেপি ও কংগ্রেসি বিধায়ককে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। যদিও পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভগবন্ত মান সেই রাজ্যের একশো বাইশ জন প্রাক্তন মন্ত্রী, বিধায়কের ভিআইপি সুরক্ষা কবচ কেড়ে নিয়েছেন বলে সংবাদে প্রকাশ।

এখন নাগরিকদের মনে যে প্রশ্নটির উদয় হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক, তা হল— এই সব বিশিষ্টজনকে কেন্দ্র বা রাজ্যস্তরীয় সুরক্ষা কবচ প্রদান করার মাপকাঠি কী? সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেনই বা বিশেষ সুরক্ষা কবচ বহু ক্ষেত্রে তুলে নেওয়া হয়? আবার, ২০১৩ সালে ধনেখালি থানায় অতি তুচ্ছ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া কাজি নাসিরুদ্দিন যখন পুলিশি বর্বরতার শিকার হয়ে লক-আপেই প্রাণত্যাগ করেন, তখন অন্য দিকে দুই মহিলাকে ধর্ষণের ঘটনায় কুড়ি বছর সাজাপ্রাপ্ত হেভিওয়েট আসামি ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিমকে পঞ্জাব ভোটের মুখে জ়েড-প্লাস সুরক্ষা প্রদান করে একুশ দিনের দীর্ঘ ছুটিতে মুক্ত করার নজিরও ভারতবর্ষের সমাজজীবনে চোখে পড়ে। তবে কি শুধুমাত্র ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ করলেই কোনও অপরাধীও প্রশাসনিক নিরাপত্তা পাওয়ার হকদার হয়ে ওঠেন?

আমাদের দেশে কোনও বন্দি বা সাজাপ্রাপ্তের জীবনহানির আশঙ্কা থাকলে তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাও সরকারের অবশ্যকর্তব্য। সে ক্ষেত্রে ধর্মগুরু রাম রহিমের প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকায় হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বিশেষ নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেছেন। এ দিক থেকে বিচার করলে থানার মধ্যে কোনও বন্দির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা নিঃসন্দেহে ক্ষমতাসীন সরকারের নৈতিক এবং আইনি স্খলন। কারণ, অভিযুক্তের জীবন ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার, আইন কখনওই পুলিশের হাতে তুলে দেয়নি। মোদ্দা কথা, অপরাধীর জীবনের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতেও রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ।

বস্তুত, কোনও ব্যক্তির ভিআইপি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের বিশেষ ভূমিকা থাকে। সে ক্ষেত্রে আইবি, র-এর মতো গোয়েন্দা সংস্থা বা রাজ্যের গুপ্তচর বিভাগের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই তাবড় রাজনীতিক বা সুশীল সমাজের বিশিষ্টজনদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করে সরকার। কিন্তু এই ধরনের তথ্য গোপনীয় হওয়ায় যে হেতু দেশবাসীর কাছে সহজলভ্য নয়, সে কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিআইপিদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়টি সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তাই বোধ হয়, এ রাজ্যে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই দলবদলু নেতাদের বিশেষ কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বেষ্টনী তুলে নেওয়া হল। আবার অন্য দিকে, নবাগত নেতাদের রাজ্যস্তরীয় নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করতে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারও কালবিলম্ব করল না। পাশাপাশি, শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউতের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় এক দিকে যখন অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াই প্লাস স্তরীয় সিআরপিএফ নিরাপত্তা প্রদান করেছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, তখন অন্য দিকে, দিল্লির জেএনইউ-এর ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর ফলে একাধিক হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও দীপিকা পাড়ুকোনের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে উদ্যোগী হল না কেন্দ্র। সুতরাং সরকারপন্থী ‘বিশিষ্টজন’রাই নিখরচায় রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কবচ পাওয়ার দৌড়ে যে অনেকখানি এগিয়ে থাকেন, তা বলা বাহুল্য।

গান্ধী-পরবর্তী যুগে জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া-সহ হাতেগোনা রাজনীতিবিদ সরকারি সুযোগসুবিধা ও ভিআইপি ক্যাটেগরি নিরাপত্তাব্যবস্থার সুযোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে সততা দেখিয়েছিলেন। এই ধরনের কতিপয় রাজনৈতিক সন্ন্যাসীর আদর্শ বাদ দিলে ভিআইপি নিরাপত্তা আজ অধিকাংশ নেতাদের কাছেই ‘স্টেটাস সিম্বল’। নিজেদের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও প্রভাব জনগণের সামনে তুলে ধরতেই তাঁরা ভিআইপি নিরাপত্তার জন্য আবেদন করে থাকেন। এক্স, ওয়াই, ওয়াই প্লাস, জ়েড, জ়েড প্লাস ও এসপিজি ক্যাটেগরির যে সরকারি সুরক্ষাব্যবস্থা দেশে চালু আছে, তার মধ্যে পদমর্যাদা বলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবার এসপিজির (স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ) আওতাধীন। অন্যান্য ভিআইপির ক্ষেত্রে আক্রমণ বা বিপদের আশঙ্কা ও সম্ভাব্য তীব্রতার উপর ভিত্তি করে তাঁদের বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে থাকে কেন্দ্র বা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকার। জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী, সিআইএসএফ, সিআরপিএফ-এর জওয়ানদের এই দায়িত্বে মোতায়েন করা হয়। ২০১৩ সালে গুপ্তচর বিভাগের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা করে সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পপতি মুকেশ অম্বানীকে জ়েড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছিল। যদিও সে ক্ষেত্রে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সিআরপিএফ-কে প্রতি মাসে পনেরো লক্ষ টাকা করে অম্বানীকে প্রদান করতে হয়েছে। ২০১৮ সালে মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশ জুড়ে প্রায় তিনশোর মতো ব্যক্তি কেন্দ্রীয় স্তরের ভিআইপি সুরক্ষাব্যবস্থার আওতাধীন রয়েছেন।

প্রশ্ন জাগে, যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আমজনতার সঙ্গে সরকারি ট্রেনে, বাসে যাতায়াত ও ন্যূনতম রক্ষী দ্বারা পরিবৃত থাকেন, সেখানে ভারতের মতো গরিব দেশে রাষ্ট্রনেতা ও হাতেগোনা বিশিষ্টজনকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেই যদি সরকারের বিপুল অর্থ ও সুরক্ষাবাহিনীর বড় অংশ নিযুক্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক উন্নয়ন, সীমান্তের নিরাপত্তা অথবা সন্ত্রাসবাদ দমনের বিষয়গুলিই অবহেলিত থেকে যায় না? এমনিতেই দীর্ঘ দিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকার ‘বিশিষ্টজন’দের নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে জাতীয় সুরক্ষা বাহিনী (এনএসজি)-কে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে, যারা মূলত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্যই নিয়োজিত হয়ে থাকে। অন্য দিকে, সরকারি সুরক্ষার আওতায় আসার ফলে রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ বিরাট ক্ষমতাশালী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং বহু ক্ষেত্রেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থাকেন। সে কারণে, আমজনতার ‘সেবা’ করতে উদ্যত ব্যক্তিদের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োজন হবে কেন, সে প্রশ্নটি তোলা আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি, ‘সাধারণ পুলিশবাহিনী’র কর্মদক্ষতা ও নিরপেক্ষতার উপর যদি আমাদের রাষ্ট্রনেতাদেরই ভরসা ও বিশ্বাস না থাকে, সে ক্ষেত্রে আমজনতা পুলিশের কাজের সমালোচনা বা অসন্তোষ প্রকাশ করলে তাঁদের রাষ্ট্রবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE