Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
TMC

স্বয়ংসিদ্ধা অজন্তাকে বুঝি, কারণ আমিও রাজনীতির বাড়ির মেয়ে

আমার মনে আছে কোনওদিন হয়ত বাবা কাজে যাওয়ার সময় আমাকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাড়তে গিয়েছেন। আমি চার নম্বর গেটের অনেকটা আগে নেমে পড়তাম।

ফাইল ছবি

সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২১ ১০:৫৭
Share: Save:

‘সত্য থেকে সঙ্ঘ হতে পারে / সঙ্ঘ তবু পাবে না সত্যকে’ - শঙ্খ ঘোষ

“দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল।” ১৯৬৮ সালে এই মন্তব্য করেছিলেন ক্যারল হানিশ। ১৯৭০-এ এই নামে একটি প্রবন্ধও লেখেন ক্যারল। এই উক্তি নারীবাদ আন্দোলনের প্রধান স্লোগানগুলির একটি হয়ে দাঁড়ায়। আমার জীবনেরও প্রতিটি বাঁকে এই উক্তির কোনও বিকল্প খুঁজে পাইনি আমি। খানিকটা নারী হয়ে জন্মেছি বলে তো বটেই। আর খানিকটা, একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্মেছি বলেই কি?

আসলে, এই ‘রাজনৈতিক পরিবার’ কথাটার মধ্যেও একটি অসুবিধে রয়ে যায়। কারণ, একটি পরিবারের একজন যদি দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন, তা হলে ধরেই নেওয়া হয়, সেই সমগ্র পরিবারটি একটি রাজনৈতিক পরিবার। তবে অন্যথায় এ কথাও ঠিক যে, পরিবার কাঠামোটি তৈরিই হয়েছে সামাজিক আর অর্থনৈতিক রাজনীতির উপর ভিত্তি করে। সম্প্রতি অজন্তা বিশ্বাস এবং সিপিএমের সঙ্ঘাতের কথা পড়তে পড়তে আবার করে নিজের দিকে ফিরে তাকানো।

তখনও এত ‘দলে থেকে কাজ করতে পারছি না’-র দীর্ঘনিশ্বাস ঘিরে ফেলেনি আমাদের। তাই সে যুগে নানারকম বাড়ির সঙ্গে জুড়ে যেত কিছু দলের নাম। তেমনই ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জি রোডে আমাদের বাড়িটি ছিল একেবারে ‘কংগ্রেসি বাড়ি’। যে বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, বাসন্তী দেবীর নাম। আমার ঠাকুরদাদার পিসি, পিসেমশাই। সম্পর্ক বেশ দূরের হলেও ও বাড়ির দালান, উঠোন, খড়খড়িতে সর্বক্ষণ খেলে বেড়াত এইসব নাম আর তাঁদের গল্প। তা বলে লোকের সামনে নয়, কেবল নিভৃতে, আমাদের বড় হওয়ার অন্দরমহলে।

কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল হল। বাবাও চলে এলেন। তৃণমূল গড়ে ওঠার পর সেই প্রথম মিছিল আমার মনে আছে।

কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল হল। বাবাও চলে এলেন। তৃণমূল গড়ে ওঠার পর সেই প্রথম মিছিল আমার মনে আছে। ফাইল ছবি।

কী ভাবে আমার ঠাকুরদাদা, বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি যুক্ত ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসে) শুরুর জীবনে কর্মসূত্রে বহুবার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়ের, বা সেই যে সেই গল্পটা, যে গল্পটা বলার সময় বাবার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠত? বাবার ঠাকুরদাদা, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্টেশন থেকে মহাত্মা গাঁধীকে আনতে গিয়েছিলেন, উনি জি়জ্ঞাসা করেছিলেন ‘‘কেয়া খাওগে বাপু?’’, গাঁধী উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘দহি অওর চিড়া।’’ এই গল্পটা বলার সময় এমন কোনও ঔদ্ধত্য থাকত না, যে ‘দেখো আমাদের পরিবার, তোমার পূর্বপুরুষ গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন’। বরং এ কথা বলবার পরেই বাবা বলতেন, ‘‘কত বড় মানুষ ভাবো। আর উনি কী খেতে চাইলেন? না দই আর চিড়ে। এই হল যাপন। বুঝলে?’’

আমি তখনও মোটেই জানি না, কে এই গাঁধী, কে এই চিত্তরঞ্জন, বাসন্তী দেবী বা বিধানচন্দ্র রায়। কেবল বুঝতাম এঁরা সকলেই এমন কেউ যাঁরা ‘অন্যরকম’। একটু বড় হতে যখন বইয়ের আলমারিতে হাত দেওয়া শুরু হল তখন দেখলাম, রবীন্দ্র রচনাবলির উপরের তাকেই সার দিয়ে রাখা গাঁধী রচনাবলি। বন্ধুদের বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলি যদিও বা দেখতাম, এই বইগুলি বড় একটা দেখতাম না।

বাবা তখন চাকরি করেন। আমাদের বাস, অটো চড়া মধ্যবিত্ত পরিবার। ঠাকুমা অসুস্থ, তবু তারই মধ্যে মিছিলের গন্ধ আমি চিনতাম, সেই ছোট্ট থেকে। কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল হল। বাবাও চলে এলেন। তৃণমূল গড়ে ওঠার পর সেই প্রথম মিছিল আমার মনে আছে।

তার বেশ অনেক বছর পর বাবা তখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। পুরসভা নির্বাচনে বাবা প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেন এবং জিতলেন। এখনও মনে আছে, সে দিন স্কুল ফেরত দেখলাম, বাড়ি ভর্তি ফুল, মিষ্টি আর লোকের আনাগোনা। সে দিন সারা দিন ফোন করে যিনি ফলাফলের খোঁজ নিচ্ছিলেন, তিনি বলছিলেন, বাবা ফিরলে যেন বলি, ‘‘মানুদা ফোন করেছিল।’’ ফল ঘোষণার পর বাবা সে দিন আমাদের নিয়ে যাঁর বাড়িতে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন, তিনিই ‘মানুদা’ ওরফে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন শেষ করে রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন শেষ করে রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ফাইল ছবি।

এই নামটির সঙ্গে অনেকেরই হয়ত সুখস্মৃতি থাকার কথা নয়। কিন্তু ব্যক্তি মাঝে মাঝে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস ছাড়াই যদি সামনে আসেন, তখন আর মেপে দেখার সুযোগ ঘটে না। বহু সময়েই ভালবাসা আর শ্রদ্ধা আগেই এসে হাজির হয়। মায়া জেঠি সে দিন বলেছিলেন, ‘‘তোমার বাবা এক দিন মিষ্টি নিয়ে হাজির হল জানো? বলল চাকরি পেয়েছে, আমরা তো অবাক, এত দিন চাকরি ছিল না ওর? এত এত ছেলেরা ভিড় করত চাকরির জন্য, সেখানে তোমাদের বাড়িতে আমাদের কত যাতায়াত, এক দিনও বলেনি। অবশ্য সেই জন্যই এত ভালবাসি ওকে।’’

আমি আর দিদি তখন এসব শুনে গর্বিত হচ্ছি, কিন্তু এ-ও ভাবছি যে কখন বাড়ি গিয়ে এই জিতের একটা উদযাপন হবে। কিন্তু সে দিন বাড়িতে কোনও উদযাপনই হয়নি , বরং বাবা রাত্তিরে আমাকে আর দিদিকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘গতকাল অবধি যে জীবন কাটিয়েছ, আগামিকালও যেন সেই জীবনই থাকে। আর জানবে আগামিকাল থেকে যে নতুন ভালবাসাগুলো পাবে, তার মেয়াদ পাঁচ বছর।’’ এই পাঁচ বছরের ভালবাসার ‘এক্সপায়ারি ডেট’-এর কথা কোনও দিন ভুলিনি বলেই হয়ত আমার জীবনও কোনও দিন পাল্টায়নি।

তখন পুরসভার চেয়ারম্যান লালবাতির গাড়ি পেতেন। আমার মনে আছে কোনও দিন হয়ত বাবা কাজে যাওয়ার সময় আমাকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাড়তে গিয়েছেন। আমি চার নম্বর গেটের অনেকটা আগে নেমে পড়তাম। যাতে বন্ধু বা অধ্যাপকরা না দেখতে পান সেই লালবাতি। যাদবপুরে এসএফআই, ফ্যাস সকলের বক্তব্য মন দিয়ে শুনতাম। বুঝতে চেষ্টা করতাম। সবাই আমার বন্ধু ছিল। বন্ধুরা আমার বিয়েতে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে প্রথম জানতে পারে পারিবারিক রাজনৈতিক যোগের কথা। যে ছবি আমি আজ অবধি নেটমাধ্যমে কোনওদিন দিইনি। তার আগের বছরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাড়ে তিন দশকের বাম শাসন শেষ করে রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আর সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে মমতার ‘চিফ ইলেকশন এজেন্ট’ ছিলেন বাবা।

অনিল বিশ্বাসের কন্যা অজন্তা সিপিএমের কর্মী হয়েও তৃণমূলের মুখপত্রে নিবন্ধ লেখায় ওঁকে সাসপেন্ড করার অধিকার দলের নিশ্চয়ই আছে।

অনিল বিশ্বাসের কন্যা অজন্তা সিপিএমের কর্মী হয়েও তৃণমূলের মুখপত্রে নিবন্ধ লেখায় ওঁকে সাসপেন্ড করার অধিকার দলের নিশ্চয়ই আছে। ফাইল ছবি।

বছর গড়ায়। আমি সে দিন যে যুবককে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, তারও ভালবাসা ছাত্র রাজনীতি আর সুমনের গান। বিয়ের কিছু বছর পর তার কাছে নির্বাচনে লড়ার প্রস্তাব আসে যখন, সে তখন একটি বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে রাজনীতিকে বেছে নেয়। ২০১৫-র সেই নির্বাচনে অরূপ চক্রবর্তী (আমার বর) জেতেন, সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় (আমার বাবা) হারেন। আর আমি ঠিক বুঝতে পারি না, আমি কি হারলাম ? আমি কি জিতলাম ?

কিন্তু আমার জীবন থেকে বহু দূরে এই দলীয় রাজনীতি। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের লড়াইয়ের সময় স্বল্প ক’দিন রাজনীতির কাছাকাছি এলেও আমি বুঝেছিলাম, কোনও দলে আমি এঁটে উঠতে পারব না। কারণ, আমার যে সর্বক্ষণ মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের সেই লাইন, ‘সত্য থেকে সঙ্ঘ হতে পারে / সঙ্ঘ তবু পাবে না সত্যকে।’

কিন্তু এ কথা মানলেও, বাবা বা বরের পরিচয়কে এড়িয়ে চললেও দেখলাম সমাজ, সংস্কৃতি জগৎ আমার যে কোনও রাজনৈতিক অবস্থানকে, মতামতকে বারবার জুড়ে দিচ্ছে আমার পরিবারের সঙ্গে। আমার লেখালেখি, পড়াশোনার ওপরও চাপিয়ে দিতে চাইছে এই রাজনৈতিক পরিচয়কে, এ-ও কিন্তু আসলে এক মৌলবাদ। চারপাশে যখন ক্ষমতার আস্ফালন, দূর সম্পর্কের কোনও ক্ষমতাবানের কথাও যখন মানুষ জাহির করে বলে , তখন একেবারে বাড়ির নিজের মানুষদের পরিচয় উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার লড়াইটা খুব সহজ ছিল না।

ক্ষমতা বলতে আমি চিরকাল বুঝেছি মানুষের ‘বোধ’-কে। তিন দশক পেরনো জীবনের যেটুকু যাত্রাপথ, তার সবটুকু আমি নিজের জোরে হেঁটেছি। এই প্রসঙ্গে বলতেই হয় মায়ের (সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়) কথা। একটি নির্বাচনে মহিলা আসন সংরক্ষণের কারণে একটি দল থেকে আমার মা’কে নির্বাচনে লড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু মা অকপটে বলতে পেরেছিলেন, ‘‘যে কাজটি হয়ত আমি সম্পূর্ণভাবে নিজে পারব না, সেটায় আমার যুক্ত না হয়ে যোগ্য কেউ যুক্ত হলেই ভাল।’’

রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের পরিবারকে অভ্যাস করতে হবে নিজস্ব অর্জনে মন দেওয়ার, নাম না ভাঙানোর।

রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের পরিবারকে অভ্যাস করতে হবে নিজস্ব অর্জনে মন দেওয়ার, নাম না ভাঙানোর। ফাইল ছবি।

ফলে ‘রাজনৈতিক পরিবার’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার আগে ভেবে দেখা দরকার, সে রাজনীতির ধরণ কেমন? যেমন আমার জীবনের রাজনীতি হল এই যে, সব জগতে অবাধ যাতায়াত করেও নিজের সত্ত্বা আর পরিচয়কে একেবারে নিজের মতো করে গড়ে তোলা। কারণ, আমি মনে রাখতে চাই, একটি পরিবার হলেও সেই পরিবারের প্রত্যেকের অর্জন আলাদা আর কাছের মানুষের অর্জনে আমি আনন্দ পেতে পারি কিন্তু আমি ভাগ বসাতে চাই না তাতে। বরং মন দিতে চাই আমার নিজের অর্জনেই।

অনিল বিশ্বাসের কন্যা অজন্তা সিপিএমের কর্মী হয়েও তৃণমূলের মুখপত্রে নিবন্ধ লেখায় ওঁকে সাসপেন্ড করার অধিকার দলের নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু অনিল বিশ্বাসের মেয়ে বলে তিনি তাঁর মত প্রকাশ করতে পারবেন না , এমনটা কিন্তু হতে পারে না। তিনি স্বয়ংসিদ্ধা নারী। তাঁর বাবা আর তাঁর মত ভিন্ন হতেই পারে। রাজনৈতিক মতবাদ তো জিন সূত্রে প্রাপ্ত হয় না, তা একজনের বোধ থেকে, সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গড়ে ওঠবার কথা।

সামন্ততান্ত্রিক পরিবার নয়, ব্যক্তির মননই আসল, তবেই প্রকৃত গণতন্ত্র সম্ভব। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের পরিবারকে অভ্যাস করতে হবে নিজস্ব অর্জনে মন দেওয়ার, নাম না ভাঙানোর। বাকিদেরও অভ্যাস করতে হবে যাতে কোনও কারণে ব্যক্তির পরিচয়কে সমগ্র পরিবারের উপর আরোপ না করা হয়। কারণ, ‘যা ব্যক্তিগত তা-ই রাজনৈতিক’, কেবল এ কথাই সত্য নয়। বরং এ কথাও সত্য যে রাজনীতি আসলে একটি ব্যক্তিগত বোধ, ব্যক্তিগত বোধের চর্চা এবং উন্মেষ।

(লেখক কবি ও চিত্রনাট্যকার। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy