Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
R G Kar Hospital Incident

এই জাগরণের ভোরে

আর জি করের ঘটনায় বাঙালি মর্মাহত, বাঙালি লজ্জিত, বাঙালি বিক্ষুব্ধ। সে দিন ঠিক কী ঘটেছিল, তার পিছনে বৃহত্তর কারণ থাকলে সেগুলি কী, এ প্রশ্নগুলি সবই তদন্তসাপেক্ষ।

অশোক কুমার লাহিড়ী
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:৩৮
Share: Save:

পাড়ার গলিতে পথবাতি কাজ করছে না, তার প্রতিবাদে পাড়ার সবাই মিলে একটা আন্দোলন? সেটা অরাজনৈতিক হতেই পারে। হতেই পারে দল-মতনির্বিশেষে। কিন্তু পুরো সরকারি সিস্টেমের বিরুদ্ধে এবং সেই সিস্টেমের বিষবৃক্ষের ফলের বিরুদ্ধে আন্দোলন— সেটা বেশি দিন অরাজনৈতিক হবে কী করে? গলদ যখন সরকারি সিস্টেমে, তখন সেই সিস্টেমের আবর্তে থাকা কেষ্ট-বিষ্টুরা কি অরাজনৈতিক হবেন? তাঁরা— স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী-সান্ত্রিরা, সেই সিস্টেম দ্বারা পারিপালিত এবং পরিপুষ্ট দলের কার্যকর্তারা— তো সিস্টেমকে আঁকড়ে ধরে চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণপাত করবেনই! ৯ অগস্ট আর জি করের নিদারুণ ঘটনা ঘুণধরা সরকারি সিস্টেমের প্রতিফলন। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন বেশি দিন অরাজনৈতিক থাকবে, তা আশা করাটা কি বাতুলতা নয়? প্রশ্ন হচ্ছে: এখন যে গণআন্দোলন চলছে, সেটা কি রং বদলে পুরোপুরি রাজনৈতিক হওয়া উচিত, এবং হলে তার ঠিক সময়টি কখন?

আর জি করের ঘটনায় বাঙালি মর্মাহত, বাঙালি লজ্জিত, বাঙালি বিক্ষুব্ধ। সে দিন ঠিক কী ঘটেছিল, তার পিছনে বৃহত্তর কারণ থাকলে সেগুলি কী, এ প্রশ্নগুলি সবই তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু মানুষ চাইছেন এই নির্মম ঘটনার পর্দাফাঁস হোক, চাইছেন বিচার। কয়েক লক্ষ মানুষ— শুধু ডাক্তার-বদ্যি এবং ডাক্তারি ছাত্র নন, সর্ব স্তরের সাধারণ মানুষ— নানান বিক্ষোভ, অবস্থান-ধর্মঘটে পথে নেমেছেন, নেমেছেন মোমবাতি হাতে নিয়ে বিচার পেতে, আলোর পথে। শাসক দল অভিযোগ করছে, এটা ওদের বিরুদ্ধে বিরোধীদের একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। কিন্তু সত্যিই কি এটা রাজনীতি-প্রণোদিত, না ফেটে পড়া পুঞ্জীভূত জন-আক্রোশ? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নিজেও রাস্তায় নেমেছেন বিচারের দাবিতে। উনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, উনি শুধু মুখ্যমন্ত্রীই নন, পুলিশমন্ত্রীও বটে। দুর্মুখেরা যদি বলে যে, ওঁর ‘বিচার চাই’ দাবি আসলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা, সেটা কি অস্বীকার করা যায় ? উনি অপরাধীদের না ধরে, তাদের ফাঁসি চাইলে মনে হতেই পারে যে, আমরা এক আজব প্রদেশে বাস করি।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওদের সুদক্ষ ভোটসংগ্রহের সংগঠনে দুর্নীতি ছিল এবং আছে— দুর্নীতি আছে মূলত গোটা ব্যবস্থাটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জ্বালানি হিসাবে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা এবং খাদ্য দফতরের দুর্নীতির কথা ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে। সংশ্লিষ্ট প্রাক্তন মন্ত্রিমশাইরা এখন বঙ্গ সরকারের কারাগারে অতিথি। শিক্ষা ও খাদ্যের পরে এ বার স্বাস্থ্য দফতরের পর্দা উঠেছে। শাসক দল নির্বাচনের আগে বলত ‘খেলা হবে, খেলা হবে’। সে খেলা যে শিক্ষা, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যের মতো বিষয় নিয়েও হবে, সেটা আগে বোঝা যায়নি।

আর জি করের ঘটনায় তদন্তে ওই হাসপাতালে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসছে। শাসক দলের নেতারা তারস্বরে প্রতিবাদ করছেন যে, তদন্ত তো খুন ও ধর্ষণ নিয়ে, এর সঙ্গে দুর্নীতির কী সংযোগ? ওঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে, দুর্নীতি অপরাধমূলক কাজকর্মকে শুধু প্রশ্রয় দেয় না, তার প্রণোদনা জোগায়। অপরাধীরা আইনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মন্ত্রী-সান্ত্রির, বড় বড় পদাধিকারীর এবং পুলিশের রক্ষাকবচ চায়। হাতে কয়েক জন দুর্দান্ত দুষ্কৃতী থাকলে দুর্নীতির পথেও সুবিধা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বে তো বটেই, এমনকি উন্নত দুনিয়াতেও দুর্নীতি এবং অপরাধের অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে বিবিধ গবেষণা হয়েছে, আগ্রহী পাঠক তা খুঁজে দেখতে পারেন।

পশ্চিমবঙ্গে বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে দুর্নীতি। হাসপাতালে আউটডোরে দীর্ঘ লাইন; ডাক্তার অবধি পৌঁছতে কয়েক ঘণ্টা তো বটেই, কয়েক দিনও সময় লাগতে পারে; ভর্তি হতে পারলেও শয্যা পাওয়া অতি দুঃসাধ্য। ওষুধ থেকে পরীক্ষানিরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের জন্য রক্ত, সবই পাওয়া দুষ্কর। বাজারের নিয়ম হল, চাহিদার তুলনায় জোগান অপ্রতুল হলে দাম বাড়ে— যে ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকে না, সেখানে কালোবাজারি আরম্ভ হয়। আলু-পটল-চালের ক্ষেত্রে যেমন, অনেক সরকারি হাসপাতালের পরিষেবাতেও এখন সেই নিয়ম খাটছে। সম্প্রতি যে সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, হাসপাতালে এই কালোবাজারি দুর্নীতির খেলাটি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অত্যন্ত উঁচু কোনও জায়গা থেকে— এমন কারও হাতে, রাজ্যের ক্ষমতাকেন্দ্রের উপরে যাঁর নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ। আর জি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের যে গণবিস্ফোরণ ঘটেছে, তা কি প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের, এবং বৃহত্তর অর্থে গোটা রাজ্যের সর্ব স্তরে চলা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যখন গণদেবতা বিচার পেতে আলোর পথে নেমেছেন, তখন বিরোধীপক্ষের দল ও নেতাদের কী কর্তব্য? যখন শাসক দল রাজধর্ম ছেড়ে, অশুভ রাজনীতি অবলম্বন করে এই দুর্গতির জন্ম দিয়েছে এবং এখনও এই অশুভ রাজনীতি অবলম্বন করে ‘কাছের লোক’দের বাঁচানোর এবং বিচার ব্যাহত করার চেষ্টা করছে, তখন বিরোধীপক্ষের কী কর্তব্য? ওঁরা কি এই আন্দোলনের রাজনীতিকরণ না করে নিজের মতো চলতে দেবেন, না কি জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মেলাবেন? স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন যে, বিরোধী দলগুলি ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’-এর গণআন্দোলন সমর্থন না করলে একটি ঐতিহাসিক ভুল হবে। আন্দোলনের রাজনীতিকরণ না করে, জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মেলানো সম্ভব। আর জি করের মর্মান্তিক ঘটনার পর, ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের, প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে, কোনও মানুষেরই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু বিরোধীরা আন্দোলনের একদম সামনে এগিয়ে এলে, গণআন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা হ্রাস পাবে। শুধু তা-ই নয়, বেশি সামনে এগিয়ে এলে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের নেতা ও নেত্রীরা ক্রমাগত দাবি করবেন যে, এই আন্দোলন ওঁদের অগণতান্ত্রিক উপায়ে উৎখাত করে গদি দখলের একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। অনুমান করা চলে, মুখ্যমন্ত্রী একান্ত ভাবে চাইছেন যে, বিরোধী রাজনীতিকরা আন্দোলনের সামনে আসুন। বিরোধীদের এই ফাঁদে পা দেওয়াটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে না। বিরোধীপক্ষের উচিত গণআন্দোলনের নেতৃত্ব না দিয়ে, তাকে পূর্ণ ভাবে সমর্থন করা।

সে রকম সমর্থনের উদাহরণ? প্রথমত, বিরোধী দলগুলির কাজ হওয়া উচিত আর জি করে ৯ অগস্ট নিদারুণ ঘটনার অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য শাসক দল কী ভাবে সাক্ষীসাবুদ লোপাট করার চেষ্টা করেছে এবং করছে, সেই বার্তা বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীরা সম্মিলিত ভাবে রাজ্যের শাসক দলের থেকে বেশি ভোট পেয়েছিলেন। বিরোধীরা পেয়েছিলেন ২.৯৬ কোটি ভোট, শাসক দল ২.৭৬ কোটি। প্রায় তিন কোটি মানুষ শাসকদের বিরুদ্ধে ছিলেন ও আছেন, এবং তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে। এই বিপুল সংখ্যার মানুষ যদি বিচার চান, দেখা যাক শাসক কত দিন বিচারের আওতার বাইরে লুকিয়ে থাকেন? এই বিচার চাওয়া মানুষদের পূর্ণ সমর্থন দিতে হবে— সেই সমর্থনে দলের পতাকা না-ই বা থাকল। না-ই বা থাকল সংবাদমাধ্যমে আর টেলিভিশনের পর্দায় বিরোধী নেতাদের ছবি এবং বক্তব্য।

শোনা যাচ্ছে যে, সাধারণ মানুষ যাঁরা এই গণআন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের শাসক দল নানা ভাবে শাসাচ্ছে, ধমকাচ্ছে, মিথ্যা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখাচ্ছে। বিচারের দাবি করার জন্য যাঁরা এ ভাবে নিপীড়িত হচ্ছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দ্বিতীয় কর্তব্য হল তাঁদের একটি লিগ্যাল হেল্পলাইন নম্বর দিয়ে আইনি সাহায্য দেওয়া।

বিচারের বাণীকে নীরবে, নিভৃতে কাঁদতে দেওয়া যাবে না। বিচারের বাণীর কণ্ঠরোধ করা যাবে না। গণআন্দোলন চলুক, সাধারণ মানুষ বিচারের দাবিতে আলোর পথে এগিয়ে যাক। শাসক দলের মধ্যেও বিচারের দাবিতে, আলোর পথে এগোনোর দাবি আরও জোরদার হোক। আগে বিচার পাওয়া যাক, রাজনীতি পরে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Doctor Rape and Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy