—প্রতীকী চিত্র
স্বাধীন ভারতের ৭০ বছরে ইতিহাসে বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন। এই পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে গেলে খুবই তাড়াতাড়ি উল্লেখযোগ্য সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। শিল্পভিত্তিক সরকারি হস্তক্ষেপই বৃদ্ধির হারের এই নিম্নগতিকে রোধ করতে পারবে। এমনটাই মনে করেন নীতি আয়োগ-এর চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় সরকারের ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ রাজীব কুমার। অন্য দিকে, কেন্দ্রের আর্থিক উপদেষ্টা কে সুব্রামনিয়াম মনে করেন, এই টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের একমাত্র রাস্তা ও পন্থা হচ্ছে ভূমি ও শ্রমের বাজারের আমূল পরিবর্তন। বলা ভাল দ্বিতীয় দফার কাঠামোগত সংস্কার। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান গভর্নর শক্তিকান্ত দাসের কথাও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ শোনা যায়। একটি সাক্ষাৎকারে উনি জানান, ২০১৯ সালের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে জিডিপি বৃদ্ধির হার হিসেব করা হয়েছিল ৭ শতাংশ। পরে তা সংশোধন করে করা হয় ৬.৭ শতাংশ। কিন্তু ২০১৯ সালের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম ত্রৈমাসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। যা কি না গত ছ’বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ সবই কেন্দ্রীয় সরকারের ঘনিষ্ঠ বিদ্বজ্জন ও অর্থনীতিবিদদের স্বীকারোক্তি। এ রকম স্বীকারোক্তি খুবই উল্লেখযোগ্য বার্তা বহন করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে।
অর্থনীতির দৈন্য দশা নিয়ে আমি, আপনি যতই চিৎকার, চেঁচামেচি করি না কেন, যতই যুক্তি দেখাই না কেন, যতই দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদেরা অর্থনীতির ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে বলুন না কেন, সরকারের খুব একটা হেলদোল হয় না। তাই আজ যখন সরকারি বৃত্তের মধ্যে থাকা অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তখন ধরে নিতে হয়, সত্যিই অর্থনীতিতে মন্দার অশনি সঙ্কেত। আর সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, যখন আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি দেশের ঋণযোগ্যতা পুনর্মূল্যায়ন করে কমিয়ে দেয়। ইদানীংকালে এমনটিই হয়েছে। কিন্তু শুরু হয়েছিল ভিন্ন ভাবে।
প্রায় ১৪ বছর পরে, ২০১৭ সালে নভেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি, ‘মুডিজ’ ভারতের ঋণযোগ্যতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে দেয়। তখন বলা হয়েছিল যোগ্য ব্যক্তির হাতে দেশের ভার রয়েছে ও নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ কাঠামোগত সংস্কারের উপরে ভিত্তি করে ঋণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ‘মুডিজ’-এর এই মনোভাব খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়। মাত্র দুই বছরের মাথায় এই সংস্থা ২০১৯ সালে ভারতের বৃদ্ধির হার তিন বার পুনর্মূল্যায়ন করে এবং ৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.৬ শতাংশ করে দেয়।
আসুন এ বার দেখে নেওয়া যাক অর্থনীতিতে মন্দার অশনি সঙ্কেতের কারণগুলি।
বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ‘সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)’ তাদের প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্টে এই উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। সিএমআইই-র রিপোর্ট বলছে, দেশে বেকারত্বের হার কতটা দ্রুত হারে বাড়ছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, আগের মাস সেপ্টেম্বর (৭.২ শতাংশ) থেকে বেকারত্বের হার অক্টোবরে বেড়েছে ১.৩ শতাংশ। এটাও একটি রেকর্ড। দেশের কর্মসংস্থানের বেহাল ছবি সামনে আনে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রক। সেই রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৭-’১৮ অর্থবর্ষে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৬.১ শতাংশ। ১৯৭৪-এর পরে দেশের কর্মসংস্থানের হাল কখনও এত খারাপ হয়নি।
ভুললে চলবে না, একটি সময় সরকারি পরিসংখ্যানে কিছু ভুল ত্রুটি অনিবার্য কারণে থেকে যেত। কিন্তু ইদানীংকালে সরকারি পরিসংখ্যান ও তথ্য জনগণের থেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে যে সব পরিসংখ্যান ও তথ্য সরকারকে বিচলিত করতে পারে ও সরকারি দলকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে, সেই সব ক্ষেত্রে তথ্য চেপে যাওয়ার মতো অনভিপ্রেত ঘটনা হামেশাই ঘটছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) কর্মকর্তাদেরও এই তথ্য লুকিয়ে রাখার প্রবণতা নজরে আসে। যার ভিত্তিতে তাঁরা ভারতকে সাবধান করে দেন।
আগের বছরের সেপ্টেম্বরে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন যা ছিল, গত সেপ্টেম্বরে তা ৫.২ শতাংশ কমেছে। আর গত অগস্টে দেশে শিল্পোৎপাদন যে গতিতে কমেছে, তা গত ৭ বছরে সর্বাধিক। ওই মাসে কারখানায় উৎপাদন কমেছে ৩.৯ শতাংশ। মূলধনী পণ্য উৎপাদনের হারে ২০.৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বলা হয়, এই মূলধনী পণ্য উৎপাদন পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের এক মূল স্তম্ভ। মেয়াদি ভোগপণ্য উৎপাদন কমেছে প্রায় ১০%। বিদ্যুতের চাহিদার হার কমেছে ১৩.২%, যা গত ১২ বছরের সর্বকালীন রেকর্ড। এ সব তথ্য থেকেই বেরিয়ে আসে অর্থনীতির করুন দশা যা প্রতিফলিত হয় বাড়ি, গাড়ি বিদ্যুৎ-সহ নানা পণ্যের চাহিদার হ্রাসে। বলা হয়ে থাকে, ভারতের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার অনেকটা নির্ভর করে জনগণ ও সরকারের ভোগব্যয়ের উপরে। গত পাঁচ বছরে এই সম্মিলিত ভোগব্যয় গড়ে ৭.৮% হারে বেড়েছে যা অর্থনীতির বৃদ্ধির হারকে সাতের ওপর রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই সম্মিলিত ভোগ ব্যয় কমে হয়েছে ৩.১% যা গত বছর মার্চে ছিল ৭.২%। সাধারণ গৃহস্থের জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের তুলনায় টাকার রেকর্ড পতন, কর্মহীনতা— এ সবের যৌথ ফল ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। যার প্রভাবে ভোগব্যয় কমে যায়। প্রকারান্তে অর্থনীতির বেহাল দশার নির্দেশক হয়ে দাঁড়ায়। তাই খুব সহজেই অনুমান করা যায়, অর্থনীতির বিকাশের গতি নিম্নমুখী। এই নিম্নগামী উন্নয়নের গতির জন্য বিভিন্ন শিল্পে, কল-কারখানার ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই ও স্বেচ্ছা অবসর প্রকল্পের খাঁড়া ঝুলে থাকে কর্মীদের ওপর। ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে যা আবার চাহিদা হ্রাসের মূল কারণ। এ এক কর্মসংস্থান-আয়-ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদার দুষ্ট চক্র।
শিল্পোৎপাদনের এই করুণ হালের জন্য করের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে কম পরিমাণ শুল্ক জমা হয়। অন্য দিকে, জিএসটি-এর অস্বাভাবিক উচ্চ হার প্রায় সব ব্যবসা, বাণিজ্যের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াছে। যার প্রভাব পড়ে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়নমুখী প্রকল্পের ব্যয়ভার বহনের উপরে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই সরকারকে নিত্য নতুন আয়ের উৎস খুঁজতে শুরু করে। আসলে সংসারে টানাটানি পড়লে অতীতের সঞ্চয় ও সম্পদের ওপর হাত পড়ে যায়। এই ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই হাত পড়ে যায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির উপরে। শুরু হয়ে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নীকরণ। ভারত পেট্রোলিয়াম, কনটেনার কর্পোরেশন, শিপিং কর্পোরেশন ,নিপকো ও তেহরি জল বিদ্যুৎ নিগম-এর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নীকরণের সিলমোহর ইতিমধ্যে পড়ে গিয়েছে। বিলগ্নীকরণের নজরে আছে বিএসএনএল ও পোস্টঅফিসের মতো প্রাচীন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিও। ক্ষেত্র বিশেষে ভারতীয় রেলের বিলগ্নীকরণ ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে।
ধুঁকতে থাকা আর্থিক ক্ষেত্রগুলি অর্থনীতির সমস্যাগুলি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যানে দেখাচ্ছে, মোট অনাদায়ী ঋণের প্রায় ২১ শতাংশের জন্য দায়ী বড় শিল্পপতি ও শিল্পগোষ্ঠীরা। অনাদায়ী ঋণের জন্য ব্যাঙ্কগুলির ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট’-এর (এনপিএ) বোঝা বাড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ব্যালেন্স শিটে এর প্রভাব পড়ে। সম্প্রতি এনপিএ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। যার প্রভাবে ব্যাঙ্কগুলি নতুন করে ঋণ দেওয়ার আগে অনেক বার ভাবে। দীর্ঘ টালবাহানা পরে ঋণ পাওয়া যায়। ঋণ পাওয়া এই দীর্ঘসূত্রতা বিনিয়োগের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিবিধির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
এই সবকে কি অর্থনীতির পরিভাষায় মন্দা বলা যায়? পর পর তিনটি ত্রৈমাসিকে জিডিপি সংকুচিত হলে তাকে অর্থনৈতিক মন্দা বলা হয়। পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে, সম্প্রতি অর্থনীতির অবস্থাকে মন্দা না বলা গেলেও মন্দার পূর্বাভাস বলতে আপত্তি নেই। পাঁচ ট্রিলিয়নের অর্থনীতির স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এখন মন্দার গ্রাস থেকে বাঁচতে মরিয়া। নোটবন্দির মতো তুঘলকি সিদ্ধান্ত খুব সম্ভবত এই মন্দার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy