Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
শুধু শাহকে ‘আক্রমণ’-এর লক্ষ্য করে তোলার রণকৌশল
Abhisek Banerjee

অভিষেকের তিনটি বোমা

পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা অনুব্রত মণ্ডলেরা যে ভাবে বার বার হাজিরা এড়িয়েছেন, অভিষেকের তা ‘পছন্দ’ নয়। সে কথা তিনি ইতিমধ্যেবুঝিয়েছেন নানা ভাবে।

মুখোমুখি: ইডি-র দফতর থেকে বেরিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। পিটিআই

মুখোমুখি: ইডি-র দফতর থেকে বেরিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। পিটিআই

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২০
Share: Save:

সে দিন ইডি-র দফতরে হাজিরার পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তিনটি ‘বোমা’ ফাটিয়েছেন। এক, অমিত শাহ; দুই, শুভেন্দু অধিকারী; এবং তিন, নতুন তৃণমূল। তৃণমূলে পদাধিকারবলে অভিষেকের ‘রাজনৈতিক ওজন’ এখন বেড়েছে। তাই তাঁর কথা উড়িয়ে দেওয়ার নয়!

অভিষেক ও তাঁর স্ত্রী-সহ কয়েক জন আত্মীয় বেশ কিছু দিন ধরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের ডাক পাচ্ছেন। দিল্লি, কলকাতা মিলিয়ে বার তিনেক হাজিরাও হয়ে গিয়েছে তাঁর। এ বারেও ইডি-র দফতরে প্রায় আট ঘণ্টা কাটানোর পরে তিনি ঘোষণা করেছেন, ত্রিশ বার ডাকলেও তিনি সাড়া দেবেন। বস্তুত পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা অনুব্রত মণ্ডলেরা যে ভাবে বার বার হাজিরা এড়িয়েছেন, অভিষেকের তা ‘পছন্দ’ নয়। সে কথা তিনি ইতিমধ্যেবুঝিয়েছেন নানা ভাবে। ফলে ওই ঘোষণার মাধ্যমে নিজেকে নিরপরাধ বলে দাবি করার একটি চ্যালেঞ্জ যেমন তাঁর আছে, তেমনই রয়েছে দলের পুরনো নেতাদের থেকে নিজেকে ‘আলাদা’ প্রমাণের সচেতন প্রয়াস। যার সঙ্গে ‘নতুন’ তৃণমূল তৈরির বিষয়টিও জড়িত।

এক-এক করে বিষয়গুলি দেখা যাক। অভিষেক সে দিন যে ভাবে, যে ভাষায় সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম করে আর্থিক দুর্নীতির নির্দিষ্ট অভিযোগে তাঁকে বিদ্ধ করেছেন, তেমনটি বোধ হয় এর আগে হয়নি। সুদূর অতীতে এক বার এই রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গ্রেফতারের দাবি উঠেছিল— তবে সেটা ছিল একেবারেই রাজনীতি-কেন্দ্রিক, দুর্নীতি নয়। রাজ্যে তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। ওয়াই বি চবন ছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আইনশৃঙ্খলাজনিত কারণে কেন্দ্রীয় শাসন জারির ইঙ্গিত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন চবন। তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার পাল্টা অভিযোগ তুলেছিল সরকারের বড় শরিক সিপিএম। জ্যোতি বসু তখন পুলিশমন্ত্রী। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দমদমে নামলে পুলিশের উচিত তাঁকে গ্রেফতার করা।” তার জের বহু দূর গড়িয়েছিল। তবে সবটাই ছিল রাজনৈতিক লড়াই। চুরি-জোচ্চুরির চাপান-উতোর তাতে ছিল না।

এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন, কারণ নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তের ধাক্কায় রাজ্যের শাসককুল এখন জেরবার। এই অবস্থায় অভিষেক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কার্যত ‘চোর’ বললেন। ‘পাপ্পু’ বলে শ্লেষ করলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে শাহের বিরুদ্ধে তৃণমূল তেড়েফুঁড়ে নামল। রাতারাতি শাহের কার্টুন দিয়ে ‘বিগেস্ট পাপ্পু’ লেখা টি-শার্ট ছড়িয়ে পড়ল। সব মিলিয়ে এতে পরিকল্পনার একটি ছাপ চোখে পড়ে।

সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারের দায় বিএসএফ যে এড়াতে পারে না, তেমন কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে থাকেন। একই ভাবে কয়লা পাচারের দায়ে তাঁরা নিশানা করেন খনি এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিআইএসএফ-কে। ওই দুই বাহিনী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন বলে তির থাকে শাহের দিকেই। কিন্তু এ বার অনেকটা এগিয়ে এসে অভিষেক বলেছেন, শাহের কাছে ‘চুরির টাকা পৌঁছে যায়’। তাঁর এই বক্তব্যের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ধাক্কা অতি তীব্র। কেন্দ্রীয় তদন্ত-সংস্থাগুলি কেন শাহকে ডাকবে না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তৃণমূল নেতা। এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হল, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা খোদ প্রধানমন্ত্রীর অধীন। যদিও সে দিনের দীর্ঘ সাংবাদিক বৈঠকে এক বারের জন্যও প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারণ করেননি অভিষেক। যা বলেছেন, সবটাই অমিত শাহকে নিশানা করে।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, শুধুই শাহের বিরুদ্ধে এই ভাবে রাজনৈতিক আক্রমণ শাণিয়ে তোলার পিছনে কি কোনও গূঢ় তাৎপর্য আছে? ক্ষমতার অলিন্দে শাহকে ‘অধিক গুরুত্বপূর্ণ’ প্রতিপন্ন করার এটা কি কোনও সূক্ষ্ম চাল? বিজেপির শীর্ষতম স্তরে কোনও ভাবে ‘রেখা’ টেনে দেওয়ার কোনও কুশলী প্রয়াস? হয়তো পরে এক সময় এ-সব খোলসা হবে।

যদিও খোলা চোখে পরিষ্কার যে, কোনও মারপ্যাঁচের কাজ হলে সেটা শাহ-ই করে থাকেন। বিবিধ কৌশল তৈরি ও রূপায়ণে মুখ্য ভূমিকা থাকে তাঁরই— তা সে বাংলা-বিহার-মহারাষ্ট্র-ঝাড়খণ্ড-দিল্লি যেখানেই হোক। কোথাও তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়, কোথাও হয় না। কিন্তু কাজটি মূলত তাঁরই উপর ন্যস্ত। মোদী সেখানে আপাতনীরব ভূমিকায় থাকেন। সে দিক থেকে শাহকে প্রকাশ্যে নিশানা করার জন্য এই রকম যুক্তিও দেওয়া যেতে পারে।

তবে কয়লা-গরু পাচারের কোটি কোটি টাকার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে দেওয়াকে শাহ কী ভাবে নেবেন, সেটি এখনই বোঝা কঠিন। তাঁকে যাঁরা ‘চেনেন’, তাঁদেরও অনেকে এ নিয়ে কিছুটা সন্দিগ্ধ। তথাপি ‘বোমা’ ফেটেছে। দুম করে বিরাট আওয়াজও হয়েছে! এ বার পরবর্তী পরিস্থিতি দেখার পালা।

শুভেন্দু অধিকারী সম্পর্কে অভিষেক যা বলেছেন, তার মধ্যেও বিস্ফোরণের মশলা কম নেই। সবাই জানেন, একদা যুব তৃণমূলের পদাধিকারী এবং অভিষেকের ‘সকল কাজের কাজি’ বলে পরিচিত ছিলেন জনৈক বিনয় মিশ্র। তদন্ত এড়িয়ে ‘ফেরার’ বিনয় এখন একটি দ্বীপরাষ্ট্রে চলে গিয়েছেন বলে খবর। কয়লা, গরু ইত্যাদি পাচার-কাণ্ডের সঙ্গে তাঁর সংস্রব কত ‘নিবিড়’ ছিল, তা-ও আজ তর্কের ঊর্ধ্বে।

অভিষেকের দাবি, এ-হেন বিনয়ের সঙ্গে শুভেন্দুর আট মাস আগে ফোনে কথা হয়েছে, এবং বিনয়কে তিনি মামলার ব্যাপারে ‘আশ্বস্ত’ করেছেন। সেই ফোনালাপের অডিয়ো ক্লিপ আদালতে পেশ করার চ্যালেঞ্জও জানিয়েছেন অভিষেক। আর তা খণ্ডন করতে গিয়ে শুভেন্দুর বক্তব্য, নিজের ফোন থেকে তিনি কোনও ‘চোরের সঙ্গে’ কথা বলেননি।

পাচার মামলার শিকড় এবং ডালপালা যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে এটিও একটি ‘বোমা’! এর সত্যাসত্য অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষ। তবে যা-ই হোক, পরিণাম হবে সুদূরপ্রসারী। তাই প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে এমন একটি অভিযোগ করার জোর অভিষেক কী করে পেলেন, সেটা ভেবে দেখার। একই ভাবে, অভিষেকের সঙ্গে প্রতি সন্ধ্যায় বিনয়ের জেলবন্দি ভাইয়ের ফোনে কথা হয় বলে শুভেন্দুর করা পাল্টা অভিযোগও কম চাঞ্চল্যকর নয়। বস্তুত দুই অভিযোগের কোনও একটিও আইনত প্রতিষ্ঠা পেলে সমগ্র পাচার-তদন্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ দিকে মোড় নিতে পারে। অভিষেক এ ক্ষেত্রেও তাই আগাম ‘বোমা’ ফাটিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার চ্যালেঞ্জ নিলেন, বলা চলে। প্রসঙ্গত, শাহের সঙ্গে শুভেন্দুর সংযোগ রাজ্য-রাজনীতিতে সুবিদিত।

‘নতুন তৃণমূল’ সম্পর্কে অভিষেক সে দিন যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা-ও বেশ অর্থবহ। এক দিক থেকে সেটি অবশ্য হাঁড়ি ফাটানো বোমা! কারণ, সেটি তিনি মেরেছেন নিজের দলকেই নিশানা করে। পরিকল্পিত ‘নতুন তৃণমূল’ যে পুরনোদের একটি বড় অংশকে সরিয়ে রেখে এগোতে চায়, সাংগঠনিক রদবদলের মধ্য দিয়ে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে আগেই। তবে অভিষেক দ্ব্যর্থহীন ভাবে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁদের দলে এখন ‘নিঃস্বার্থ’ নেতা-কর্মীর অভাব। ‘নতুন’ তৃণমূলের চরিত্র ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, “যে তৃণমূল নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের সঙ্গে কাজ করবে।”

সন্দেহ নেই, ২০১১ সালে মমতার নেতৃত্বে যে তৃণমূল রাজ্যে পালাবদল ঘটিয়েছিল, তার শরীরের অনেকটা জুড়ে এখন ক্ষমতার মেদ এবং লোভ-লালসা-দুর্নীতির কাদা। কে এক শতাংশ অসৎ, আর কে নিরানব্বই শতাংশ, তার তুল্যমূল্য বিচার এখানে অর্থহীন। ‘নতুন’ তৃণমূল হলেই মুশকিল আসান হবে কি না, সেটাও সময় বলবে। অভিষেক আপাতত হাটে হাঁড়িটা ভেঙেছেন, এটুকুই।

অন্য বিষয়গুলি:

Abhisek Banerjee Amit Shah ED Suvendu Adhikari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy