মাথাভাঙা নদী তার সর্পিল শরীর জড়িয়ে ঠিক আত্মজার মতো যে স্থলভূমিকে আগলে রেখেছে, সেই ‘অ-ভারতেই’ ওদের বাস। জেলা নদিয়া, দেশ ভারত। থুরি বাংলাদেশ। না, না— ভারতও নয়, বাংলাদেশও নয়। ওরা যে নামহীন, গোত্রহীন, স্বদেশবিহীন। তবে ভারত সরকারের দেওয়া ভোটার কার্ড আর রেশন কার্ড ওদের সকলের কাছেই আছে।
এই কার্ডগুলোই যে ওদের কাঁটাতারের নিরাপত্তায় ঘেরা ‘নিরাপদ ভারত’ ছোঁয়ার ‘এন্ট্রি পাস’। ওদের ইহকাল, ওদের পরকাল। ওরা আদ্যোপান্ত ভারতীয়, তবু অভারতীয়। ওদের কাছে ভারত বলতে সকাল ৬টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত। তার পরেই ভূ-ভারতের লৌহকপাট বন্ধ হওয়ার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ওঁরা বন্দি হয়ে থাকে কাঁটাতারের ও পারের নিরাপত্তাহীন ভারতে। চার দিকে ভারী বুটের কম্পিত আস্ফালন। চকচকে বেয়নেটের লকলকে জিহ্বার উঁকিঝুঁকি। মাঝে মধ্যে অ্যাসল্ট কালাশনিকভ থেকে বিদ্যুতের বেগে ছুটে যাওয়া আগুনের ঝলক। বক্ষছেদী বাংলার কর্ণ ভেদ করে মর্মভেদী তীব্র আওয়াজ।
তার পর আবার সব সুনসান। থুরথুরে পেঁচার ডানায় ভর করে নদীতীরে রাত আরও নিশুতি হয়। বৃষ্টি ভেজা রাত্রি শেষের সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে ঘোড়ানিম গাছের মাথায় উঁকি মারে ঝলমলে নতুন সূর্য। মাথাভাঙার আস্কারায় বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের জমিতে গড়ে ওঠা নদিয়ার করিমপুর ১নং ব্লকের অধীনস্থ হোগলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এমনই এক ভারতীয় বসতি সম্পন্ন চরভূমিতে কাশীনাথের ঘর।
কালচে বাঁশের বেড়ার উপর শ্যাওলা ধরা টালির চালটা যেন কাশীনাথের গার্হস্থ্য জীবনের নিবিড় প্রতিচ্ছবির নির্মম প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক প্রান্তে তিরতির স্রোতে দুলতে থাকা সোহাগি মাথাভাঙা। তারই ও পারে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা। আর অন্য প্রান্তে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে নিশিদিন প্রহরারত কাঁটাতারের বেড়া।
সেই কবে এক শ্রাবণী পূর্ণিমার সাঁঝে কাশীনাথ ছুঁয়েছিল মাধুরীর মধুকরী হাত। তার পর মাথাভাঙার বুক উজাড় করে কত জলের ধারা বয়ে গিয়েছে। কিশোর কাশীনাথের শরীর-মন জুড়ে তত দিনে উদ্ধত যৌবনের উদ্দাম উচ্ছ্বাস। মাধুরীর কোমরের ভাঁজে যেন নদী বাঁকের তরঙ্গের ঝলকানি। শ্রাবণী পূর্ণিমা এলে দু’জনেই অস্থির হয়ে ওঠে। ফি বছর সুযোগের অবকাশে এই দিনটায় ঠিক মাথাভাঙার পাড়ে এসে দাঁড়ায় দু’জনে। আজন্মের নদীর সোহাগি ঠোঁটে বৃষ্টি ধোয়া আকাশ ফুঁড়ে ঝকঝকে চাঁদও যেন পায়ে পায়ে নেমে আসে। মাথাভাঙার আস্কারায় বেড়ে ওঠা ‘বেজন্মা’ মেঠো ফুল খিলখিল করে হেসে ওঠে। কাশীনাথের বাহুবন্ধনে লাজুক চাঁদ যেন প্রশ্রয়ের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। আর আকাশের শ্রাবণী চাঁদকে সাক্ষী রেখে দু’জনের নীরব অঙ্গীকার মাথাভাঙার স্রোতে পাক খেতে থাকে— “প্রেয়সীর সাথে যে নিমেষে হবে চারি চক্ষুতে চাওয়া”।
নির্মম ভাগ্য বুঝি দারিদ্র্য আর অসহায়তাকে কেবল পরিহাসের চোখেই দেখে থাকে! দারিদ্র্যের অজুহাতে এবং জাতপাতের জাঁতাকলে মাধুরীর অন্যত্র বিবাহ স্থির হয়ে যায়। অস্থির কাশীনাথের অসহায় চোখের সামনেই। কাকতালীয় ভাবে সে দিনও ছিল এক শ্রাবণী পূর্ণিমা। বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মাধুরীর মৃত্যু হয়। এর অল্প কিছু দিন পরেই মাধুরীর স্বামী তাঁদের কন্যা সন্তানকে মাধুরীর বাবা-মার কাছে গচ্ছিত রেখে দ্বিতীয় বার বিবাহ করে। মাধুরীর মেয়ের যখন দু’বছর বয়স, অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে মাধুরীর বাবা এবং মা দু’জনেই গত হন। অচিরেই মাধুরীর দাদারা ওই দুধের শিশুটিকে অনাথ আশ্রমে চালান করার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে। খবর যায় কাশীনাথের কাছে। নাহ, কাশীনাথকে এ নিয়ে দু’বার ভাবতে হয়নি। তাঁর কৈশোর প্রেমের একমাত্র স্মৃতি সম্বলটুকু নিজ বক্ষে আগলে রাখার পূর্ণ দায়িত্ব সে সে দিন থেকেই সাগ্রহে গ্রহণ করে।
কাশীনাথ আমায় ডেকে নিয়ে তার ঘরে বসাল। ঘরের অন্দরের প্রতিটি বস্তুই তাঁর হতদারিদ্রের চালচিত্রকে নিদারুণ ভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছিল, শুধু ঘরের এক কোণে ঝোলানো ফোটোফ্রেম থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা এক যুবতীর দু’টি চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি যেন ঘরের সকল কোণ আগলে রেখেছে— “বাবু, এই আমার সংসার। নদীতে মাছ ধরে আর সামান্য জমিজিরেতে ফসল ফলিয়ে কোনও মতে সংসার চালাই।”
বাংলাদেশের জমিতে ফলানো ফসল যে ভারতে বিক্রি করা মানা। একই কারণে ১০০ দিনের কাজের অধিকার থেকেও এই চরাচরের মানুষরা বঞ্চিত। কাশীনাথের ঘরে ঝোলানো ফোটোফ্রেমের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এ সংসারের রক্ত সঞ্চালনকে গতিশীল রেখেছে বটে, কিন্তু ত্রস্ত পায়ের ব্যস্ততা নেই, ঘোমটা দেওয়া লাজুক আবছায়ার উঁকিঝুঁকি নেই। পাড়াগাঁয়ের গেরস্থের এ কেমন সংসার! স্বগতোক্তির মতোই যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে এল— “গিন্নি বুঝি বাড়িতে নেই? তিনিও বুঝি কোনও কাজকর্ম করেন?” কাশীনাথ অন্তহীন শূন্যতায় নিঃস্ব হয়ে আমার দিকে চাইল। তার চোয়াল-চিবুক শক্ত হয়ে এল। কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু তাঁর গলার মধ্যেই তা দলা পাকিয়ে আটকে গেল। চাপা গলায় কাশীনাথ বলে ফেলল— “বাবু, আর কাউকে বিয়া করার কথা কখনও মনে জাগে নাই।”
শহুরে সভ্যতাময় নাগরিক সমাজের পিঠে কে যেন সজোরে কষাঘাত করল। এত দারিদ্র্য, এত বঞ্চনার মাঝেও ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার অদম্য ব্রত থেকে এতটুকুও বিচ্যুতি নেই! সেই কবেকার ভালবাসার মানুষ এত দিনে কোন অমৃতে আজও জীবন্ত হয়ে বুকে রয়ে গেল! মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের জগৎ সংসারের মাঝে মাথাভাঙার চরের এক হতভাগ্যের হতদৈন্য ঘরে এ আমি দেখি কার মুখ! আর আমার সামনে যে মানুষটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে, তার বুকের মাঝে প্রবল ঝড়ের আস্ফালনে দিশেহারা অথৈ সমুদ্রের উথাল পাথাল।
তবু এতখানি খাঁটি!
রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy