সাহিত্যানুরাগী পাঠকের মনে থাকবে— প্রসন্ন গোয়ালিনির গরু চুরির মকদ্দমায় উকিল কমলাকান্তের পেশা ‘ভিক্ষা’ লেখার প্রস্তাব দেওয়ায় সে প্রতিবাদ করে সগর্বে বলেছিল, “লিখুন, পেশা ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমন্ত্রণ-গ্রহণ।” কর্মবিমুখ পরান্নজীবী ব্রাহ্মণসমাজের প্রতি এই তীব্র শ্লেষ নিক্ষেপকালে বঙ্কিমচন্দ্র হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি, দেড়শো বছরের মধ্যে একটা সমাজ অনুপার্জিত প্রাপ্তির জন্যে কত মরিয়া, অলজ্জ হয়ে উঠবে!
প্রাক্-স্বাধীনতা থেকে শুরু করে হাল আমল পর্যন্ত আমাদের দেশে, বিশেষত বাংলায়, ছাত্রআন্দোলনের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। কখনও তা সর্বসাধারণের কাছে নন্দিত হয়ে গণ আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছে, কখনও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত, পদ্ধতি ও আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষেত্রবিশেষে নিন্দিতও হয়েছে। তবে অতি সম্প্রতি যে দুটো বিষয়কে নিয়ে দিকে দিকে ছাত্রআন্দোলন হল, অতীতে তা কখনও ঘটেছে বলে মনে পড়ে না।
শুরু হয়েছিল স্নাতক স্তরে অনলাইন পরীক্ষার আবদার নিয়ে। পড়ুয়াদের বক্তব্য পরিষ্কার, কোভিডের কারণে দীর্ঘ দিন কলেজ বন্ধ থাকার পর অল্প দিন ক্লাস হওয়ায় সিলেবাসের বড় অংশের পাঠ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকার সময়ে যে হেতু অনলাইন ক্লাস হয়েছে, তাই পরীক্ষাও নিতে হবে অনলাইন। অর্থাৎ প্রকারান্তরে কোভিডকালে অনলাইন ক্লাস হয়েছে, এ কথা তাঁরা অস্বীকার করেননি। তবুও অনলাইন ও অফলাইন ক্লাস মিলিয়েও যদি সিলেবাস অসম্পূর্ণ থাকে, সে ক্ষেত্রে সিলেবাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি উঠলে হয়তো তা কিছুটা যুক্তিযুক্ত হত। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা সে পথে না গিয়ে অনলাইন পরীক্ষার পক্ষে নানা (কু)যুক্তি নিয়ে রাস্তায় নামলেন, তা ক্রমশ অসহিষ্ণুতার রূপ নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাঙচুর, শিক্ষকদের কটূক্তি, ঘেরাও, পথ অবরোধ, কিছুই বাদ গেল না। অনলাইন পরীক্ষা যে আসলে বই খুলে পরীক্ষা, চলতি কথায় ‘টোকা’, এ কথা মেনে নিয়েও লজ্জা পাওয়ার পরিবর্তে তাকে অধিকার হিসেবে জাহির করতে দ্বিধা করলেন না পড়ুয়াদের একাংশ।
দ্বিতীয় আন্দোলনটির দাবি, এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় যাঁরা ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছেন, তাঁদের পাশ করিয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও স্কুলের গেট থেকে শুরু করে শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে ধর্না, পথ অবরোধ, প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান হল, জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বহু অস্ত্রের ব্যবহার হল। ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের হয়ে সওয়াল করতে দেখা গেল তাঁদের অভিভাবকদেরও। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে পাশের দাবিতে আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের ইংরেজি জ্ঞানের ছবি উঠে এল, শিক্ষানুরাগী ও দায়িত্বশীল অভিভাবকদের তা হতাশ ও উদ্বিগ্ন করেছে।
অনেকে মনে করছেন, বিনা শ্রমে সব কিছু পাওয়ার এই যে নির্লজ্জ অধিকারবোধ, এটা আসলে একটা মনুষ্যসৃষ্ট সামাজিক ব্যাধি। দান বা অনুগ্রহ নেওয়ার অন্তর্নিহিত লজ্জা উপলব্ধির জন্য দরকার যে নৈতিকতা ও আত্মসম্মানবোধ, অযাচিত প্রাপ্তির জোয়ারে তা ধুয়ে মুছে গিয়েছে। এ সবের মূলে আছে রাষ্ট্রের তরফে জনকল্যাণের নামে খয়রাতির প্যাকেজ। দেশ তথা রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ভাবনা মুলতুবি রেখে সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে সরকার এমন সব জনমোহিনী সামাজিক প্রকল্প চালু করছে, যেগুলি থেকে চটজলদি লাভ মেলে। সকল প্রকল্পেরই লক্ষ্য, সমাজের এক বৃহদংশের মানুষকে বিনা শ্রমে কিছু পাইয়ে দেওয়া। উদাহরণ হিসেবে কৃষকদের স্বার্থবহ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি প্রকল্পগুলির কথা বলা যায়। ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান জনধন যোজনা’ই হোক বা ‘কৃষক বন্ধু’, কোনওটাই কৃষকের দুর্দশা ঘোচাতে পারেনি। আজও ফড়েদের কারসাজিতে শস্যের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হওয়া, সংরক্ষণ-পরিকাঠামোর অভাবে ফসল নষ্ট হওয়া বা জলের দরে বিক্রি হওয়া বন্ধ হয়নি। বন্ধ করা যায়নি দেনার দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা।
ছাত্রছাত্রীদের জন্যে চলা প্রকল্পগুলি নিঃসন্দেহে খুবই জনপ্রিয়। অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় তাদের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। তবে পারিবারিক আর্থিক সঙ্গতি বিচার না করে সকলের জন্যে স্কুলব্যাগ, জুতো, ইউনিফর্ম, বই-খাতা এবং সবুজ সাথী, কন্যাশ্রী-সহ নানা দানসত্র উন্মুক্ত না করে বরং সেই টাকা বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর উন্নতি এবং শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে ব্যয় করলে হয়তো ছাত্রছাত্রীদের যথার্থ কল্যাণ হত। কোভিডকালে অনলাইন পড়াশোনার সুবিধায় স্মার্টফোন বা ট্যাব কেনার জন্য রাজ্য সরকার দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি দশ হাজার করে টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা যে অনেকে সে কাজে খরচ করেননি, এমন সংশয় দেখা গিয়েছে খোদ শিক্ষা কমিশনের অন্দরে। স্কুলগুলিকে পড়ুয়াদের কাছ থেকে ফোন বা ট্যাব কেনার বিল আদায় করে পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, পড়ুয়ারা যদি সরকারের দেওয়া স্মার্টফোন বা ট্যাব সত্যিই পড়াশোনার কাজে ব্যবহার করতেন, তা হলে আজ হয়তো তাঁদের অনলাইন পরীক্ষা কিংবা ইংরেজিতে পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবিতে পথে নামতে হত না।
সরকারের এই দান-খয়রাতির ফলে এক শ্রেণির ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মানসিকতায় এমন পরিবর্তন এসেছে, এমন আশঙ্কা কি অমূলক? তাঁরা ‘ফাউ’ সংগ্রহের লজ্জা ভুলে এটাকে সরকারের দায় এবং নিজেদের অধিকার ভাবতে শুরু করেছেন। হয়তো সেই বিশ্বাস থেকেই বিনা শ্রমে পরীক্ষার সঙ্কট উতরে যাওয়ার দাবিতে কন্যাশ্রী বা সবুজ সাথী প্রকল্পের সুবিধাভোগী সন্তানের সঙ্গে পথে নেমেছেন লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর সুবিধা পাওয়া মায়েরাও।
বঙ্কিমচন্দ্র এঁদের নিয়ে সামাজিক ব্যঙ্গসন্দর্ভ লিখতেন কি না বলা দুষ্কর। তবে একটা গোটা জাতিকে এ ভাবে আত্মসম্মানবোধবর্জিত, শ্রমবিমুখ, ভিক্ষোপজীবীতে পরিণত হতে দেখে শঙ্কিত হতেন নিশ্চয়ই। আসল প্রশ্ন এই: দাতা ও গ্রহীতা, দু’জনের কেউই এই অবক্ষয়ের দায় এড়াতে পারেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy