চার মাস ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থমকে থাকার পর এই রকমই কিছু একটা দরকার ছিল। আন্ডারডগ হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকেই প্রথম টেস্টে হারিয়ে চমকে দিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০ বছর আগে শেষ বারের মতো ব্রিটিশ ভূমিতে ঘরের দলকে প্রথম টেস্টে হারিয়ে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল ক্যারিবিয়ানরা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাঁরা নিতান্তই পার্শ্বচরিত্র ছিলেন, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত নতুন করে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের গৌরবময় অধ্যায় রচনা করলেন। এই টেস্টে ৯ উইকেট নেওয়া ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ শ্যানন গ্যাব্রিয়েল প্রায় এক বছর আগে শেষ টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই টেস্টেও তিনি শেষ মুহূর্তে দলে জায়গা পান। আবার, এই টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় যখন দ্রুত উইকেট হারিয়ে অনিশ্চয়তার গোলকধাঁধার মধ্যে পাক খাচ্ছে, তখন বহু দিন অন্ধকারে পড়ে থাকা জারমেন ব্ল্যাকউডের সুদৃঢ় ৯৫ দলকে জয়ের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। জেসন হোল্ডার মাত্র ২৩ বছর বয়সে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পাওয়ায় প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। সে সব খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে প্রথম ইনিংসে হোল্ডারের ৬ উইকেট প্রাপ্তি ক্রিকেটপ্রেমীদের অন্য রকম তৃপ্তি দিয়েছে। একটা মাঝারি মানের দলকে হোল্ডার যে ভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
কোভিড-১৯ অতিমারিতে জীবনের আর পাঁচটা জিনিসের মতো খেলাধুলার জগৎ-ও একদম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ় টেস্ট এক অভূতপূর্ব পরিবেশে খেলা হয়েছে— স্টেডিয়াম দর্শক-শূন্য। মনে হতে পারে, আন্তর্জাতিক খেলা নয়, প্র্যাকটিস ম্যাচ চলছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাটের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও বৈচিত্রপূর্ণ বিভাগ হল পাঁচ দিন ধরে চলা টেস্ট ক্রিকেট। পাঁচটি দিনে বহু অকল্পনীয় ঘটনা ঘটতে পারে। একটি টেস্ট ম্যাচে অজস্র অনিশ্চয়তার বাঁক থাকতে পারে। এখানেই টেস্টের কাঠিন্য ও বৈচিত্র। এ দিকে, সাদাম্পটনের দর্শকহীন টেস্ট শূন্যতা তৈরি করেছিল বইকি। সেই সঙ্গে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বজায় রাখার চাপ। আশঙ্কা ছিল, এই ম্যাচ এবং সিরিজ় একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবে। কিন্তু আন্ডারডগ ট্যাগ ছিঁড়ে ফেলে এক দল তরুণ ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার প্রমাণ করে দিলেন যে তাঁরাও সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রাখতে জানেন।
ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অধিনায়ক জো রুট ব্যক্তিগত কারণে প্রথম টেস্টে খেলতে পারেননি। কিন্তু তা বলে ইংরেজরা দুর্বল ছিল, এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া জিমি অ্যান্ডারসন, বেন স্টোকসরা ইংল্যান্ডের দলে ছিলেনই। অ্যান্ডারসন এই মুহূর্তে টেস্ট ক্রিকেটের সফলতম ফাস্ট বোলার। বেন স্টোকস ইতিমধ্যেই ইংরেজ ক্রিকেটে প্রায় লোকগাথার অংশে পরিণত হয়েছেন। গত বছর বিশ্বকাপ ফাইনালে স্টোকসের ব্যাট অবিশ্বাস্য ভাবে ঝলসে উঠেছিল বলেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিততে সক্ষম হয়েছিল। গত বছরই অ্যাশেজ়ের হেডিংলে টেস্টে স্টোকসের সেই দুর্ধর্ষ ম্যাচ জেতানো অপরাজিত সেঞ্চুরি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এবং, ঘরের মাঠে ইংরেজরা বরাবরই প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে অবতীর্ণ হয়। সেখানে সীমিত সম্পদ নিয়েও ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের এই দুর্দান্ত জয় অবশ্যই বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। ক্রিকেটপ্রেমীরাও নিশ্চয়ই বহু দিন মনে রাখবেন এই টেস্ট। যেখানে আশঙ্কা ছিল যে শুধু স্বাদগন্ধহীন ‘নিরামিষ তরকারি’ জুটবে, সেখানে ক্রিকেটপ্রেমীরা যেন ‘মটন বিরিয়ানি’র স্বাদ পেলেন!
এই টেস্ট আরও একটি বিশেষ কারণে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডকে নৃশংস ভাবে হত্যা করার পর গোটা বিশ্ব জুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকারের দাবিতে জোরদার হয়ে উঠেছে এই আন্দোলন। সাদাম্পটন টেস্টে দেখা গেল, কিংবদন্তি প্রাক্তন ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিং এবং ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া প্রথম মহিলা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার এবোনি রেনফোর্ড-ব্রেন্ট কী ভাবে বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, তা প্রকাশ করলেন।
রেনফোর্ড-ব্রেন্ট বলেছেন, ইংল্যান্ডের মহিলা জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পথে বর্ণবৈষম্যের বিষাক্ত তির তাঁকে বহু বার বিদ্ধ করেছে। প্রাক্তন ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলার হোল্ডিং জানিয়েছেন, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। হোল্ডিংয়ের মামার বাড়ির লোকেরা তাঁর মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি এক জন ‘খুব কালো’ লোককে বিয়ে করেছিলেন! এ কথা বলতে গিয়ে হোল্ডিং কান্নায় ভেঙে পড়েন। যে হোল্ডিংয়ের দুর্ধর্ষ ঝোড়ো বোলিং বহু ব্যাটসম্যানের (তার মধ্যে কয়েক জন গর্বোদ্ধত শ্বেতাঙ্গ ব্যাটসম্যানও ছিলেন) উইকেট উড়িয়ে দিত, সেই হোল্ডিং ভেসে গেলেন চোখের জলে! বর্ণবৈষম্যের তির নিশ্চিত ভাবেই এই বিশ্ববিখ্যাত প্রাক্তন ফাস্ট বোলারের মনকে প্রবল রক্তাক্ত করেছিল।
টেস্টের প্রথম দিনেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ় এবং ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা হাঁটু মুড়ে বসে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকে আলাদা মাত্রা দিয়েছেন। বিশেষত, অধিনায়ক হোল্ডারের নেতৃত্বে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে উত্থিত মুষ্টিবদ্ধ হাত দলে এক ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তার জন্ম দিয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল অসামান্য এক মুহূর্ত। হয়তো সেখানেই অভূতপূর্ব জয়ের নীল নকশা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
কোভিড-১৯ নামক অতিমারি, থমকে যাওয়া ক্রিকেটের জগৎ, বর্ণবৈষম্যের ভয়ঙ্কর বিষ— সব কিছুকে অতিক্রম করে এক দুর্দান্ত পুনরারম্ভের প্রয়োজন ছিল। সাদাম্পটনে ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের এই টেস্ট সেটাই করে দেখাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy